রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে
নানা ঋণ কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত দেশের ব্যাংক খাত। নতুন বিনিয়োগের জন্য ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেননি শিল্প খাতের অনেক গ্রাহক। তাদের অনেকেই ঋণ নিয়েছেন জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে। এক প্রতিষ্ঠানের নামে নেয়া ঋণ বিনিয়োগ হয়েছে অন্য প্রতিষ্ঠানে। বিদেশেও পাচার হয়েছে ব্যাংকের অর্থ। ক্রমবর্ধমান ঋণখেলাপির পাশাপাশি বর্তমানে আরেক বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে কভিড মহামারী। অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণসহ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। পরিস্থিতি অন্যদের সংযত করলেও বিপরীত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে। মহামারীতেও শিল্প খাতে উদারহস্তে মেয়াদি ঋণ বিতরণ থেকে বিরত থাকেনি ব্যাংক চারটি। এর বিপরীতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ঋণের অর্থ আদায়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ করেছিল ২ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছিল ৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর ২০১৯-২০-এর দ্বিতীয়ার্ধে কভিডের কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নামে। যদিও ওই সময় শিল্প খাতে মোট ৭ হাজার ৫২০ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ বিতরণ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক চারটি। ওই সময়ে আদায় হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিল্প খাতে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের সম্মিলিত মেয়াদি ঋণ বিতরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এর বিপরীতে আদায় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে মাত্র দশমিক ৭ শতাংশে। বিতরণের চেয়ে আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণের স্থিতি বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণের স্থিতি ছিল ৪৭ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। অথচ এক বছরের ব্যবধানে এ খাতের ঋণের স্থিতির পরিমাণ ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বেড়ে ৫৫ হাজার ৯৪০ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। বিষয়টি উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞদের। তাদের ভাষ্যমতে, বিতরণকৃত ঋণ আদায় না হওয়ায় শিল্প খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণের স্থিতি বেড়েই চলেছে। আগ্রাসী বিনিয়োগের এ ধারা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোয় আবারো হলমার্ক, ক্রিসেন্টের মতো বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণ করতে গিয়ে বারবার বিপদে পড়েছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। ২০১৯ সাল থেকেই ব্যাংক চারটির মধ্যে মেয়াদি ঋণ বিতরণের প্রবণতা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। দেশে মহামারীকালীন বিপর্যয়ের মধ্যেও এ প্রবণতা চলমান রয়েছে। স¤প্রতি একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার মেয়াদি ঋণের অনুমোদন দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক। এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঋণকে সাধারণত শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণ হিসেবেই দেখানো হয়।
ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক চারটির আরো সতর্ক থাকা দরকার বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে অসতর্ক ও বাছবিচারহীন ঋণ বিতরণের কারণে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো মূলধন ও সঞ্চিতির সংকটে পড়েছে। এখন দেখতে হবে অতীতে যারা ব্যাংকগুলোকে বিপদে ফেলেছে, তাদের কাছেই আবার ঋণের অর্থ যাচ্ছে কিনা। এমনিতেই দেশের ব্যাংক খাত অল্প কিছু বৃহৎ শিল্প গ্রুপ ও পরিবারের কাছে এক প্রকার জিম্মি। এখন নতুন করে দেয়া ঋণও বিপদে ফেলা পুরনো গ্রাহকদের কাছে গেলে ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ছয়টি। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের পাশাপাশি এ তালিকায় রয়েছে বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) নাম। লুণ্ঠনের শিকার হয়ে অনেক আগেই বড় ঋণ বিতরণের সক্ষমতা হারিয়েছে বেসিক ব্যাংক। পাশাপাশি বিডিবিএলের ঋণ বিতরণের সক্ষমতাও খুবই দুর্বল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বর্তমানে কেবল শীর্ষ চার ব্যাংকেরই বড় ঋণ বিতরণের সক্ষমতা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এ ঋণের মধ্যে ৫৫ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। শিল্পে মেয়াদি ঋণের বৃহৎ অংশই দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে। শিল্প খাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা। চলমান মহামারী ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি বিচারে শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণ বিতরণ থেকে নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। কৃষি ও এসএমই থেকে ভালো আদায় হলেও শিল্পে খাত থেকে সোনালী ব্যাংকের ঋণ আদায় পরিস্থিতি খারাপ বলে জানিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান। তিনি বলেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় দেয়া সত্ত্বেও গ্রামের কৃষি ও এসএমই ঋণের আদায় ভালো। তবে শিল্প খাতসহ বড় ঋণের আদায় পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। করোনার প্রথম ধাক্কায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ থেকে বিমানসহ বড় কিছু শিল্প গ্রুপকে স্বল্প সুদের ঋণ দেয়া হয়েছিল। এর বাইরে শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণের বড় প্রবৃদ্ধির বিষয়ে আমার জানা নেই। দেশে এখন নতুন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের ঋণ অধিগ্রহণই বেশি করছে।
কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ বৃহৎ শিল্পে উদারহস্তে বিনিয়োগ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামস-উল-ইসলাম বলছেন, করোনার প্রথম ধাক্কায় ঋণ আদায় একেবারেই কমে গিয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে ঋণ আদায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ছোটদের পাশাপাশি বড় উদ্যোক্তারাও কিছু কিস্তি পরিশোধ করছেন। মো. শামস-উল-ইসলাম জানান, অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ-আমানতের অনুপাত (এডিআর) ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় এডিআর কমে গেছে। হাতে বিপুল পরিমাণ নগদ তারল্য থাকলেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা সতর্ক।
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, কয়েক বছর ধরেই দেশে নতুন বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়। এসএমই খাতের কিছু ঋণ বিতরণ ছাড়া জনতা ব্যাংকের নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। পরিস্থিতির বিচারে কিছু বড় শিল্প গ্রুপের ঋণসীমা বাড়ানো হয়েছে। তবে জনতা ব্যাংকের গ্রামাঞ্চলের গ্রাহকরা আগের চেয়ে বেশি অর্থ পরিশোধ করছেন। এতে এসএমই ও কৃষি খাতের ঋণ থেকে আমাদের মুনাফাও বেড়েছে।