রাজধানীতে বছরের সব সময়ই কমবেশি চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তবে সম্প্রতি ঢাকা শহরের ১৫টি স্পটে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের দেওয়া তথ্য বলছে, গত বছরে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ১ হাজার ৩৪৩টি। আর চলতি বছরের গত ৯ মাসে ঘটেছে ১ হাজার ২৮০টি। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে হাজারের বেশি ছিনতাইকারী।
হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর রাজধানীতে চুরি-ছিনতাই বেড়েছে। ভুক্তভোগীদের এসব ঘটনায় পুলিশ রের্কড না করায় এই প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ছিনতাইয়ের পরে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করায় অপরাধীরাও থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। চুরি ও ছিনতাইয়ের বড় কোনও ঘটনা না ঘটলে বিষয়গুলো সামনেও আসে না বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তবে এ বছর ছিনতাইয়ের ঘটনা নাড়া দিয়েছে চিকিৎসক বুলবুল আহমেদ হত্যার পর।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে কয়েকভাবে ছিনতাই হয়। তবে এরমধ্যে যারা একেবারে নিয়মিত ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত, তারা বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার পরিচয় দিয়ে অপরাধগুলো করে। এরা আগে থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে একজনের পেছনে কাজ করতে থাকে, পরে সুযোগ মতো স্থানে পেলেই সর্বস্ব লুটে নেয় তারা। ঘটনা ছোট-বড় যাই হোক না কেন, সেটাকে থানায় জানিয়ে মামলা রেকর্ড থাকলে একদিন আগে কিংবা পরে যাই হোক; অপরাধীকে আইনের আওতায় আসতেই হবে বলেও উল্লেখ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
গত রবিবারই (৩০ অক্টোবর) উত্তরার রাজলক্ষী ফুটওভার ব্রিজ থেকে নামার সময় ছিনতাইয়ের শিকার হন অ্যাডভান্স পোল্ট্রি ফার্ম নামে একটি কর্মচারী ইছাহাক আলী। তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আমি টাকা ভর্তি ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানাধীন ৩ নং সেক্টরে যাচ্ছিলাম। টাকাগুলো সেখানে কুশল সেন্টারের ৩য় তলায় অবস্থিত ইসলামী ব্যাংকে জমা দেওয়ার কথা ছিল। ৪ নং সেক্টর থেকে রাজলক্ষী ফুট ওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় ব্রিজের পশ্চিম পাশের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় এক ছিনতাইকারী আমাকে পেছন দিকে থেকে ধাক্কা দেয়।’ মুহূর্তের মধ্যে পেছন ফিরে তিনি দেখেন ব্যাগের ডান পাশ ব্লেড দিয়ে কাটা। তিনি বলেন, ‘সঙ্গে সঙ্গে আমি ছিনতাইকারী হাত ধরে ফেলি। এসময় ছিনতাইকারী আমার সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করে। এক পর্যায়ে আমি চিৎকার শুরু করলে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে এসে ছিনতাইকারীকে আটক করে। এসময় ছিনতাই করা ৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।’
ইছাহাক আলী বলেন, ‘অনেক সময় খবরে দেখি রাস্তাঘাটে ছিনতাইয়ের ঘটনা। আর আজকের দিন-দুপুরে রাস্তায় ভরা মানুষের মধ্যে আমার ব্যাগ কেটে টাকা নিয়ে যাচ্ছিল। ওই ঘটনার পরে আমি অফিসে গিয়ে কাজ সেড়ে বাসায় চলে আসি। আমি এখনও ঠিক মতন কারও সঙ্গে গুছিয়ে কথা বলতে পারছি না। যেন আমি ট্রমার মধ্যে চলে গেছি।’ এর আগে গত মাসে খলিল হাওলাদার নামে এক ভুক্তভোগী ভোরে সকালে ভুলতা-গাউছিয়া মার্কেটে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন। বিশ্বরোড বিআরটিসি বাস কাউন্টার থেকে বাসে ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। এসময় একটি শেয়ারিং সিএনজি অটোরিকশায় উঠলে কিছু পথ যাওয়ার পর অন্য যাত্রীরা তার হাত-পা বেঁধে সব নিয়ে যায়। মূলত তারা ছিল একটি ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য।
খলিল হাওলাদার বলেন, ‘ওইদিন আমার সঙ্গে যা ঘটেছে। সেটা মনে পড়লে আমি একা বাসা থেকে বের হতে ভয় পাই। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কীভাবে। মাঝে মধ্যে ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখলে সারারাত ভয়ে আর ঘুম হয় না।’ ঢাকা শহরে পুলিশের একাধিক ইউনিটের পাশাপাশি র্যাব নিয়মিত ছিনতাই-চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ঢাকা মহানগর এলাকা ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ৭২টি। এই মামলাগুলোর আসামি হাজারেরও বেশি। এরমধ্যে একই আসামি একাধিকবারও গ্রেফতার হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, নিয়মিত ছিনতাইসহ প্রতারণার বিভিন্ন অভিযোগ আসে। রাজধানীতে বিশেষ করে কয়েকটা স্পটে ছিনতাইয়ের মত ঘটনা ঘটে বেশি। এই সব স্পাটের মধ্যে মতিঝিল ব্যাংক পাড়ায় বেশি অপরাধ করে পেশাদার চক্রটি। আর উত্তরা এয়ারপোর্ট, আজমপুর বাসস্ট্যান্ড ও সায়াদাবাদ-যাত্রাবাড়ী এলাকায় করে বিভিন্ন গাড়ির চালক-সহকারীরা।
মশিউর রহমান বলেন, তারা যাওয়া-আসার মধ্যে সুযোগ-সুবিধা মতো যাত্রী তুলে নিয়ে অপরাধগুলো করছে। তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনাও একটু কষ্টসাধ্য। কারণ অপরাধের কোনও আলামত থাকে না। এছাড়া পথিমধ্যে হওয়ায় ভুক্তভোগীরা কোন থানায় যাবে, কার কাছে বলবে; এই দোলাচালে আইনি সহয়তাই নেয় না। এরমধ্যে ফার্মগেট ও কাওরানবাজার ছোটখাটো যেটা ঘটে, সেটা এখানকার ফুটপথের হকাররাই বেশি করে থাকে।
চিহ্নিত ছিনতাই জোন: উত্তরা এয়ারপোর্ট, আব্দুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ড, আজমপুর বাসস্ট্যান্ড, কুড়িল বিশ্বরোড, ৩০০ ফিট, মতিঝিল ব্যাংকপাড়া, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, খিলগাঁও, বাসাবো, কমলাপুর, শাহবাগ, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও পুরান ঢাকার বেশ কয়টি এলাকা। তবে ছিনতাইয়ের তালিকায় থাকা গুলিস্তান এখন অনেকটাই ‘ছিনতাইমুক্ত’ বলে জানিয়েছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। রাজধানীতেই একটি চক্র বিভিন্ন পন্থায় অন্তত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে অপহরণ করে সর্বস্ব লুটে নিয়েছে। এমন অভিযোগে গত মাসে ওই চক্রর পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে ডিবি। পুলিশ আসামিদের রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখেছে, তাদের মধ্যে একজনের নামে ছয়টি আর বাকিদের নামে দুইটি করে মামলা আছে। এই মামলা তদন্তকারী ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, এই চক্রটি এত মানুষের সর্বস্ব লুটে নিলেও কেউ মামলা বা সাধারণ ডায়রি (জিডি) পর্যন্ত করেনি। একজন ব্যক্তি অফিসের চাপে পড়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা করায় চক্রটিকে আইনের আনা সম্ভব হয়েছে। সাধারণ মানুষ যদি ভুক্তভোগী হওয়ার পরে মামলা না করেন, তাহলে অপরাধীদের ধরা সম্ভব না। গত ২৩ অক্টোবর রাতে রিকশা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে জসিম উদ্দিন সড়কের মুখে ছিনতাইয়ের শিকার হন আকাশ রহমান। তিনি বলেন, তার রিকশাটি জসিম উদ্দিন সড়কের একটু যেতেই মোটরসাইকেলে করে আসা দুই ব্যক্তি ছোঁ মেরে মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যায়। আকস্মিক এমন ঘটনার শিকার হওয়ার বিষয়টি এখনও ভুলতে পারছি না। রিকশায় উঠলেই মনে হচ্ছে কেউ যেন পিছু নিয়েছে। এখন অনেক সময় রিকশায় উঠলেই পেছন ফিরে দেখি। এই যে ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, ডাক্তার দেখিয়েও ঠিক হয়নি।’ এরআগে গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের শিকার হন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী রাতুল। তিনি বলেন, ‘রিকশাযোগে ধানমন্ডি থেকে মোহাম্মদপুর যাচ্ছিলাম। শংকর এলাকা পার হওয়ার সময় একটি মোটরসাইকেলের পেছনের থাকা ব্যক্তি আমার ব্যাগ টান দিয়ে পালিয়ে যায়। একটু হলেই রিকশা থেকে পড়ে আরও বড় বিপদে পড়তে হতো।’ প্রতিমাসে ঢাকা মহানগরের অপরাধ পর্যালোচনা সভায় ডিএমপি এলাকায় মামলা থেকে শুরু করে সব বিষয় উঠে আসে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অপরাধের ধরন ও তা মোকাবিলার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ হয়ে কাজ করে গোয়েন্দা বাহিনী।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, রাজধানীতে পুলিশের তৎপরতায় ছিনতাই অনেকটা কমেছে। তবে চুরির ঘটনা ঘটছে বেশি। যেসব এলাকায় ছিনতাই বেশি হচ্ছে, সেসব এলাকাগুলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম এটা নিয়ে কাজ করছে। তবে রাজধানীর ছিনতাইয়ের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, যেসব এলাকায় গলি বেশি ও ক্যামেরা ব্যবহার কম সেসব এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ছিনতাই প্রতিরোধে গোয়েন্দা পুলিশ প্রায় ৭০টির মতো টিম পুরো ঢাকা শহরে দায়িত্ব পালন করছে। এরমধ্যেও দুয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তবে বেশিরভাগ মামলার আসামিদের গ্রেফতার করা হয়েছে। দুয়েকটি ঘটনায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা শিগগিরই তাদেরও গ্রেফতার করতে পারব। একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা কয়েকটি জোনে ভাগ করলেও মামলা ডিটেক্ট করেই ছিনতাইয়ের বিষয়ে জোর দিচ্ছি। ছিনতাইয়ের ঘটনায় অপরাধ বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা যখনই রিপোর্টেড হয়, তখনই আমরা বলছি ছিনতাই বেড়ে গেছে। কিন্তু অনেক চিন্তার ঘটনায় রিপোর্টার হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ছুরিকাঘাতে এবং মৃত্যু হওয়ার কারণে বেশি রিপোর্টেড হচ্ছে। তবে ছিনতাইয়ের ঘটনা কমবেশি সব সময়ই ছিল। তবে করোনার পরে এই ঘটনা একটু বেশিই ঘটেছে, কারণ মানুষ আর্থিকভাবে কষ্ট ছিল।
তিনি বলেন, এরিয়া বেছে ছিনতাই করে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপ। আর এই ছিনতাইকারীরা অধিকাংশই মাদকাসক্ত ও মাদক কেনাবেচায় জড়িত। তারাই এসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। তাদের পেছনে অনেক সময় স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তির ইন্দনে থাকে। এছাড়া তারা এমন কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছত্রছায়ায়ও করে থাকে। আর বড় বিষয় হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদক সেবনের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে এমন ছিনতায়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে।
এই অপরাধ বিশ্লেষক বলেন, আমাদের দেশে অপরাধীদের হাতে এত বেশি অবৈধ অস্ত্র চলে আসছে যে, মাদক কিনাবেচা টাকা ভাগাভাগিতে এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে। তবে প্রধান বিষয় হচ্ছে মাদকের সংশ্লিষ্টতাই ছিনতাই বাড়ে কমে। একই ছিনতাইকারী বছরে ঘুরেফিরে কয়েকবারই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছে এ বিষয়ে ফারজানা রহমান বলেন, ছিনতাইকারী বা দস্যুতার মামলার আসামিরা সহজেই জামিনে বেরিয়ে আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এসব অপরাধীদের বিপক্ষে শক্তিশালী এভিডেন্স (প্রমাণাদি) দেখাতে না পারায় থেকে সহজেই তারা মুক্ত হচ্ছে। আর বড় কথা হচ্ছে, ছিনতাইয়ের থেকে দেশে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটছে। যার কারণে এইসব ঘটনায় পুলিশ সুষ্ঠুভাবে তদন্তও করতে পারে না। এছাড়া অনেক মামলার চার্জশিটই পুলিশ জমা দেয় না। এসব দিক থেকে অনেক সময় শুরাহা না হওয়ায় কোর্ট তাদের যাবেন দিয়ে দেয়।
খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ছিনতাইকারীরা জেল থেকে বেরিয়ে আবার ছিনতাইয়ে জড়িত আর অন্যতম কারণ হচ্ছে, তাদের অন্য কোন কর্মে আগ্রহ বা সুযোগ না থাকাই তারা ঘুরেফিরে আবার সেই চিন্তায় জড়িয়ে পড়ছে। এসব দমনে এলাকাভিত্তিক সার্ভেন্সি বাড়ানো দরকার। পুলিশের সহযোগী হয়ে বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিং কাজ করে, তাদের ছিনতাইকারীদের দমনে কাজে লাগাতে হবে। কারণ একটি এলাকায় বিট পুলিশিং শক্তিশালী করলে সহজেই এরিয়া ভিত্তিক ছিনতাইকারীদের দমন করতে পারবে।- বাংলা ট্রিবিউন