শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২২ অপরাহ্ন

কবি নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে

ফয়সাল আহমেদ
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০২৩

‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী, এক হাতে রণতূর্য।’ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নির্যাস, এই চরণই যেনো কাজী নজরুল ইসলামের চেতনা এবং সমগ্র সাহিত্য সাধনার ‘মূলসূত্র’। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে নজরুলের চিন্তা-চেতনার দার্শনিক ভিত্তি নির্মিত হয়। নজরুল কবি হিসাবে ‘না প্রেমিক, না বিপ্লবী’ এমন ধারার নন। তিনি এমন উদ্দেশ্যবিহীন দর্শন নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের জগতে আসেননি, বরং তিনি সচেতনভাবে একইসঙ্গে প্রেমিক, একইসঙ্গে ‘বিপ্লবী’ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর শিল্প সাধনায়। নজরুলের প্রায় সকল সৃষ্টিকর্মের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, তাঁর মূল সুর তীব্রভাবেই একটি ধারাতেই প্রবাহিত হয়েছে প্রেম ও দ্রোহ। এই প্রেমেরে কবি, দ্রোহের কবি, আমাদের জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশাল যাত্রা আজ। একদিনের ভ্রমণ। বলা উচিত, কয়েক ঘণ্টার ভ্রমণমাত্র।
ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর এবং শেরপুরে বহুবার গিয়েছি। এই পথ মানে ত্রিশালের উপর দিয়েই যাওয়া। কিন্তু নামা হয়নি ত্রিশালে। ১৮ নভেম্বর, ২০২২। সকালে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে রওয়ানা হয়ে গেলাম বিদ্রোহী কবির শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে গাজীপুরে অবস্থানরত শ্রমিক বন্ধু বুলবুলকে ফোন দিই। সে সময় দিতে পারলে তাকে নিয়েই যাবো ত্রিশাল। বুলবুল জানায়, সে সময় দিতে পারবে। আমি সকাল ৯টায় কমলাপুর থেকে গাজীপুরগামী একটি বাসে চড়ে প্রায় ২ ঘণ্টায় পৌঁছাই গাজীপুর চৌরাস্তায়। শুক্রবার ছুটির দিন, তবুও জ্যাম। সড়ক এবং নগর উন্নয়নের জ্যাম।
আমি পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই বুলবুল চলে আসে। গাজীপুর চৌরাস্তার একটি রেস্তোরাঁয় আমরা সকালের নাস্তা সেরে রওয়ানা হয়ে যাই ত্রিশালের উদ্দেশ্যে। গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহগামী একটি লোকাল বসে চড়ে বসেছি। লোকাল মানে সেই পুরনো দিনের লোকাল বাস যেন! শ্লথগতির রেকর্ড করে চার লেনের মহাসড়কে এক ‘ভয়াবহ যাত্রা’ উপহার দিয়ে ২ ঘণ্টারও অধিককাল সময় লাগায় ত্রিশাল পৌঁছাতে। পথে পথে যাত্রী উঠিয়ে দেরী করায় একবার নয়, দুই দুই বার বস চালকের গায়ে হাত তোলে স্থানীয় ‘মাথাগরম’ কয়েকটি তরুণ। গায়ে হাত তোলার পরও চালক ও সহকারীরা পাল্টা গালাগাল দিয়ে পূর্বনির্ধারিত ‘যাত্রীসেবা’ অব্যাহত রাখে। গাড়ি বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘক্ষণ থেমে থেমে যেতে থাকে কারো কোনো কথার তোয়াক্কা না করে।
আমার ও বুলবুলের সিট পড়ে একদম শেষে। কথা হয় আগাম অবসর নেয়া একজন সেনাবাহিনীর সার্জেন্টের সঙ্গে। পরিবার পরিজন নিয়ে তিনি মাওনা যাচ্ছেন। সম্ভবত তাদের কোনো আত্মীয় বাড়ি যাচ্ছেন। দেশ ও সমাজ নিয়ে নানা কথা হয়। সব মিলিয়ে তিনিও কোনো আশার আলো দেখছেন না! জানি না, তিনিও হয়তো বঞ্চিতদের দলে! তাই এমন হতাশা?
আমরা এখন ত্রিশালে। বিদ্রোহী কবির শৈশবের ক্ষণকালের স্মৃতিধন্য ত্রিশালে। কবি নজরুল ইসলাম এমন একজন কবি যিনি একইসঙ্গে লিখেছেন বিচিত্র রকমের কবিতা, বিচিত্র বিষয় নিয়ে আশ্চর্য সুন্দর সুন্দর সুর ও বাণীর সঙ্গীত। লিখেছেন গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ। শিল্পসাধনার বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিসম্ভারের সাথে তার জীবনের বৈচিত্র্য এবং জীবনের অনিশ্চয়তাও বিস্মিত করে আমাদের। এত বৈরী পরিবেশে কী করে টিকে থাকলেন কবি? অবশ্য শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন এক ধরণের জীবন্মৃত হয়ে। বিচিত্র পেশা, ভারতবর্ষের নানা স্থানে অবস্থান, ব্যক্তিগত জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পাড়ি দেয়া কবি কাজী নজরুলের শৈশশের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলা। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় পুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করলেও বাংলাদেশের ত্রিশাল ছাড়াও যৌবনের স্মৃতিতে উজ্জ্বল কুমিল্লার বিভিন্ন স্থান। এছাড়া মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদার বাড়িটিও কবির স্মৃতিবহুল স্থান।
আমরা জানি, কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম, বেড়ে ওঠা, শৈশব, কৈশর ও যৌবনের নানা চড়াই-উৎড়াই এবং তাঁর ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মেতে ওঠার রহস্যের মধ্যে নজরুল মনীষার বীজ রোপিত। ১৮৯৯ সালে অতি সাধারণ একটি দরিদ্র নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারে নজরুলের জন্ম। ১৯০৮ সালে পিতার অকাল মৃত্যুর কারণে পরিবারের দারিদ্র্য আরো প্রকট হয়। তখন নজরুলের বয়স মাত্র ৯ বছর। গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন কিন্তু পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। প্রথমে ঐ মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর মাজারের খাদেমের কাজ, মসজিদে মুয়াজ্জিনের চাকরি, পরবর্তীতে একটি রুটিন দোকানের কর্মচারী কতো বিচিত্র পেশাতেই না যুক্ত হয়েছেন তিনি! ১৯১০ সালে যোগ দেন গ্রামে-গঞ্জে নৃত্যগীতের মাধ্যমে বিনোদন প্রদানকারী গানের সংগঠন ‘লেটোর দলে’। এখানেই তাঁর সঙ্গীত ও কাব্যপ্রতিভার প্রথম প্রকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারা তাঁর মধ্যে প্রবাহিত ছিলো। কারণ তাঁর চাচা কাজী বজলে করিম তৎকালীন সময়ে লেটোর দলের জন্য গান রচনা করতেন। চাচা আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি লেটোর দলের ‘ওস্তাদ’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এরপর নজরুল ইসলাম লেটোর দল ছেড়ে আবারে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পড়াশোনার জন্য এই পুনঃপ্রচেষ্টা বেশিদিন অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। দারিদ্র্যের কারণেই তাঁকে অনেক পেশা বদল করতে হয়েছে। ফলে এক ধরনের অস্থির চিত্ততার মধ্যে তিনি বড়ো হয়েছেন। দারিদ্র্য তিনি কাছে থেকে দেখে এর ‘স্বরূপ’ খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। দারিদ্র্যকে তিনি যতই ‘মহান’ বলুন, আর এই দারিদ্র্য তাকে যতোই ‘খ্রিস্টের সম্মান’ দিয়েছে বলে কবিতায় ঘোষণা করুন, শেষ পর্যন্ত তিনি চেয়েছেন শোষণ ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি ভারতবর্ষ যা খুবই তীব্রভাবে এসেছে তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। এই দারিদ্র্যের তীব্র বেদনা তিনি সারাজীবন অনুভব করেছেন ভারতবর্ষের মানুষের মানবেতর ও ব্যর্থ জীবন যাপন অবলোকনের মাধ্যমে। এই দারিদ্র্যকে নজরুল অস্থি-মজ্জায় চিনেছেন নিজের জীবনের দারিদ্র্যের ভয়াবহ কষাঘাতের মাধ্যমেও। কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলেন ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ বলে। শুধু তাই নয়, ‘ভূ-লোক, দ্যুলোক গোলক’ অতিক্রম করে খোদার আসন ‘আরশ’ দীর্ন করে তাঁর এই ডাক তিনি মহাবিশ্বে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। তিনি নতজানু, হতাশ, ক্লান্ত মানুষের কাছে এমন দীপ্ত ঘোষণা, একই সাথে একটি নতুন যুগের, নতুন স্বপ্নেরও সূচনা করতে চেয়েছেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য তিনি প্রয়োজনে ‘নৈরাজ্যবাদী’ হতেও প্রস্তুত। তাইতো তিনি ঘোষণা করতে পারেন, ‘আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন,আমি ধ্বংস!’ অবশ্য যতই নৈরাজ্যিকভাবে, তীব্র স্বরে উচ্চারণ করুণ না কেনো তিনি তাঁর ‘তাল লয়’ হারাননি, নিজের সম্পর্কে যে তিনি সচেতন সে কথাটিও আমাদের জানিয়ে দেন এভাবে: ‘আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।’
এমন আশ্চর্য দ্রোহের বাণী, এমন বিস্ময়কর ছন্দবদ্ধ প্রকাশ বাঙলা কবিতায় একেবারে অভিনব। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আশ্চর্য কুশলতায় হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের বহু মিথের ব্যবহার করেছেন। কোরান-পুরাণ থেকে নেয়া শব্দের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার বাঙলাভাষার আর কোনো কবিতায় দেখা যায়নি। তীব্র ও অগ্নিঝরা কথায় এসেছে বিপ্লবী চেতনার কথা। চটুল, চিত্ত-চাঞ্চল্য উদ্রেককারী কথা যেমন এসেছে, একইসঙ্গে এসেছে গভীর মননশীলতার কথা। বর্তমান বাস্তবতার নিরেট বর্ণনা যেমন এসেছে, ভবিষ্যতের সুন্দর দিনের আকাঙ্ক্ষাও বর্ণিতি হয়েছে কবিতায়। সব মিলিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সত্যি এক বিস্ময়কর সৃষ্টি! অভূতপূর্ব নির্মাণ! কাজী নজরুল ইসলাম ভালো করেই জানেন, এভাবে বিদ্রোহ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। নিজের বুকের ভেতরে লালন করা এমন অন্তর্ভেদী বিদ্রোহের ডাক কেবল তাঁর মত নিঃসঙ্গ কবির পক্ষেই সম্ভব। বাস্তবিকই তিনি একা এবং নিঃসঙ্গ এক পরিব্রাজক। তাইতো কবিতার শেষ চরণে, বুকে বিপ্লব ও বিদ্রোহের তীব্র স্পন্দন নিয়েই তাঁকে বলতে হয়: ‘আমি চির-বিদ্রোহী বীর বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির ॥’
নজরুল কাজীর সিমলা নামক স্থানের দারোগা বাড়িতে তিনি শৈশবের কিছু সময় কাটিয়েছেন। এছাড়া ত্রিশালের বিচ্যুতিয়া ব্যাপারী বাড়িতেও কিছুদিন জায়গীর ছিলেন। পড়েছেন ত্রিশালের দরিরামপুর প্রাইমারী স্কুলে। সবমিলিয়ে তিনি ত্রিশালে কাটিয়েছেন শৈশবের মাত্র ১ বছর। কিন্তু ত্রিশালবাসী নজরুলের স্মৃতিকে ধরে রাখতে এখানে নজরুলের নামে প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করে বিদ্রোহী কবির নামের একটি চমৎকার আবহ সৃষ্টি করে রেখেছেন। বলা যায়, বাংলাদেশে নজরুলের নামে এবং নজরুল সম্পর্কিত স্থান সবচাইতে বেশী এই ত্রিশালে।
আমি ও বুলবুল ত্রিশাল বাস্ট্যান্ড থেকে একটি রিকশা নিয়ে চলে আসি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর। এখানে কবির নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখতে পাই। পাশে একটি খোলা মাঠে রয়েছে দুখুমিয়া বিদ্যা নিকেতন। কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ব্যাপারী বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রে। শুক্র ও শনিবার এবং সকল সরকারী ছুটিতে বন্ধ থাকে এই স্মৃতিকেন্দ্র। তাই ভেতরে আর ঢোকা হলো না। এখানে মূলত একটি গ্রন্থাগার ও কবির কিছু আলোকচিত্র রাখা আছে। সবই মনে হলো দায়সারা কাজ। আরেকটু গুছিয়ে জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থান সাজানো যেতো। এটি পরিচালনা করছে নজরুল ইনস্টিটিউট। এরপর আবার অটোরিকশায় চড়ে চলে আসি ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডে। এখানে এসে দুপুরের আহার সারি স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয়। খাওয়াপর্ব শেষে করে একটি সিএনজিতে চড়ে চলে আসি ৫-৬ কি.মি. দূরে কাজীর সিমলা নামক বাস স্ট্যান্ডে। এখান থেকে একটি অটোতে চড়ে গ্রামীণ পথ ধরে চলে আসি সেই ঐতিহাসিক দারোগা বাড়িতে। বেপারী বাড়ির মতোই এখানে একটি দোতলা সুরম্য ভবনে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র রয়েছে। যথারীতি এটিও পরিচালনা করছে নজরুল ইনস্টিটিউট। বলাবাহুল্য এই স্মৃতিকেন্দ্রও শুক্রবার বলে আজ বন্ধ। আমাদের অটোচালক জহিরুল অবশ্য এর লাইব্রেরিয়ান রাসেল হোসেনের পূর্ব পরিচিত। বন্ধের দিন রাসেল সাহেব একটু আয়েশ করে টিভি দেখছিলেন। রাসেল ভাই বন্ধের দিন সত্ত্বেও আমাদের গ্রন্থাগার এবং নজরুলের ব্যবহৃত একমাত্র স্মারক শোয়ার খাটটি দেখার সুযোগ করে দেন। নিজে দোতলায় গ্রন্থাগারে এসে অনেক কথা বলেন। তিনি জানান, যারা নজরুল নিয়ে গবেষণা করতে চান তাদের থাকারও ব্যবস্থা আছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে এখানে থেকে গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানকার গ্রন্থাগারের বইয়ের সংগ্রহ খুবই দুর্বল। যা গবেষণা কেনো, সাধারণ পাঠকের জন্যও হতাশাজনক। একেবারে গ্রামের ভেতর সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ব্যবহার করে বিচিত্র বইপত্র পড়া এবং শিল্প-সাহিত্য চর্চার কেন্দ্র হতে পারতো এই দুটি কেন্দ্র। ত্রিশালে বহু স্কুল, কলেজ এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও কম নয়। সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার বা জ্ঞানচর্চার উপযুক্ত নিশ্চিত না করে শুধুমাত্র তরুণদের দায়ী করা যায় না যে, এই সময়ের তরুণরা বই-পত্র পড়ে না। বইপড়া এবং শিল্পচর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকেই বড়ো উদ্যোগ নিতে হয়। একই রকম অবস্থা দেখেছি বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের পাবলিক গ্রন্থগার বা বিখ্যাত ব্যক্তির নামে গড়ে তোলা গ্রন্থাগারেও। কাজীর সিমলা থেকে আমরা আবার আসি ত্রিশালে। নজরুল ত্রিশালের দরিরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। আজ এখানে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে। খুবই জমজমাট অবস্থা। জেলা পরিষদের উদ্যোগে মাঠের সাথে সুন্দর একটি নজরুল মঞ্চ রয়েছে। একপাশে নজরুলে বড় একটি ম্যুরাল এবং আরেক পাশে নজরুলের সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখা রয়েছে। মাঝখানে মঞ্চ। মঞ্চে উপবিষ্ট স্থানীয় অতিথিরা। একজন মাইকে ফুটবল ম্যাচের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন। চৌধুরী শরাফতের মত না হলেও খোদা বক্স মৃধার মত মনে হচ্ছে ধারাভাষ্য বর্ণনা। ভদ্রলোক বেশ সরস এবং শ্রোতাদের জন্য উপভোগ্য হয় এমনভাবে খেলার বর্ণনা দিচ্ছেন। লোকটির ধারাভাষ্যের কারণেই আমি ও বুলবুল খানিকক্ষণ মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে খেলা উপভোগ করি। বুলবুল জানায়, সে নাকি একসময় খুবই চৌকষ খেলোয়াড় ছিলো। নাটোরে থাকাকালীন ‘হায়ারে’ খেলতে যেতো। আমি বলি বাহ, অনেক গুণ তোমার! আগে তো এর কিছুই জানতাম না। দেখো ভ্রমণে এলে কতোকিছুজানা যায়। আমি রসিকতা করি বুলবুলের সাথে।
বাস্তবেও অনেক গুণ নিয়েও জীবন সংগ্রামে থিতু হতে পারেনি বুলবুল। শুরুতে খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা, তারপর গার্মেন্টসে চাকরি, সেখানে টিকতে না পেরে অংশদারীত্বে ছোট্ট একটি খাবারের দোকান দেয়া, এরপর ঐ দোকানের অপর পার্টনারের টাকা মেরে দেওয়া, এখন আবার জীবন বীমা কোম্পানীতে অস্থায়ী কাজ করে যাওয়া এভাবেই চলছে বুলবুলের অনিশ্চিত জীবন। বুলবুল অনেক কষ্ট করে গানও শিখেছে। ভ্রমণ করা অবস্থাতে রিকশায় বসে, গাড়িতে বসে সে কয়েকটি গান গেয়ে শোনায় আমাকে। বুলবুলের মতো মানুষদের দিকে তাকিয়ে একটি কথাই মনে আসে, আমাদের সততার পরীক্ষা কোনদিনই শেষ হওয়ার নয়! অথচ মানুষ অসৎ হলে কত কিছুই পায়ের কাছে এসে পড়ে! অবশ্য সেই অসততা বা ভিন্নপথে হাঁটতে হলে প্রয়োজন হয় সীমাহীন চাতুর্য। এই দুটোর মেলবন্ধনে এই সমাজ তথাকথিত ‘সফল মানুষ’ তৈরী করে!
সন্ধ্যা হয়ে এলো। ফেরারও সময় হলো। ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড থেকে খানিকটা দূরে মহাসড়কের উপরেই একটি সুন্দর সাজানো গোছানো চায়ের দোকানে চা পান করি। এরপর ঢাকাগামী ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা ‘নামকরা’ একটি পরিবহনে ঢাকার পথ ধরি। এখানেও একই অবস্থা। যাত্রী তোলার বিরাম নেই। ভাড়া নিয়ে বচসা। পরিবহন সেক্টর যে মাফিয়াদের পূর্ণ দখলে তা এখন প্রতিনিয়তই অনুভব করি। মালিক-শ্রমিক-প্রশাসন চক্র মিলে যাত্রীদের উপর রীতিমত জুলুম করছে। বুলবুল গাজীপুর চৌরাস্তায় নেমে যায়। আমার পথ শেষ হতে বেশ সময় লাগে। পথে যেতে যেতে ডুবে থাকি কবি বিস্ময়কর নজরুল প্রতিভার হাজারো বিষয় নিয়ে। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে আমারই একটি লেখার বিষয়-ভাবনা মাথায় আসে। নতুন সভ্যতা, নতুন সমাজ বিনির্মাণ শ্রমজীবী ও সৃষ্টিশীল মানুষের সংগ্রামের পরম্পরার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মানুষের মুক্তির স্বপ্ন ও সংগ্রামের দীর্ঘ যাত্রাপথে বেঁচে থাকার ‘মূলমন্ত্র’ হয়ে টিকে থাকবে আরো বহুকাল এবং দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হবে:
‘মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।’-।। রাইজিংবিডি.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com