অনেক দিন ধরে ভোরে হাঁটি না। কারণ ঢাকার বাতাস আমার ও আমার বয়সীদের জন্য বিপজ্জনক। সতর্কবার্তা রয়েছে শিশুদের জন্যও। বছরব্যাপী ঢাকা মহানগরীর বায়ুমান ঝুঁকিপূর্ণ। কেবল বর্ষাকালে খানিকটা নির্মল বায়ু পান ঢাকাবাসী। মাঝে মধ্যে চেষ্টা করেছি খোলা বাতাসে চলতে। ফল সর্দি-কাশি, মাথাধরা, মাথাঘোরা। বাধ্য হয়ে সারা বছর মাস্কে মুখ লুকিয়ে চলি। বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, ঝাপসা দেখা, উচ্চ রক্তচাপ, খিটখিটে মেজাজ, নিদ্রাহীনতা এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকেন বয়স্করা। শ্বাসকষ্ট, দুর্বল স্মরণশক্তি, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, শারীরিক ও মানসিক বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে শিশুদের।
দুই কোটি জন অধ্যুষিত ঢাকার পরিবেশ ও বায়ুমান নিয়ে হাইকোর্ট কয়েকবার স্বপ্রোণোদিত রুলিং দিয়েছেন। অবস্থার উন্নতির পরিবর্তে আরো অবনতি হয়েছে। রাস্তায় কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ বা সার্জেন্টের সামনেই অহরহ চলছে গাড়ি। পুলিশ ধরছে না বা খেয়াল করছে না। কারণ এসব গাড়ির মালিক বা চালকের হাত এত লম্বা যে, সবাই ভয় পায়। এর ওপর শুকনো মৌসুমে নগরীকে তিলোত্তমা বানানোর প্রতিযোগিতায় নামে নানা সংস্থা, অধিদফতর, পরিদফতর। এই প্রতিযোগিতায় ধূলিময় হয়ে ওঠে নগরীর পরিবেশ। বিষাক্ত পদার্থে ভরে যায় বাতাস। শ্বাস নেয়ার মানে থাকে না। এসব কথা ভাববার কেউ কি আছেন? হাইকোর্টের নির্দেশনা যেখানে উপেক্ষিত ও যারা উপেক্ষা করার সাহস দেখান তাদের অবশ্য বাহবা দিতে হয়। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে যারা দায়মুক্ত হতে চান; তাদের দায়বোধ এবং কর্তব্যপরায়ণতা, আইনের প্রতি সম্মানবোধের ব্যাপারে প্রশ্ন জাগে বৈকি! কয়েক বছর আগে বিশ্বাস সাস্থ্য সংস্থার অনুকূলে পরিচালিত জরিপে ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি কারণ নির্ণীত হয়েছিল। কারণগুলো ছিল গাড়ির কালো ধোঁয়া, অপরিকল্পিত, অসময়োপযোগী খোঁড়াখুঁড়ি ও ইটভাটা। এর কোনোটাই যে কমেনি এর প্রমাণ খুঁজতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে না। ঢাকার রাস্তায় ক্ষণিক হাঁটলে দেখবেন সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সড়ক বিভাজকের ২০-২৫ বছরের পুরনো গাছ কাটতে ব্যস্ত বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহল। অথচ প্রতিটি গাছ এক একটি অক্সিজেন তৈরির কারখানা। যার অভাবে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। বায়ু দূষিত হয়ে শ্বাস গ্রহণের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বছরজুড়ে নতুন নতুন বাড়ি নির্মাণের যে রাজসিক আয়োজন কোনোরকম সাবধানতা ছাড়া, তা দেখলে অবাক হতে হয়। নির্মাণের বালু, চুন-সুরকির আস্তরণ আশপাশের পরিবেশে যে অবস্থা সৃষ্টি করে তা দেখার কেউ নেই। হাইকোর্টের নির্দেশনায় শেষ পর্যন্ত টনক নড়ে পরিবেশ অধিদফতরের। অভিযানে গোটা দশেক গাড়ি আর প্রায় গোটা বিশেক রিকশাকে জরিমানা করে নিজেদের কর্মদক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে তারা। ঢাকা বায়ুদূষণের জন্য দায়ী রিকশা এবং মাত্র কয়েকটি গাড়ি! হাইকোর্ট ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পরিবেশ উন্নয়নে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন ঢাকা সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স ও পরিবেশ অধিদফতরের কাছে। ফল শূন্য। এখানেও অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা।
দিনের বেলা শহরের বর্জ্য অপসারণ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, নতুন বাড়িঘর নির্মাণ, গাড়ির কালো ধোঁয়া, অতিরিক্ত যানবাহনে সৃষ্ট যানজটে নির্গত গাড়ির ধোঁয়া সব মিলিয়ে শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছে ঢাকা মহানগরীর বাসিন্দাদের। বর্জ্য অপসারণ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ রাতে করার কথা থাকলেও অজানা কারণে তা হচ্ছে না। দিন দিন রাস্তায় কত গাড়ি বাড়ছে তার হিসাব কেউ রাখেন বলে মনে হয় না। এখানে জনগণ অসহায়। জনস্বার্থ উপেক্ষিত। সব কিছু দেখে মনে হয়- ‘ধুলাবালি মশা মাছি এই নিয়ে ঢাকায় আছি।’ দ্রুত সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। জরুরিভাবে কালো ধোঁয়া ছাড়া গাড়ি বন্ধ করা দরকার। বন্ধ করা দরকার যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। গাছ কাটা অবিলম্বে বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। বন্ধ করা জরুরি অনুমতিবিহীন ইটভাটা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, পরিবেশ অধিদফতরের নাকের ডগায় অবৈধ ইটভাটার রমরমা ব্যবসা চলে। প্রতিদিন বায়ুমান নির্ণয়ের এবং তা জনগণকে নিয়মিত জানাবার ব্যবস্থা করা দরকার, যেন সবাই তাদের কাজের জন্য আগে পরিকল্পনা করতে পারেন। শুধু জরিমানা নয়; যেসব গাড়ি বায়ুদূষণে দায়ী এগুলোর মালিক ও চালকদের ব্যবসায়িক ও চালক লাইসেন্স বাতিল করা দরকার। জনগণকে পরিবেশ দূষণ এবং বায়ুমান সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এজন্যে প্রয়োজন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা। বছরে তিন থেকে চারবার পরিবেশ সম্পর্কিত র্যালি, পোস্টার, ব্যানার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা গেলে জনগণের সচেতনতা বাড়বে।
ঢাকা শহরে গাড়ির সংখ্যা সীমিত করা জরুরি। হাইকোর্টের নির্দেশনায় ইদানীং কিছুটা হলেও কমেছে রাস্তায় ধোঁয়া নিঃসরণকারী গাড়িবহর। রাজধানীর রাস্তাগুলো চলার উপযোগী হয়েছে। এটা এতদিন হয়নি কেন তা জনমনে জিজ্ঞাসা। যাদের দায়িত্ববোধের অভাবে নগরবাসীর স্বাস্থ্যক্ষতি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়ে কর্মঘণ্টা নষ্ট, অযথা তেল পুড়িয়ে জ্বালানির অপচয় এবং বায়ুদূষণের কারণ তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার কিনা ভাবার বিষয়। গাড়ির ফিটনেস দেয়ার ক্ষেত্রে বিআরটিএর দায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাবধানতা জরুরি। লাইসেন্স দেয়ার সময় পরিবেশ দূষণ, কালো ধোঁয়ার কুফল এসব ব্যাপারে চালকদের সচেতন করার ব্যবস্থা নিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিদেশী সহায়তা চাচ্ছে। নির্মল বায়ু, বিশুদ্ধ পরিবেশ এর অন্যতম প্রধান শর্ত। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য এ ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ অপরিহার্য। লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ,ঊসধরষ- ংযধয.ন.রংষধস@মসধরষ.পড়স