ইহুদিরা নীতিগতভাবে সেই দ্বীন ইসলামের অনুসারী ছিল, যার শিক্ষা হজরত মুহাম্মাদ সা: প্রচার করেছিলেন; কিন্তু বহু শতাব্দীর-কালের ক্রমাগত পতন ও অবনতির ফলে তারা আসল দ্বীন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তাদের আকিদা-বিশ্বাসের মধ্যে বহু অনৈসলামিক বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তাওরাতের কোনো ভিত্তি ছিল না। তাদের কর্মজীবনে এমন অসংখ্য রীতিনীতির প্রচলন ঘটেছিল যথার্থ দ্বীনের সাথে যেগুলোর কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাওরাতের মূল বিষয়বস্তুর সাথে এগুলোর কোনো সামঞ্জস্য ছিল না। আল্লাহর কালাম তাওরাতের মধ্যে তারা মানুষের কথা মিশিয়ে দিয়েছিল। শাব্দিক বা অর্থগত দিক দিয়ে আল্লাহর কালাম যতটুকু পরিমাণ সংরক্ষিত ছিল তাকেও তারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিকৃত করে দিয়েছিল। দ্বীনের যথার্থ প্রাণবস্তু তাদের মধ্য থেকে অন্তর্নিহিত হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের এ বিকৃতির প্রতি তাদের আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যার ফলে কোনো প্রকার সংস্কার-সংশোধন গ্রহণের তারা বিরোধী হয়ে ওঠে। যখনই কোনো আল্লাহর বান্দা তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের সরল সোজা পথের সন্ধান দিতে আসতেন তখনই তারা তাকে নিজেদের সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে সম্ভাব্য সব উপায়ে তার সংশোধন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যেত। এরা ছিল আসলে বিকৃত মুসলিম। দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি, দ্বীনবহির্ভূত বিষয়গুলোর দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি, দলাদলি, বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে মাতামাতি, আল্লাহকে ভুলে যাওয়া এবং পার্থিব লোভ-লালসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে তারা পতনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি তারা নিজেদের আসল মুসলিম নামও ভুলে গিয়েছিল।
মদিনায় যখন কোনো ইহুদি ছিল না তখন আউস ও খাজরাজ নামক দুই আরব গোত্র মদিনায় বসবাস করত। এরকম সময় কিছু ইহুদি মদিনায় এসে বলল, আমরা নদীভাঙা মানুষ কোনো জায়গায় নেই, একটু জায়গা দিলে তাঁবু গেড়ে শহরের উপকণ্ঠে বসবাস করব। আপনাদের কাজকর্ম করব। এভাবে তারা বসবাস শুরু করল। একদিন পরিকল্পিতভাবে আউস ও খাজরাজের দুই ইহুদি শ্রমিক মারামারি করল এবং নিজেদের মালিকের কাছে গিয়ে অন্য গোত্রের বিরুদ্ধে ইন্ধন জোগাতে লাগল। এর ফলে দুই গোত্রই যুদ্ধে লিপ্ত হলো। এই যুদ্ধ দীর্ঘ ৪০ বছর চলল, যা ইতিহাসের পাতায় হারবুল জাসুস নামে পরিচিত। ইহুদিরা অস্ত্র বানাতে পারদর্শী ছিল। দুই গোত্রই যেহেতু যুদ্ধের কারণে লেনদেন থেকে বিরত ছিল তাই তারা আস্তে আস্তে নগদ টাকা দিয়ে অস্ত্র কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলল এবং ইহুদিদের থেকে সুদের ওপর অস্ত্র কিনতে কিনতে একটা সময় বিশাল অঙ্কের ঋণী হয়ে গেল, যা ইহুদিদের জন্য মহা সুযোগ ছিল এবং ইহুদিরা মদিনাবাসীর জায়গায়গুলো নিয়ে গেল। এখন ইহুদিরা মালিক আর আউস ও খাজরাজ গোত্র তাদের প্রভাবাধীন হয়ে গেল। উপরের আলোচনা থেকে কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত-
১. নিজেদের বিকৃতির ফলে সত্যান্বেষীদের তারা শত্রু মনে করত।
২. তারা বিকৃত মুসলিম ছিল এবং ধর্মের বিকৃতি ঘটিয়েছে।
৩. গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করত।
৪. পার্থিব লোভ-লালসা তাদের পতনের কারণ।
৫. সর্বোপরি, ডিভাইড অ্যান্ড রুল, বিভেদ ও ঝগড়া বাধিয়ে দাও তারপর মাঝখানে প্রবেশ করো।
এবার দেখা যাক ইহুদিদের বৈশিষ্ট্যের সাথে বর্তমানে আমাদের কতটুকু মিল আছে- বর্তমানে আমাদের এ সমাজে যারাই সঠিক পথের আহ্বান করে আমরা তাদেরই বয়কট করি, তাদের ঘৃণা করি। আমরা তাদের গ্রহণ করলে যদি আমাদের ভুলগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ে এই ভয়ে। ইহুদিরা যেভাবে তাদের ধর্মের বিকৃতি ঘটিয়েছে আমরাও কি তাই করছি না?
পশ্চিমাদের সংস্কৃতি অনুসরণ করতে করতে সেগুলোকে আমরা আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছি। যার ফলে আমাদের ধর্ম ইসলামের বিকৃতি ঘটছে। মিডিয়ার দিকে লক্ষ করলেই বোঝা যায় আমরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ে আলোচনা করতে পারি। গুরুত্বপূর্ণ খবর রেখে আমরা দেখি কোন সুপারস্টারের গোপন প্রেমের খবর প্রকাশ পেয়েছে, কে মাতলামি করে সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, আর সমাজে কে কোন টুপি পরবে, পাঞ্জাবি গোল না কাটা, আমিন আস্তে বলবে না জোরে, আমাদের কাছে এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ।
এসব ঝগড়াবিবাদ ইহুদিরা আমাদের মধ্যে কৌশলে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে। দলাদলি, হানাহানি যেগুলোর বিচার বহির্বিশ্বের মধ্যস্থতায় সমাধান করা হয়। মানে সমস্যা আমাদের সমাধান করবে মিত্র দেশ বা আন্তর্জাতিক মহল। পার্থিব লোভ-লালসা তো বর্তমানে এমন পর্যায়ে আছে যে, আমরা বুঝতেও পারি না কোনটি পার্থিব আর কোনটি অপার্থিব। আমরা ভাবছি এগুলোই আমাদের প্রয়োজন। যার ফলে সেগুলোর ভূমিকা কী আমাদের জীবনে তা আমরা ভাবার প্রয়োজনবোধ করি না। আর এগুলোর জন্য আমরা খুনাখুনির মতো জঘন্য অপরাধও করতে পিছুপা হই না।
ইহুদিদের সাথে যে আমাদের মিল রয়েছে তা আমরা উপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারছি। একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে- ‘এটিও ইতিহাসের শিক্ষা যে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না’। আমরাও যে পতনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। যুগে যুগে মানুষ ধ্বংস হয়েছে একমাত্র তাদের প্রতারণার কারণে, তাদের বাড়াবাড়ির কারণে; কিন্তু আমরা সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না।