সব হারানো ব্যবসায়ীদের আহাজারিতে ভারী আকাশ বাতাস
প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা জ্বলে, কয়েকটি মার্কেটের কয়েকশ দোকান পুড়িয়ে অবশেষে নিয়ন্ত্রণে এসেছে বঙ্গবাজার মার্কেটের আগুন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। শেষ পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও আশপাশের মার্কেটে লাগা আগুনও নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। সকাল ৬টা ১২ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তাদের সহযোগিতায় সকাল থেকেই কাজ করেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছেন পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যরা।
গতকাল মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) ভোর ৬টায় আগুন লাগার পর থেকে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠেছে আকাশ-বাতাস। একদিকে ধোঁয়া, আরেকদিকে মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে বঙ্গবাজার এলাকার পরিবেশ। হতাশা নিয়ে জহির নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমার কেনা দুইটা দোকান ছিল। ৪০ লাখ টাকার ইনভেস্ট ছিল। ২৪ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করে আসছি। আজ আমার সবকিছুই শেষ।
চোখের সামনে পুড়ছে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে টিকে থাকার ও একমাত্র উপার্জনের উৎস। দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের। হতাশা, ক্ষোভ, আর্তনাদ প্রকাশ ছাড়া নিরুপায় তারা। খবর শুনে ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি দেখে একজন হার্ট অ্যাটাকও করেন। তাকে নেওয়া হয়েছে হাসপাতালে।
ব্যবসায়ী ইসমাইল বলেন, বঙ্গবাজারে আমাদের বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। আমার শ্বশুরের দোকান রয়েছে। আগুন লাগার খবর পেয়ে আমরা তাড়াতাড়ি বঙ্গবাজার চলে আসি। এসে পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে আমার শ্বশুরের হার্ট অ্যাটাক হয়। আমাদের বংশ পরম্পরায় ব্যবসা এই বঙ্গবাজারে। সবই পুড়ে শেষ।
আগুনের কারণে ধোঁয়া মিলেমিশে অন্ধকারচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হয় বঙ্গবাজার ও গুলিস্তানের আকাশে। যদিও আগুন লাগার পর থেকে ওই এলাকায় বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ। তারপরও আগুনের তীব্রতায় ট্রান্সফর্মার কিংবা এসি বিস্ফোরণের শঙ্কা প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ী শফিক দেওয়ান বলেন, আমার ১৭ লাখ টাকার মালামাল ছিল, দুটি দোকান ছিল। সবই এখন ছাই হয়ে গেছে। আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের পানির স্বল্পতাও আমরা দেখতে পেয়েছি।
ব্যবসায়ী মাহিদ বলেন, আমার একটি দোকান ছিল। পাঁচ লাখ টাকার মালামাল ছিল দোকানে। আমার আত্মীয়-স্বজনের দোকান ছিল। সবার দোকান শেষ হয়ে গেছে। সবাই এখন নিঃস্ব। এই দোকান এই ব্যবসা আমাদের আয়ের একমাত্র উৎস ছিল। এখন সবকিছুই শেষ।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত ৪৮টি ইউনিট কাজ করছে। উৎসুক জনতার ভিড় এবং পানি স্বল্পতার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে কিছুটা বেগ পেতে হয়। মল্লিকা গার্মেন্টসের মালিক মালিক নূর আলম জানান, তার দুটি দোকানে অর্ধ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। নগদ আট লাখ টাকা ছিল ক্যাশ বাক্সে। গত ২২ বছর যাবত তিনি বঙ্গবাজারে ব্যবসা করছেন।
ঈদের আগে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে নিঃস্ব: বঙ্গবাজারের জিন্সের ব্যবসা করেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, করোনার পর ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিনিয়োগ করেছিলাম বড়। কিন্তু সব পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। লাখ লাখ টাকার মালামাল, দোকানে ক্যাশ টাকাসহ অনেক ক্ষতি। বঙ্গবাজার টিনশেড মার্কেটের আর এস ফ্যাশনের মালিক আব্দল মান্নান বলেন, ‘আমার দোকানের সব পুড়ে শেষ। আমি এমন আগুন জীবনেও দেখিনি। কীভাবে কী হয়ে গেলো।
নাশকতার অভিযোগ: গতকাল মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সামনে বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির দফতর সম্পাদক বিএম হাবিব অভিযোগ করেন, জমি ফাঁকা করার জন্য অগ্নিসংযোগ বা নাশকতার ঘটনা হতে পারে এটা। দীর্ঘদিন একটি মহল অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। মার্কেটের ভেতরে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্যাস ছিল। কিন্তু সকাল বেলা হওয়ায় ব্যবহার করা যায়নি।
বিএম হাবিব জানান, অন্তত ছয়টি মার্কেটে আগুন লেগেছে। এর মধ্যে বঙ্গ মার্কেটের আওতায় চারটি মার্কেটে অন্তত কয়েক হাজার দোকান ছিল। এ ছাড়া ইসলামিয়া মার্কেট ও এনেক্সকো মার্কেটে আগুন লেগেছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, বঙ্গ মার্কেটে ২৯০০ দোকানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ কাজ করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তারা অনুরোধ জানান, ক্ষতি কাটাতে ও ব্যবসা করার জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করে দিন। আমরা সিটি করপোরেশননের বরাদ্দ পাওয়া মালিক। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা।
অগ্নিকাণ্ডের পর সঙ্গে আলাপকালে বঙ্গ মার্কেটের এক ব্যবসায়ী দাবি করেন, ঈদকে সামনে রেখে কোটি-কোটি টাকার মালামাল তুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এখন সবাই পথের ফকির। আমি নিজেও ছোট একটি ব্যবসা করি। দোকানে রাখা ছিলো অন্তত আড়াই লাখ টাকা। সব পুড়ে গেছে।
পুড়ে গেছে পাঁচ হাজার দোকান, ২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি
রাজধানীর বঙ্গবাজারে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ঘটনায় প্রায় ৫ হাজার দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন প্রাথমিকভাবে থোক বরাদ্দ হিসেবে সাতশ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি জানিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) দুপুরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে এ দাবি করেন তিনি। হেলাল উদ্দিন বলেন, এখনও ধ্বংসস্তূপে আগুন জ্বলছে। সব পুড়ে শেষ না করা পর্যন্ত এই আগুন জ্বলবে। আমাদের জানা মতে, শুধু বঙ্গবাজার কাঠের মার্কেটেই দোকান রয়েছে আড়াই হাজারের মতো। সামনে ঈদ। সবাই ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনার পণ্য তুলেছেন দোকানে। এমন সময় এই আগুন বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে এনেছে। তিনি আরও বলেন, এই ব্যবসায়ীদের পুঁজি বলতে সব শেষ। এখন তাদের জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, রমজানের ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসায় ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রাথমিকভাবে সাতশ কোটি টাকা থোক বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছি। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটের দিকে বঙ্গবাজারের এনেক্সকো মার্কেটের পাশের টিনশেড মার্কেটটিতে এই অগ্নিকা- ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ৬টা ১২ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
৭০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দের দাবি দোকান মালিক সমিতির
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কয়েকটি মার্কেটের প্রায় ৫ হাজার দোকান ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। আগুনে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে থোক বরাদ্দ হিসেবে সাতশ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। গতকাল মঙ্গলবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গণমাধ্যমকে এসে একথা বলেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, আমাদের জানা মতে, শুধু বঙ্গবাজার কাঠের মার্কেটেই আড়াই হাজারের মতো দোকান রয়েছে। এখানে ছোট ছোট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকান করেন। সামনে ঈদ। সবাই ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনার পণ্য তুলেছেন দোকানে। এমন সময় এই অগ্নিকাণ্ড বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে এনেছে। তিনি আরও বলেন, এই ব্যবসায়ীদের পুঁজি বলতে দোকানের মালামালই। মালামাল পুড়ে গেলে তাদের আসলে পুুুুঁজি বলতে সব শেষ। এখন তাদের জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, রমজানের ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসায় ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রাথমিকভাবে সাতশ কোটি টাকা থোক বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছি।
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত ১৭
রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, দোকান মালিক ও কর্মচারীসহ ১৭ জন আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচ জনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্নে ও ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে এই আগুনের ঘটনাটি ঘটে। আহত অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধার শেখ হাসিনা বার্নে ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। পাঁচজনকে ভর্তি করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মী মো. মেহেদী হাসান (৩৫) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্নের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নিলয় (২২), শাহীন (৪০), রিপন মিয়া (৩৬), রুবেল (৩২)কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নতুন ভবনের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। আর বাকি ১২ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তারা হলেন, শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ ইসরাফিল ইসলাম (৪০) ও র্যাব টু এর উপ-পরিদর্শক(এসআই) মোঃ জাহিদ (৪৭), ফায়ার সার্ভিস সদস্য আতিকুর রহমান রাজন (৩৫), রবিউল ইসলাম অন্তর (৩৮), মেহেদী হাসান (৩৫),দিদারুল হক (৩৬),বাবুল চক্রবর্তী(৫৮) (উপ-পরিচালক) দোকান মালিক ও কর্মচারীরা হলেন, দুলাল মিয়া (৬১), সোহেল (৪৮), সুমন মিয়া (৩৫), মিজানুর রহমান (৪৮), আশিক (২০), হাফিজুর রহমান (৪০)।