জমিতে উৎপাদিত মরিচ বাজারে এনে এখন আর দাম দর করতে হয় না কৃষকদের। জমিতে রেখেই স্মার্টফোনে ছবি উত্তোলন করে ফেসবুক এবং ওয়াটসঅ্যাপে আড়ৎদারকে প্রেরণ করেন কাঁচা মরিচের ছবি ও ভিডিও। আড়ৎদার কিছু ছবি ও ভিডিও ফুটেজ পাঠান বিভাগীয় শহর সিলেট ও রাজধানীর কাওরানবাজারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সব্জি আড়তে। এরপর দাম দর সাব্যস্ত করেন আড়তদার ও মরিচ চাষিরা। শেষে ক্ষেত থেকে মরিচ উত্তোলন করে আড়তে দেন কৃষকরা। আড়ৎদার তাৎক্ষণিকভাবেই ট্রাকে করে মরিচ পাঠিয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন অঞ্চলে। তাতে কৃষক যেমন ন্যায্য দাম পাচ্ছেন তেমনি আড়ৎদাররা লাভবান হচ্ছেন।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ ও সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর সুরমা ও রঙ্গারচর ইউনিয়ন থেকে এই মৌসুমে প্রতিদিন ১৫/২০ ট্রাক মরিচ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আগামী ঈদুল ফিতর পর্যন্ত দেশে কাঁচা মরিচের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক।
জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের মান্নানঘাট বাজারের হারুন মার্কেটে সবচেয়ে বড় সবজির আড়ৎদার জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি জানান, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ মন মরিচ কেনা-বেচা করেন তিনি। এসব মরিচ রাত ৮টার মধ্যে ট্রাকে চলে যাচ্ছে দেশের বড়-বড় আড়তে। জাহাঙ্গীর জানালেন, সকালেই আড়তের দাম জেনে নেন তারা। কৃষকদেরও এটি জানিয়ে দেয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার প্রতিমণ মরিচ ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে ভিডিও কলের মাধ্যমে মরিচের কোয়ালিটি দেখানোর পর তারা পরিমাণ মতো অর্ডার করেন। কৃষকদেরও তারা সেভাবে জানিয়ে অর্ডার দেন। এখন আর ক্ষেত থেকে মরিচ তুলে কেউ বসে থাকতে হয় না। বিড়ম্বনারও শিকার হতে হয় না। একসময় ক্ষেত থেকে মরিচ তুলে ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে নৌকায় কিংবা ঠেলায় নিয়ে আসা হত মরিচ। এরপর আড়ৎদার ইচ্ছে মত দাম বলতো, ইজারাদার-জমাদারের অত্যাচার ছিল। কৃষকের মরিচ প্রায়ই বাজারেই পঁচেও নষ্ট হয়ে যেত। প্রযুক্তির বদৌলতে দিন বদলে গেছে। মন্নানঘাট বাজারের হারুন মার্কেট, মমিনপুর, সাচনা বাজার ও গজারিয়া বাজারে প্রতিদিন আড়ৎ বসিয়ে ৪-৫ লাখ টাকার মরিচ কেনা বেচা হচ্ছে।
স্থানীয় কামিনীপুর গ্রামের রমজান আলী বললেন, ক্ষেত থেকে সবজি তুলেই ন্যায্য মূল্যে সরাসরি বিক্রি করে নগদ টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারছি। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা টাটকা মরিচ কিনে ঢাকা, সিলেট ও ময়মনসিংহের ব্যবসায়ীদের কাছে গাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, এতে মধ্যস্বত্ব ভোগীদের কাছে জিম্মি হতে হচ্ছে না কৃষকদের।
কৃষক সুলেমান মিয়া, আব্দুল জব্বার, তাজুল ইসলাম বললেন, বড় থেকে ছোট কৃষক সকলেরই এখন স্মার্ট ফোন আছে। এই ফোনই স্বপ্ন বড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। জামালগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আলা উদ্দিন বললেন, হাওর এলাকার কৃষকেরা এখন প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তারা ফসলের বিভিন্ন সমস্যা ভিডিও কলের মাধ্যমে আমাদের দপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে ছবি দেখিয়ে পরামর্শ করতে পারছে, আবার সমস্যা সমাধানের বিষয়টিও জেনে নিচ্ছেন। একইভাবে পণ্য দেখিয়ে প্রতিদিন ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারদরও জানতে পারছেন তারা। ডিজিটাল প্রযুক্তির বদৌলতে বদলে গেছে এখন ভাটির জীবন। বিশেষ করে জামালগঞ্জের ভাটির চরের মরিচ ব্যবসায়ীরা এর সুফল পাচ্ছেন গ্রামে বসেই।
স্থানীয় সাংবাদিক মো. ওয়ালী উল্লাহ সরকার বলেন, চাষিদের কাছ থেকে তাদের সফলতার কথা জেনে ও টাটকা মরিচের ছবি উত্তোলন করে সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে আমাদেরও আনন্দ লাগে।
সদর উপজেলার হালুয়ারঘাট বাজারের ব্যবসায়ী এরন মিয়া বলেন, রঙ্গারচর ও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের মরিচ চাষিরা হালুয়ারঘাট বাজারে এনে স্তুপীকৃত করে নৌকায় দেশের বিভিন্ন জেলায় মরিচের চালান পাঠান। অন্যদিকে সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের প্রায় ২৫টি গ্রামের কৃষকরা উৎপাদিত মরিচ সুনামগঞ্জ শহরের জেলরোডস্থ খেয়াঘাটে এনে জমা করে ট্রাকযোগে সিলেট ও ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় আগাম বিক্রয়মূল্যের টাকা নগদে হাতে পেয়ে পাঠিয়ে দেন। সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসসকে বলেন,পাহাড়ী সুনামগঞ্জ এলাকা অর্থাৎ সদর উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন,দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার উচু জমিতে কাচামরিচের বেশ ভালো আবাদ হয়। এসব মরিচ স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করার পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানী হয়। গত বছরের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পর এইবার সুনামগঞ্জে মিষ্টি কুমড়া, কাচামরিচসহ বিভিন্ন সব্জির বাম্পার ফলন হয়েছে।