ইসলাম ধর্ম-বর্ণ-অ ল-নির্বিশেষে সব মানুষের কল্যাণে কাজ করতে বলে। ইসলাম মানবিকতা ও মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে সব মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখে। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া দান গ্রহণের ক্ষেত্রে অমুসলিমরা মুসলিমদের অনুরূপ। অমুসলিমদের দান করলেও মেলে সওয়াব।
আল্লাহ ভেদাভেদ পছন্দ করেন না : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) শুধু মুসলিমদের দান করার নির্দেশ দেন। তখন অবতীর্ণ হয়, ‘তাদের সৎপথ গ্রহণের দায়িত্ব তোমার নয়, বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করো, তা তোমাদের নিজেদের জন্য এবং তোমরা তো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভার্থেই ব্যয় করে থাকো। যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করো তার পুরস্কার তোমাদেরকে পুরোপুরি প্রদান করা হবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না।’ অতঃপর তিনি দান করার নির্দেশ দিলেন সব ধর্মের অনুসারী সাহায্যপ্রার্থীদের। (তাফসিরে ইবনে কাসির, সুরা : বাকারার ২৭২ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
অমুসলিমদের দান করলেও মেলে সওয়াব : মুসলিম ব্যক্তিকে দান করলে যেমন সওয়াব পাওয়া যায়, তেমনি অমুসলিম ব্যক্তিদের দান করলেও সওয়াব পাওয়া যায়। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ফাসেক, ইহুদি, খ্রিস্টান, মূর্তিপূজক অবিশ্বাসীকে সদকা করাও জায়েজ আছে এবং নেকিও আছে। ইমাম ইবনে কুদামা (রহ.)-ও অনুরূপ মত দিয়েছেন। (আল-মাজমু : ৬/২৪০; আল-মুগনি : ২/৪৯২)
অমুসলিমদের দান করার বিধান
অমুসলিমদের দান করার বিধান ও শর্তাবলি নিম্নে বর্ণনা করা হলো: ১. সাধারণ দানে কোনো বাধা নেই : ফরজ নয়, এমন দানের অর্থ অমুসলিমদের দেওয়া জায়েজ, বিশেষত যখন তারা নিকটাত্মীয় হয়। শর্ত হলো তারা মুসলমানের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকবে না এবং দানের অর্থ পাপাচার ও জনস্বার্থবিরোধী কাজে ব্যয় করতে পারবে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দ্বিনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বের করেনি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেননি। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)
আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, আমার মা, যিনি মুশরিক ছিলেন, তাঁর পিতার সঙ্গে আমার কাছে এলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কুরাইশরা চুক্তি করেছিল। তখন আসমা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা আমার কাছে এসেছেন। তিনি ইসলামের প্রতি আগ্রহী নন। আমি কি তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব? আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে সদ্ব্যবহার কোরো। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১৮৩) আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, একজন ইহুদি নারী তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তিনি তাঁকে দান করেন। ইহুদি নারী তাঁর উদ্দেশ্যে বলেন, আল্লাহ তোমাকে কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। কিন্তু বিষয়টি আয়েশা (রা.) অপছন্দ করলেন। অতঃপর যখন মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো, তিনি ঘটনা বর্ণনা করলেন। তখন মহানবী (সা.) বললেন, তুমি বিষয়টি অপছন্দ কোরো না। কেননা আমার নিকট ওহি এসেছে যে তোমরা নিজ নিজ কবরে আজাবের মুখোমুখি হবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৪৮১৫)
২. জাকাত শুধু মুসলমানের জন্য : ইসলামী আইন গবেষকরা বলেন, কোনো অমুসলিম ব্যক্তিকে ফরজ দান তথা জাকাত দান করা বৈধ নয়। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, মুশরিক ব্যক্তিকে নফল দান করলে কোনো সমস্যা নেই। তবে ফরজ দানে তাদের কোনো অধিকার নেই। (কিতাবুল উম্ম : ৩/১৫৭)
৩. অমুসলিম অভাবগ্রস্ত হলে অগ্রাধিকার : দানের ক্ষেত্রে মুসলিমরা অমুসলিমদের ওপর প্রাধান্য পাবে। কেননা মুসলমানের ক্ষেত্রে আশা করা হয়, সে তা আল্লাহর আনুগত্যের পথে ব্যয় করবে। তবে একজন অভাবগ্রস্ত অমুসলিম অভাবী নয় এমন মুসলিমের ওপর প্রাধান্য পাবে। কেননা আল্লাহ সাধারণভাবে অভাবী মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে বলেছেন, ‘আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে।’ (সুরা : দাহর, আয়াত : ৮) ৪. পাপকাজে সহযোগিতা নয় : গ্রহীতা মুসলিম হোক বা অমুসলিম দানের অর্থ যদি সে কোনো পাপ বা হারাম কাজে ব্যয় করে, তবে তাকে সহযোগিতা করা বৈধ নয়। একইভাবে যারা জনস্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত, তাদেরও সহযোগিতা করা যাবে না। কেননা তাদের সহযোগিতার অর্থ হলো অন্যায় কাজে সহযোগিতা করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমা লঙ্ঘনে পরস্পরকে সাহায্য করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ২)
৫. অমুসলিমদের দানে সীমাবদ্ধতা নেই : ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি জাকাত অমুসলিমদের দেওয়া যায় না; অন্যথায় যেকোনো দান-সাদাকা, এমনকি ফিতরাও অমুসলিমদের দেওয়া যায়। এখানে লক্ষণীয় যে জাকাত দিতে হয় বছরে একবার। জাকাত ধনীদের সম্পদ থেকে ২.৫ শতাংশ আদায় করতে হয়। অন্যদিকে সাদাকা বছরের যেকোনো সময় যেকোনো পরিমাণ মুসলিম-অমুসলিম সবাইকে দেওয়া যায়। তা ছাড়া সাদাকা ধনীরা ছাড়াও মোটামুটি সচ্ছল যে কেউ আদায় করতে পারে। মোটকথা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে বৈরী মনোভাব দূর করার জন্য পারস্পরিক লেনদেন, দান-অনুদান বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। মানবতার বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠনের বিকল্প নেই। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।