বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় মোখা ক্রমশ উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকায় এবং এর তীব্রতা বাড়তে থাকায় কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক গতকাল শনিবার দুপুর ২টায় এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র আজ রোববার বিকেলে টেকনাফ এবং সেন্ট মার্টিনের আশপাশ দিয়ে অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে। এর আগে সকালে সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারির কথা জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো: এনামুর রহমান। ৮ থেকে ১০ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের সংকেতকে মহাবিপদ সংকেত বলা হয়ে থাকে। এই সতর্ক সংকেতের মানে হলো বন্দর প্রচ- বা সর্বোচ্চ তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে। বাতাসের গতিবেগ ১৭০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান। তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ এখন ঘণ্টায় ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। সেই হিসাবে রোববার বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত করার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে আবহাওয়া অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ঝড়টি আঘাত করতে পারে। সেই সময় উপকূলীয় এলাকায় ৮ থেকে ১২ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান। সেইসাথে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় ভারী বৃষ্টি হতে পারে। আজিজুর রহমান আরো বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলের যত কাছাকাছি আসতে থাকবে, সেটির অগ্রসর হওয়ার গতি আরো বাড়তে থাকবে। তখন সেটি ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে এগোতে পারে।‘ঘূর্ণিঝড় যখন উপকূলের কাছাকাছি আসে, তখন সেটির অগ্রসর হওয়ার গতি বেড়ে যায়,’ তিনি বলছেন। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি এখন যে গতিতে অগ্রসর হচ্ছে, সেটি পর্যালোচনা করে আবহাওয়া বিভাগ সকালে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করে।
আবহাওয়াবিদ আজিজুর রহমান বলেছেন, ‘ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রের পরিধি প্রায় ৭৪ কিলোমিটার। ফলে সেটি যদি সেন্টমার্টিনস দ্বীপ বা টেকনাফের দক্ষিণ দিক থেকেও অতিক্রম করে, তার প্রভাব ওই সেন্টমার্টিনস, টেকনাফ ও কক্সবাজার এলাকায় পড়বে।’ আবহাওয়াবিদরা বলছেন, শনিবার রাত থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব পড়তে শুরু করবে। সাধারণত ঘূর্ণিঝড় আঘাত করার কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা আগে মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়ে থাকে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ শনিবার দুপুর ১২টা নাগাদ কক্সবাজার বন্দর থেকে ৬৩০ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম সমুন্দ্র বন্দর থেকে ৭০৫ কিলোমিটার এবং মোংলা সমুন্দ্র বন্দর থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর ৬৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৬০ কিলোমিটার থেকে ১৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের আশপাশে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট বেশি উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। এছাড়া ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও ভোলার উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৮ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। যার প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধ্বস হতে পারে। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাবে সকাল থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে বলে সেখান থেকে জানান বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা শাহনেওয়াজ রকি। তিনি বলেন, খুব একটা ঝড়ো বাতাস নেই। শহরাঞ্চলে জীবনযাত্রা এখনো পর্যন্ত স্বাভাবিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন দ্বীপ ও উপকূলীয় এলাকায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেন্ট মার্টিন থেকে গতকাল পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ নিজেদের উদ্যোগেই টেকনাফে আত্মীয়দের বাড়িতে চলে এসেছে বলে জানান সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আজিজ। কিন্তু আজ আর কেউ আসতে পারছেন না। কারণ ছোট বোট ও ট্রলার চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
তিনি বলেন, অনেকে এখন সরকারি উদ্যোগের আশায় আছেন। যদি তাদের নৌবাহিনীর সহায়তায় সরিয়ে আনা হয় সেন্ট মার্টিন থেকে। তবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক শাহীন ইমরান জানান, ওখানে সকলেই আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করবে। ‘সেন্ট মার্টিনে যেসব সরকারি স্থাপনা যেগুলো শক্ত, মজবুত, দু’তলা, তিনতলা এরকম ৩৭টি স্থাপনা আমরা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছি। ওখানে ৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে,’ বলেন তিনি।
তবে বেশি আতঙ্ক মহেশখালীর দিকে। ওখানকার স্থানীয় সাংবাদিক বশির উল্লাহ জানান, মহেশখালিতে ৮টি জায়গায় বেড়িবাধ ভাঙ্গা, সেদিক দিয়ে জলোচ্ছাসে পানি ঢুকে পড়ার শঙ্কায় আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এদিকে মাইকিং করে জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে আসার যে আহ্বান জানাচ্ছিল প্রশাসন সেটি আজ সকাল থেকে আরো জোরদার করা হয়েছে বলে জানান কক্সবাজার জেলা প্রশাসক শাহীন ইমরান। তাদের লক্ষ্য সন্ধ্যার আগেই যারা ঝুঁকিপূর্ণ তাদের সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার। ‘আশঙ্কা তো আছেই, ভূমিধস হওয়ার, জলোচ্ছ্বাসের। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে যারা ভালনারাবল তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা। সে কাজটি আমরা করে যাচ্ছি। আমরা দুপুরের মধ্যেই সবাইকে বলছি আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসার জন্য, কিন্তু সন্ধ্যার পর যাতে কোনোভাবেই কেউ কোনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় না থাকে সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই।’
জেলা প্রশাসক জানান, মোট ৫৭৬টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত আছে, যেখানে ৫ লাখের উপর মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এর বাইরে স্কুল, কলেজ ও কয়েকটি হোটেল-মোটেল আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত: ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। ফলে কক্সবাজারকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং চট্রগ্রাম ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এসব তথ্য জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। গতকাল শনিবার (১৩ মে) মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ঘূর্ণিঝড় মোখা সংক্রান্ত প্রস্তুতিবিষয়ক কর্মসূচির বাস্তবায়ন বোর্ডের জরুরি সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, গতরাত থেকেই কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম জেলায় বিপদাপন্ন জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বিপদের সম্মুখীন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে অবস্থানরত মানুষের নিরাপত্তায় গতকালই সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে অবস্থানরত অন্তত ৮ হাজার ৫০০ মানুষকে সর্বোচ্চ জলোচ্ছ্বাস মাত্রার সুপার সাইক্লোন মোকাবিলায় সক্ষম ৩৭টি অবকাঠামোয় নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, আগেভাগেই সেখানকার সকল মজবুত-নিরাপদ অবকাঠামোর হোটেল-রিসোর্ট, সব সরকারি বেসরকারি উপযুক্ত অবকাঠামো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য উপজেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। এরপরও প্রয়োজনীয়তা সাপেক্ষে সেখানকার মানুষকে উদ্ধার করে টেকনাফে নিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড প্রস্তুত রয়েছে। অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ছয় জেলায় জলোচ্ছ্বাস: অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ছয় জেলায় হতে পারে জলোচ্ছ্বাস। জেলাগুলো হলো- চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, ভোলা ও বরগুনা।
শনিবার (১৩ মে) মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির বাস্তবায়ন বোর্ডের জরুরি সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, গত শুক্রবার (১২ মে) সকালে ‘মোখা’ অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। এটি এখনো উত্তর ও উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, আশঙ্কা করছি, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় আঘাত হানবে। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, ভোলা ও বরগুনাসহ বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টেকনাফ ও কক্সবাজারের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দুই-তিন মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। আর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, বরগুনা এবং ভোলার জন্য দুই মিটারের কম উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।
তিন মিটারের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজনের জন্য একটি আশঙ্কা থেকে যায় বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়টি রোববার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে আঘাত হানতে পারে। এখন পর্যন্ত যে দূরত্ব আছে, আগামীকাল সকাল থেকেই উপকূল স্পর্শ করতে থাকবে এটি।
এনামুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান, পথ ও গতি বিবেচনা করে আমরা স্থির করেছি, কক্সবাজার বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে। আর চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরে আট নম্বর মহাবিপদ সংকেত থাকবে। মংলায় থাকবে চার নম্বর সতর্ক সংকেত। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত কখন থেকে কার্যকর হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শনিবার দুপুর আড়াইটা থেকে এটি কার্যকর হবে। এখন সেন্টমার্টিনের সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হলেও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের শতভাগ আনা সম্ভব হয়নি।