দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন
দীর্ঘদিন ভারতের হিন্দু-মুসলিম সংঘাত থেকে দূরে ছিল বলিউডের বেশিরভাগ অংশ। উদার মূল্যবোধ, মুসলিম তারকা এবং হিন্দু-মুসলিম সেলিব্রেটি বিয়ের হাত ধরে হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্প বরং কিছু কিছু দিক থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিষেধক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এ মাসে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নামে একটি স্বল্প বাজেটের এবং কথিত ইসলামবিদ্বেষী চলচ্চিত্র ঘিরে প্রবল রাজনৈতিক বিতর্ক বলিউডের সেই সহনশীলতার রেকর্ডকে হুমকির মুখে ফেলেছে৷ বিতর্কটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্ম দিয়েছে, যাতে অন্তত একজনের মৃত্যু হয়েছে, পশ্চিমা লীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে গ্রেফতার হয়েছেন ১০০ জনের বেশি।
এগুলো শুরু হয়েছিল চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই। ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র বিষয়বস্তু এক কাল্পনিক হিন্দু নারীকে ঘিরে, যাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা এবং পরে উগ্রবাদী করে তোলা হয়েছিল। চলচ্চিত্রটির ট্রেলারে দাবি করা হয়, ভারতের দক্ষিণা লীয় রাজ্য কেরালা থেকে ৩২ হাজার মেয়েকে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল এবং তারপর সিরিয়া ও ইয়েমেনে জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। তথ্যটি অবশ্যই মারাত্মকভাবে অতিরঞ্জিত। কারণ ২০১৬ সালে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসে যোগ দেওয়ার জন্য মাত্র ২০ জনের মতো নারী-পুরুষ কেরালা ছেড়েছিল। কিন্তু তারপরও নরেন্দ্র মোদী এবং তার হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অতি উৎসাহের সঙ্গে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ চলচ্চিত্রটিকে সমর্থন করছেন। কর্ণাটকে সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রচারণাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, চলচ্চিত্রটি ‘সন্ত্রাসবাদের নতুন রূপ’ উন্মোচিত করেছে।
বিজেপি-শাসিত দুটি বড় রাজ্য মধ্য প্রদেশ এবং উত্তর প্রদেশ ‘দ্য কেরালা স্টোরি’কে করমুক্ত ঘোষণা করেছে। আসামের বিজেপি দলীয় মুখ্যমন্ত্রী টুইটারে লিখেছেন, সবার উচিত কন্যাদের সঙ্গে নিয়ে চলচ্চিত্রটি দেখা।
তবে এর তীব্র নিন্দা করেছেন বিরোধী নেতারা। কেরালার কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী চলচ্চিত্রটিকে ডানপন্থি হিন্দু সংগঠনগুলোর দল ‘সংঘ পরিবার’-এর পণ্য বলে অভিহিত করেছেন। তামিলনাড়ুর সিনেমা হলগুলো থেকে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ এটি নিষিদ্ধ করেছিল, যদিও পরে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সেই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করেছেন।
‘দ্য কেরালা স্টোরি’ কেরালার মুষ্টিমেয় মুসলিমদের মৌলবাদী কর্মকা- কাজে লাগিয়ে ‘লাভ জিহাদ’ নামে পরিচিত কট্টরপন্থি হিন্দু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করছে। এতে সমর্থন দিচ্ছেন বিজেপির রাজনীতিবিদরা, যা অ-হিন্দুদের ওপর আক্রমণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। চলতি মাসে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক সবশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ ধরনের কথা বলা হয়েছে। তারা বলেছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, হত্যা, হামলা এবং ভয় দেখানোর মতো ঘটনা সারা বছর ঘটেছে। গত বছর মুক্তিপ্রাপ্ত আরেকটি বিভাজনকারী হিন্দি চলচ্চিত্র ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সেই সহিংসতার কিছু অংশ উসকে দিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। নরেন্দ্র মোদী এবং তার দলের পক্ষ থেকে এই চলচ্চিত্রটিরও প্রবল প্রচারণা চালানো হয়েছিল। বর্তমানে ভারতে ১ হাজার ৫০০টির মতো সিনেমা হলে চলছে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’, বিদেশেও প্রদর্শন করা হচ্ছে। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, নরেন্দ্র মোদীর কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতি এবং ভারতীয় জনপ্রিয় সংস্কৃতির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই বাড়ছে। এই প্রবণতা উদ্বেগজনক।