জাহান্নাম আরবি শব্দ। ফারসিতে বলে দোজখ। বাংলাতে নরক। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের অসংখ্য জায়গায় পরকালে পাপীদের বাসস্থান হিসেবে জাহান্নামের কথা উল্লেখ করেছেন। আবার কোথাও উল্লেখ করেছেন নার বলে। অবশ্য নার শব্দের অর্থ দোজখের আগুন। প্রত্যেক মুসলমানের পরকালে জান্নাত-জাহান্নামের ওপর ঈমান আনা ফরজ।
জাহান্নামের পরিচয় : জাহান্নাম একটি বিভীষিকাময় ও ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির স্থান। জাহান্নামের শাস্তি বিভিন্ন ধরনের হবে যেমন- সাপ-বিচ্চুর দংশন, ফেরেশতাদের লৌহদ- দিয়ে প্রহার, খাবার হিসেবে কাঁটাযুক্ত তিতা জাক্কুম ফল, দুর্গন্ধময় পুঁজ-রক্ত, ভীষণ ফুটন্ত পানি, তাতে আরো থাকবে অত্যুষ্ণুবায়ু, কৃষ্ণবর্ণ ধূম্রছায়া ইত্যাদি। তবে জাহান্নামের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তা আগুনে ভরা। তাই জাহান্নামের সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো পাপীদের অগ্নিতে দগ্ধকরণ।
জাহান্নামের আগুনের তিব্রতা নিয়ে মহানবী সা: বলেন, ‘জাহান্নামের আগুনকে এক হাজার বছর প্রজ্ব¡লিত করা হলো তাতে তা লাল বর্ণ ধারণ করল। তারপর তাকে আরো এক হাজার বছর প্রজ্বলিত করা হলো তাতে তা সাদা রূপ ধারণ করল। পুনরায় তাকে আরো এক হাজার বছর প্রজ্ব¡লিত করা হলো তাতে তা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল। সেটিই হলো তার (বর্তমান) কৃষ্ণবর্ণ অবস্থা’ (তিরমিজি)।
নবী করিম সা: আরো বলেন, ‘তোমাদের এ পৃথিবীর আগুন তাপের দিক দিয়ে জাহান্নামের আগুনের ৭০ ভাগের ১ ভাগ’ (বুখারি-মুসলিম)।
এমন কঠিন অগ্নিতে মানুষ কিভাবে দিনাতিপাত করবে একটু ভাবুন তো! এটি কি কোনো মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব? তবে বাস্তবতা হবে এমনই।
কাফিরদের শাস্তি : কাফির আরবি শব্দ বাংলাতে বলে নাস্তিক। কাফিরদের শাস্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা সে আগুনকে ভয় করো যার জ্বালানি হবে মানুষ এবং পাথর যা কাফিরদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে’ (সূরা বাকারা-২৪)। পাথরে আগুন ধরলে তা আর নিভতে চায় না, ঠা-া হতে চায় না। মহান আল্লাহ যখন সে জ্বলন্ত অঙ্গারে মানুষ এবং পাথর একত্রিত করে জ্বালাবে তখন সে মানুষটির যন্ত্রণা কেমন হবে? একটু চিন্তা করি তো!
তিনি আরো বলেন- ‘অতএব যারা কাফির, তাদের জন্য আগুনের পোশাক তৈরি করা হয়েছে। তাদের মাথার ওপরে ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে। ফলে তাদের পেটে যা আছে তা এবং চর্ম গলে বের হয়ে যাবে। তাদের (শাস্তির) জন্য রয়েছে লোহার হাতুড়ি। তারা যখনই যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে জাহান্নাম থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদেরকে তাতে ফিরিয়ে দেয়া হবে। বলা হবে- দহন শাস্তি আস্বাদন করো’ (সূরা হাজ : ১৯-২২)।
মুশরিকদের শাস্তি : মুশরিক যারা স্র্রষ্টাকে মানে কিন্তু তাঁর সাথে শরিক স্থাপন করে কল্পিত বিভিন্ন দেব-দেবীর। বাংলাতে তাদের অংশীবাদী বলা হয়। মুশরিকদের পরিণতি নিয়ে মহান আল্লাহ বলেন- ‘এদের (মুশরিকদের) আমল বরবাদ হয়ে গেছে এবং আগুনে এরা স্থায়ীভাবে বসবাস করবে’ (সূরা তাওবা-১৮)।
উল্লেখ্য, আজ মুসলমানদের মধ্যে দেব-দেবীর পূজা নেই সত্য, তবে মাজার পূজা, কথিত বুজুর্গ ব্যক্তির সিজদা করা, মনের বাসনা সিদ্ধির জন্য দরগাহতে মানত, গাছের গোঁড়ায়, নদীতে মানত- এ ধরনের প্রকাশ্য শিরকের কাজ কোথাও কোথাও প্রচলিত আছে। এ ছাড়া কোথাও কোথাও মুসলিমদের মধ্যে অমুসলিমদের আপত্তিকর রসম-রেওয়াজ,আকিদা-বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে আছে- এ গুলোও প্রকাশ্য শিরক। মহান আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে কাউকে শরিক করা ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য পাপ যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করে দেন’ (সূরা নিসা-৪৮)। সুতরাং মুসলমানদের কেউ যদি এমন শিরকে লিপ্ত থাকে তাহলে তাদেরকেও কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আবার কেউ বলে অমুকের দয়ায় বা সাহায্যে বেঁচে আছি, অমুক পাশ থেকে সরে গেলে নিষ্কৃতি নেই, অমুক খাওয়ায়, পরায়, উদ্ধার করে এগুলো অপ্রকাশ্য শিরক। মুসলমানদের এসব শিরকের গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে হবে।
জালিমদের শাস্তি : যারা দ্বীন চেনে না তারা মূলত তাদের হাত-পা, চোখ-মুখ তথা শরীরের ওপর জুলুম করে। উপরন্তু এদের অধিকাংশই দ্বীনের পথে দায়ীদের প্রতি চরম জুলুম করে থাকে তাদের শাস্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন- ‘তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুনের শয্যা এবং তাদের ওপরে থাকবে ( ঢেকে দেয়া হবে) আগুনের চাদর। আমি জালিমদের এমনি শাস্তি প্রদান করি’ (সূরা আরাফ-৪১)। ভাবুন তো! এ কেমন অসহ্যকর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি!
মুনাফিকদের শাস্তি : মুশরিকদের থেকে মুনাফিকদের শাস্তি আরো ভয়াবহ। এর কারণ মুনাফিকরা মুখে কালেমার বাণী স্বীকার করেও অন্তরে ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করে। ইসলামের বিনাশ সাধনে অর্থ, শ্রম, মেধা দিয়ে ইসলামের শত্রুদের সহযোগিতা করে থাকে। ইসলামের ওপর এদের আঘাত হলো কাফিরদের থেকেও মারাত্মক।
এ জন্য মহান আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা থাকবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে এবং তাদের জন্য তুমি কখনো কোনো সাহায্যকারী পাবে না’ (সূরা নিসা-১৪৫)। নিশ্চয়ই আল্লাহ দোজখের মধ্যে মুনাফিকদের ও কাফিরদের একই জায়গায় সমবেত করবেন’ (সূরা নিসা-১৪০)। ‘এর (জাহান্নামের) সাতটি দরজা আছে। প্রত্যেক দরজার জন্য একেকটি পৃথক দল আছে’ (সূরা হিজর-৪৪)।
কারো কারো মতে, উপর-নিচের স্তরের দিক থেকে জাহান্নামের দরজা সাতটি। কেউ কেউ এগুলোকে সাধারণ দরজার মতো সাব্যস্ত করেছেন। প্রত্যেক দরজা বিশেষ প্রকার অপরাধীদের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে (মারেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা : ৭৩০-৭৩১)।
এখান থেকে কেউ কেউ বলেন, জাহান্নামকে স্তরভেদে সাতটি নামকরণ করা হয়েছে। এ সাতটির নাম হলো- জাহান্নাম, লাজা, হুতামাহ, সায়ির, সাকার, জাহিম, হাবিয়াহ।
সবচেয়ে নিম্নস্তর হলো হাবিয়াহ, যাকে বলা হয় ভয়াবহ জাহান্নাম। এখানে থাকবে মুনাফিকরা। অনেক পরিতাপের বিষয় হলো, আজো আমাদের মুসলিম সমাজে এমন অনেকে আছে যারা ইসলামের কিছু বিধানকে পছন্দ করে আর কিছু বিধানকে অপছন্দ করে। যেমন কেউ সালাত, রোজা, জিকির-আসকার, দোয়া দরুদ পছন্দ করে কিন্তু জাকাত, ওশরকে নিজেদের জন্য জরিমানা আর জিজিয়াকে অমুসলিমদের প্রতি জুলুম মনে করে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত চুরি, মদ, জুয়া, ব্যভিচারের শাস্তির বিধান মানতে রাজি নয়। অর্থব্যবস্থায় সুদকে প্রয়োজনের দাবি মনে করে। পর্দাকে নারী উন্নয়নের অন্তরায় মনে করে। সর্বোপরি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামী হুকুমতকে কঠিন অপছন্দ করে। অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবীর ইসলামী হুকুমতের কথা শুনলে গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। এটিকে সেকেলে, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে একে কঠিন অনুপযোগী রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে সাব্যস্ত করে।
অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আসমান ও জমিনের সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহর’ (সূরা হাদিদ-২)। আর জমিনে ইসলামী হুকুমত কায়েম ছাড়া আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম কখনো সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন- ‘সাবধান! সৃষ্টি তাঁর এবং আইনও তাঁর’ (সূরা আরাফ-৫৪)। তিনি আরো বলেন- ‘রাসূল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তোমরা তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করো’ (সূরা হাশর-৫৯)।
তিনি আরো বলেন- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমারা ইসলামে পরিপূর্ণসহকারে প্রবেশ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা বাকারা-২০৮)। তিনি আরো বলেন- ‘আমি কুরআনে কোনো কিছু অবশিষ্ট রাখিনি’ (সূরা আনআম-৩৮)।
অন্যত্র তিনি বলেন- ‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে ঈমান আনবে আর কিছু অংশ অস্বীকার করবে। তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করবে তাদের জন্য পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া আর কী প্রতিদান থাকতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আজাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা করো সে সম্পর্কে আল্লাহ গাফেল নন’ (সূরা বাকারাহ-৮৫)।
এসব আয়াত সামনে রেখে সেসব ইসলামবিদ্বেষী মুসলিম নামধারী ব্যক্তিদের আপনি কি বলবেন? এরাও কি মুনাফিক নয়? তাহলে এদের পরকালীন পরিণতি কত ভয়াবহ! একটু ভাবি তো!
এখানে একটি বিষয় স্মরণীয় যে, হজরত আবু বকর রা:-এর খিলাফতের শুরুতে কিছু নওমুসলিম সালাতের বিধান মেনে নিয়েছিল কিন্তু জাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল। খলিফা তাদের ধর্মত্যাগী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন। সে যুদ্ধের নাম ছিল রিদ্দার যুদ্ধ। তাদেরকে পদানত করে তিনি শিশু ইসলামী রাষ্ট্রকে মুনাফিকদের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। (আগামীকাল সমাপ্য)
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক