বাংলাদেশে রফতানি আয় বাড়লেও তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। আর রফতানি আয় মূলত ধরে রেখেছে তৈরী পোশাক খাত। এই খাতে রফতানি আয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০.২৭ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয়ের ৮৪.৫৭ ভাগই এসেছে পোশাক খাত থেকে। বিভিন্ন সঙ্কটের মধ্যেও পোশাক খাতের এই রফতানি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে আশার আলো দেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইউক্রেন-রশিয়ার যুদ্ধের কারণে পোশাক রফতানি কমে গেলেও বাংলাদেশী পোশাকের নতুন বাজার তৈরি হয়েছে। ওইসব বাজারে ৩৫ শতাংশ বেশি রফতানি হয়েছে তৈরী পোশাক।
রফতানি আয় বেড়েছে
বাংলাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। রফতানি হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি কম হয়েছে ৪.২১ শতাংশ। কিন্তু রফতানি বেড়েছে ৬.৬৭ শতাংশ। বিদায়ী অর্থ বছরের রফতানির পরিমাণ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ রফতানি করেছিল পাঁচ হাজার ২২৮ কোটি টাকার পণ্য। যা তার আগের বছরের তুলনায় ৩৪.৩৮ শতাংশ বেশি।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে শুধু গত জুনে ৫০৩ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। যা গত বছরের জুনের তুলনায় ২.৫১ শতাংশ বেশি। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলার ও রিজার্ভ সঙ্কটের কারণে গত অর্থবছরে পুরোটা সময়ই অর্থনীতিই চাপের মুখে ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূল দুই উৎস প্রবাসী আয় ও পণ্য রফতানি। দুটি উৎস থেকেই গত বছরের শেষ দিকে বৈদেশিক মুদ্রা আসা কিছুটা কমে গেলেও পরে আবার তা ঘুরে দাঁড়ায়।
মূল ভরসা পোশাক খাত
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরে তৈরী পোশাক, প্ল্যাস্টিক পণ্য ও চামড়াবিহীন জুতার রফতানি বেড়েছে। আবার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল ও প্রকৌশল পণ্যের রফতানি কমেছে। রফতানি আয় ধরে রেখেছে মূলত তৈরী পোশাক।
বিদায়ী অর্থবছরে চার হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ১০.২৭ শতাংশ বেশি। তৈরী পোশাকের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি হয়েছে ১২২ কোটি ডলারের। তবে এক্ষেত্রে রফতানি কমেছে ১.৭৫ শতাংশ। ফুটওয়্যারে ৬.৬১ শতাংশ, ম্যান মেইড ফাইবারে ৪২.৯৮ শতাংশ, প্ল্যাস্টিক পণ্যে ২৬.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। পাটজাত পণ্যে ১৯.১ শতাংশ, কৃষি পণ্যে ২৭.৪৭ ও হিমায়িত মাছে ২০.৭৬ শতাংশ রফতিানি কমেছে।
বিদায়ী অর্থবছর শেষে বৈধ পথে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ১৬১ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রবাসী আয় বেড়েছে তিন শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছিল ১৫.২ শতাংশ।
যেভাবে পোশাক খাত সামাল দিল
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোছে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ফলে ওইসব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইয়ের সহ-সভাপতি মো: শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘ইউক্রেন-রশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা বসে থাকিনি। আমরা পোশাক রফতানির জন্য তৃতীয় দেশ খুঁজছিলাম। অষ্ট্রেলিয়ার বাজারে আমাদের এক বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি বেড়েছে। এরপর ভারত, জাপান, কোরিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে আমাদের রফতানি বেড়েছে। আমাদের কনভেনশনাল মার্কেট ইউরোপ- আমেরিকায় যে রফতানি কমেছে তা আমরা নতুন মার্কেট দিয়ে মেকআপ করেছি। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের রফতানির পরিমাণ হয়ত বাড়েনি, কিন্তু রফতানি আয় বেড়েছে। তার কারণ হলো কাঁচামালের দাম বেড়েছে, ফ্রেইট কস্ট বেড়েছে, ইউটিলিটি খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের রফতানি আয়ের পরিমাণ বেড়েছে, রফতানির পরিমাণ হয়ত বাড়েনি।’
পোশাক প্রস্তুতকারকরা আরো নতুন বাজার খুঁজছেন এবং নতুন ধরনের পোশাকের কথাও চিন্তা করছেন। তিনি জানান, ‘ম্যান মেইড ফাইবারে চাহিদা বেড়েছে এবং এতে ভ্যালু অ্যাডিশনও বেশি হয়। আমি যদি কটন টি-শার্ট বানাই তা বেঁচতে পারি দেড় ডলার। কিন্তু ম্যান মেইড ফাইবার দিয়ে বানালে পাঁচ-ছয় ডলারে বিক্রি করতে পরব। উৎপাদনের সময় একই। এটার চাহিদা বাড়ার কারণ হলো এগুলো ইস্ত্রি করতে হয় না। একবার ধুয়ে চার-পাঁচ দিন পরা যায়। আমরা ম্যান মেইড ফাইবারের পোশাকের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি। নতুন কারখানাও লাগবে৷। আর মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদি আরব এবং ওই এলাকার দেশগুলোতে আমাদের তৈরী পোশাকের বড় একটি সম্ভাবনাময় বাজার আছে। সেটাও আমরা ধরার চেষ্টা করছি। তাদের পোষাকগুলো এক্সপেনসিভ, লম্বা জোব্বা টাইপের। ওই বাজার যদি আমরা ধরতে পারি, তাহলে এখান থেকে পোশাক রফতানির ভালো একটি অংশ আসবে। আমরা চেষ্টা করছি।’
তিনি জানান, বিদায়ী অর্থ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ১১ শতাংশ এবং ইউরোপের দেশগুলোতে গড়ে ৭.৫ ভাগ পোশাক রফতানি কমেছে। বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে এই সময়ে নতুন মার্কেটে পোশাক রফতানি ৩৫ ভাগ বেড়েছে। নতুন বাজারের মধ্যে আরো আছে রাশিয়া, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, মেক্সিকো ও চিলিসহ আরো কিছু দেশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ‘সার্বিক বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে চীন থেকে তৈরী পোশাকের অর্ডার এবং বিনিয়োগ দুটিই রিলোকেট হচ্ছে। তার একটি সুবিধা বাংলাদেশ পাচ্ছে। ধারণা করি, চীনের সাথে ইন্দো-মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েনে অনেকে সেখান থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে বিনিয়োগের সাহস পাচ্ছে না। এই সুবিধা ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের জন্য থাকবে। তৈরী পোশাকের রফতানি বাড়বে। আর এই সুবিধা বাংলাদেশ অন্য খাতেও নিতে পারে। বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশেও আনা সম্ভব।’
তার কথায়, ‘আমরা বৃহৎ এবং মিডিয়াম রেঞ্জের প্রডাক্টের সুবিধা পাচ্ছি। কিন্তু চীন থেকে পোশাক খাতের যে হাই-ভ্যালু প্রডাক্ট সরে যাচ্ছে তার সুবিধা নিতে পারছি না। আমরা যদি কটন বেইজড প্রডাক্টের পাশাপাশি সিনথেটিক, পলিয়েস্টার, ম্যান মেইড ফাইবারের পণ্য বাড়াতে পারি তাহলে লাভবান হব। পাশাপাশি হাইভ্যালু পণ্য যা অটোমেটেড মেশিনে উৎপাদন হয় সেদিকেও আমাদের যাওয়া প্রয়োজন। এতে আমাদের পোশাক খাতে ডাইভারসিটি বাড়বে।’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমাদের রফতানি আয় তৈরী পোশাক রফতানির ওপর নির্ভরশীল। গার্মেন্টস পণ্যের বাইরে আমাদের যে পণ্য আছে তা মূলত উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে যায়। তারাও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সঙ্কটে আছে। তাই এমন পরিস্থিতিতে ওই সব খাতে রফতানি বাড়ানোর সুযোগ খুব বেশি নেই। তবে ওইসব শিল্পে যাতে উৎপাদন ব্যাহত না হয়, শ্রমিকদের সঙ্কট না হয় সেদিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।’ তার মতে, ‘এখন চীন থেকে থেকে যেসব বিনিয়োগকারী বের হয়ে যাচ্ছে তাদের বাংলাদেশে আকৃষ্ট করার উদ্যোগ দরকার। বিশেষ অর্থনেতিক অ ল করে দেয়া যায়। তবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটে আছে বাংলাদেশ। তা কাটিয়ে তাদের আকৃষ্ট করা গেলে এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে।’ সূত্র : ডয়চে ভেলে