দেশের প্রগতিশীল মানুষের মুখপত্র পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে এমন একটি জাতীয় দৈনিকে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর ‘জাত গেল, জাত গেল’ বলে রব ওঠেছে। খবরটির শিরোনাম- ‘জামায়াত নেতার বাড়িতে ডেপুটি স্পিকারসহ সংসদ সদস্যদের মধ্যাহ্নভোজ।’ (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০২৩) একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এমন ঘটনা অস্বাভাবিক কিংবা জাত যাওয়ার মতো কিছু নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো- ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক ওই জামায়াত নেতার আত্মীয়। কিন্তু তারপরও জাত গেল বলে আওয়াজ ওঠার কারণ পত্রিকাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক সাহেব যে ওই জামায়াত নেতার শালা (শ্যালক) কিংবা সম্বন্ধী সে কথা উল্লেখ করা হয়নি।
ঘটনাটিকে নোঙরা রাজনৈতিক রঙ দেয়ার জন্য এই তথ্য গোপন নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে সে কথা অবশ্য ওই পত্রিকার সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক ও সম্পাদক মহোদয়ই ভালো বলতে পারবেন। অন্য একটি সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, পাবনার ঈশ্বরদী পৌরসভা জামায়াতের আমির গোলাম আজমের ছেলে জানিয়েছেন, ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক তার মামা। শামসুল হক মধ্যাহ্নভোজন করেছেন তার বোনের বাড়িতে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি, সামাজিক সম্প্রীতি ও জাতীয় সংহতির এই চিত্র আমাদের যুগ যুগ ধরে লালিত ঐতিহ্যেরই বহিঃপ্রকাশ। এমন সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টিকারী ঘটনা এই দেশ ও সমাজ দীর্ঘ দিন ধরে প্রত্যক্ষ না করতে করতে এর বিপরীত সাম্প্রদায়িক হিংসার লালনকেই রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ গণ্য করছে একটি গোষ্ঠী এবং তাকেই মাথার মুকুট মনে করে গর্ব করছে। অথচ অতীতের জাতীয় নেতাদের ইতিহাসে এমন ঘটনাও আছে, গ্রেফতার এড়াতে বিরোধী দলীয় নেতা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গোপন আশ্রয় নিয়েছেন। সেই অতীত আজ হারিয়ে গেছে। উদার, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বলে ঢেঁকুর তোলা কিছু মানুষ রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতার কারণে মানুষে মানুষে দেয়াল তুলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। দেশ জাতি ও সমাজ কলুষিত করছে। মজার বিষয় হলো- তারা তাদের রাজনীতির অভিধানে সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির একটি পারিভাষিক অর্থ দিয়েছেন। তাদের ভাষায়- সাম্প্রদায়িকতা মানে হলো ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ। কারণ, এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার রকমফের নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। তথাকথিত প্রগতিশীলরা তা করতে দেন না। অথচ কোনো বিশেষ গোষ্ঠী, দল, গোত্র কিংবা ধর্মের মানুষ যখন অন্যদের শত্রুজ্ঞানে হিংসা করে এবং তাদের ধ্বংস কামনা করে তাই সাম্প্রদায়িকতা। এটি হতে পারে ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক, ভাষাভিত্তিক, রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো কারণে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ধ্বংসাত্মক- এ কথা সত্য। কিন্তু রাজনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক কিংবা ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাও কম ধ্বংসাত্মক নয়। তাই উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে কারো সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা গণতান্ত্রিক আদর্শের বিপরীত। এটি শুধু ফ্যাসিবাদী ও সাম্প্রদায়িকতা লালনকারীদেরই মানায়। এ দেশের মানুষ এমন ফ্যাসিবাদ ও সাম্প্রদায়িতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। তারা চায় সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও সংহতি। তারা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ধর্মবিশ্বাসের অংশ বলে বিশ্বাস করেন। এ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও ভিন্নমতের কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ছিন্নের সুযোগ নেই। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাষায়- ‘আমি তোমার কথার সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেবো।’ কিন্তু আজ এ দেশে গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে কী চলছে? সামান্য রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ও হিংসার বিষবাষ্প ছড়ানোর মতো সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার চাষ। এই চাষ করছেন তথাকথিত প্রগতিশীলরা। অথচ তারাই উঁচু গলায় সাম্প্রদায়িক বলে গালি দেন ধর্মবিশ্বাসী উদার চিন্তার মানুষদের। তথাকথিত প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের এই কপট রাজনীতির কারণে স্বাধীনতার ৫২ বছরেও জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা হয়নি। মানুষে মানুষে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বে বন্ধন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। প্রতিফলন নেই গীতিকবির এই দর্শনেরও- ‘সব মানুষের স্বপ্ন তোমার/চোখের তারায় সত্যি হোক/আমার কাছে দেশ মানে/এক লোকের পাশে অন্য লোক।’
এ দেশের তথাকথিত প্রগতিশীলরা নিজের দর্শন ও আদর্শ বিশ্বাসীদের ছাড়া অন্য কারো সাথে হাত মেলাতেও চান না। নিজের দলের লোক দুর্নীতিবাজ, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট হলেও জিন্দাবাদ দেন। অন্য দিকে ভিন্ন মতের লোকটি সৎ, চরিত্রবান,যোগ্য ও গণতন্ত্রমনা হলেও তাদের সমাজে তিনি বেঁচে থাকার অধিকারী মানুষ হিসেবেও বিবেচ্য নন। আইনের মারপ্যাঁচে তাকে অপরাধী বানিয়ে ফাঁসি দিতে হবে। আগে গ্রেফতার তারপর মামলা ও বিচার। এটি রাষ্ট্রের স্খলন। এই স্খলনের জন্য দায়ী তথাকথিত প্রতিশীলরাই। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালে মার্কিন রাজনীতি বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার লেখা গ্রন্থ ‘দ্য অ্যান্ড অব হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়। ফুকুয়ামা মনে করেন, বিশ্বাসও করেন, লিবারেল ডেমোক্র্যাসিই মানুষের জন্য সবচেয়ে আদর্শ শাসনব্যবস্থা, মানুষকে এটিতেই শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে হবে। কিন্তু নানা সময়ে তিনি এটিও খুব জোর দিয়ে বলেছেন যে, এ শাসনব্যবস্থা থেকে অনেক রাষ্ট্রের স্খলন হবে, কিন্তু সেখানেই আবার ফিরে আসতে হবে। সম্প্রতি তিনি উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান হুমকি হিসেবে পরিচয়বাদী রাজনীতিকে (আইডেনটিটি পলিটিকস) চিহ্নিত করেছেন। ২০১৮ সালে প্রকাশিত তার বই ‘আইডেন্টিটি : দ্য ডিমান্ড ফর ডিগনিটি অ্যান্ড দ্য পলিটিকস অব রিজেনমেন্ট’-এ ফুকুয়ামা দেখিয়েছেন, কীভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের রাজনীতিতে আইডেন্টি পলিটিকস মাথাচাড়া দিচ্ছে এবং তার প্রভাবে উদার গণতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক ডা: জাহেদ উর রহমান এ প্রসঙ্গে এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘ফুকুয়ামা এটি মেনে নেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তার বিভিন্ন রকম পরিচয়ের ভিত্তিতে আত্মমর্যাদাবোধ কাজ করে। ধর্ম, বর্ণ, অর্থনৈতিক শ্রেণী, জাতিগোষ্ঠী, লিঙ্গ, যৌন আচরণ- এ সব কিছুর ভিত্তিতেই পৃথিবীর সব মানুষেরই কোনো না কোনো রকম পরিচয় থাকে। অনেকেই একে খুব শক্তভাবে ধারণও করেন। সে কারণেই তারা চান তাদের এই পরিচয়ের স্বীকৃতি সমাজ বা রাষ্ট্র তাকে দিক। একটি রাষ্ট্রে তার অবস্থান সংখ্যাগত বা প্রভাবের দিক থেকে যতই ছোট হোক না কেন, তিনি তার সেই মর্যাদা সবার কাছে চান। তা যখন তিনি পান না তখনই তার মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ কাজ করে। হালআমলের পরিচয়বাদী রাজনীতিবিদরা সেই অসন্তোষকেই পুঁজি করেন, সেটিকে উসকে দেন।’ এমন উসকানি জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার বড় বাধা। এই বাধা দূর করতে ব্যর্থ হলে জাতি হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে বাঁচার শক্তি হারিয়ে ফেলব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের রাজনীতিতে বিদেশী মিত্রদের বর্তমান প্রভাবের কারণ বিশ্লেষণ করলে এই সত্য দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। অতএব সম্প্রীতি ঠেকাতে উসকানি নয়, প্রয়োজন সংহতির বন্ধন দৃঢ় করার মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যক
e-mail : harunibnshahadat@gmail.com