বিশ্বব্যাংক আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা
মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে গোটা পাঁচেক শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ। কারণ দেশটি মাত্র ১০ বছরেই মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের আয়বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মাথাপিছু আয় ১২ হাজার মার্কিন ডলার অতিক্রম করায় উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করে কোরিয়া। আর ২০২১ সালে দেশটির জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৯৯৮ ডলার। বদৌলতে কোরিয়া এখন বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। কোরিয়ার এই উন্নয়নের সামগ্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাংলাদেশ পাঁচটি শিক্ষা নিতে পারে। এগুলো হলো বাজারনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের টেকসইভাবে সহায়তা প্রদান, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, মানবসম্পদের উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সংস্কার সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি।
গত মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে বিশ্বব্যাংক আয়োজিত এক সেমিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়। ‘বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়ানো: কোরিয়া থেকে শিক্ষণীয়’ শীর্ষক এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপক (সামষ্টিক অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সরকারি খাত) হুন সাহিব সুহ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। সেমিনারে বক্তারা কোরিয়া কীভাবে দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হলো তা নিয়ে আলোচনা করেন। বাংলাদেশ ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে চায়।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়িয়ে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে কোরিয়া থেকে আমরা শিখতে পারি। রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে হলে আমাদের বাণিজ্যনীতি নতুন করে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। রপ্তানি ঝুড়িতে পোশাক খাতের বাইরের পণ্য বাড়াতে হবে। এ ছাড়া উদ্ভাবন, দক্ষ শ্রমিক ও উচ্চ উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে আমরা এই ফাঁদ এড়াতে পারব।’
সবাই যেখানে সর্বজনীন পেনশনের আওতায়: কোরিয়ার উন্নতির সুফল সবাই পাচ্ছে, এমন তথ্য দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং সিক। তিনি বলেন, কোরিয়া ১৯৭০ সালে প্রথম সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে। এতে সরকারি–বেসরকারি নির্বিশেষে সবাই অংশ নেয়। ১৯৮৯ সালে শতভাগ মানুষ এই পেনশন স্কিমের আওতায় চলে আসে। এখন কোরিয়ার প্রবীণ নাগরিকেরা পেনশন পান। কোভিডের সময় এটি খুব কাজে লেগেছে। উন্নতির সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন পার্ক ইয়ং সিক। এ জন্য দক্ষ মানবশক্তি গড়ে তোলা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর কথাও বলেন তিনি।
কোরিয়া যেভাবে সফল হলো: কোরিয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা হুন সাহিব সুহ বলেন, মধ্যম আয়ের ফাঁদ এড়াতে কোরিয়া শিল্প খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়েছিল। কোরিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ৯৫ শতাংশ বিনিয়োগই বেসরকারি খাতের।
হুন সাহিব সুহ মনে করেন, বিপুল পরিমাণ বেসরকারি বিনিয়োগ কোরিয়ার উন্নতি ত্বরান্বিত করেছিল। তিনি বলেন, কোরিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭৮ শতাংশ বিনিয়োগ হয়। এর বেশির ভাগই বেসরকারি বিনিয়োগ। মানবসম্পদের উন্নয়নে কোরিয়া ভকেশনাল মানে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে। শিল্প খাতের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পৃক্ততা থাকায় চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমশক্তি জোগান দেওয়া সম্ভব হয়।
এ ছাড়া কোরিয়ায় ১৯৮৩ সালে শুল্ক-করের ভার ছিল ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ১৯৯৪ সালের মধ্যে তা ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা হুন সাহিব সুহ-এর মতে, উচ্চ শুল্ক-করের চাপ সাধারণ মানুষের ওপর বেশি পড়ে। ছয়টি মৌলিক উদ্যোগ কোরিয়াকে আজকের অবস্থানে এনেছে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। এগুলো হলো মানবসম্পদ ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ, কার্যকর আমলাতন্ত্র; স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতি, উৎপাদন খাত থেকে রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বেসরকারি খাতনির্ভর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।
নীতি প্রণয়নে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ: সেমিনারে মূল প্রবন্ধের ওপর বিশেষ বক্তা ছিলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করার সুপারিশ করেন। ফাহমিদা খাতুন বলেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন রাজনীতি মুক্ত হতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সঠিক ও কার্যকর নীতি প্রণয়ন বিঘিœত হয় বলে তিনি মনে করেন।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ও প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, ‘দেশে অনেক ভকেশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে; কিন্তু শিল্প খাতের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমশক্তি পাওয়া যায় না। গত এক দশকে আমরা পোশাক খাতের পাশাপাশি চামড়াপণ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা নিয়ে কথা শুনেছি; কিন্তু কার্যকর নীতির অভাবে এসব খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।’
মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে বাংলাদেশকে কোরিয়ার মতো রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরের পরামর্শ দেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জাইদি সাত্তার।
মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামতে এক বছর লাগবে: পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, সার্বিক মূল্যস্ফীতি আগের মতো ৬ শতাংশে নামতে বড়জোর এক বছর সময় লাগবে। আগামী অক্টোবর-নভেম্বর মাসের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করবে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখন আমাদের বড় সমস্যা (বিগ ক্রাই)। সবাই এটি নিয়ে চিন্তিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের অভ্যন্তরীণ কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। এটি বাইরে থেকে এসেছে।’ ডিমের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে শামসুল আলম বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। যদি ডিম ব্যবসায়ে সিন্ডিকেট থাকে, তাহলে তা ভাঙবে। ডিমের দাম অবশ্যই কমবে। কারণ, ডিম পাচার হয়ে দেশের বাইরে যায় না। দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকটের কারণে ডিমের দাম বাড়ছে। আমি অবশ্য এখনই সিন্ডিকেটকে দায়ী করব না।’