ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনিদের মধ্যে লড়াই যেভাবে তীব্র হয়ে উঠেছে তা একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সংঘাতে এরই মধ্যে পাঁচ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। শনিবার (৭ অক্টোবর) ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে আচমকা হামলা শুরু করলে এই সহিংসতা শুরু হয়। কিন্তু ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের এই সংঘাতের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। চলুন জেনে নেওয়া যাক-
১০০ বছরের পুরোনো সংকট: মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন নামে যে এলাকা, সেটি ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
তখন ফিলিস্তিনে যারা থাকতেন, তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরবরা, সেই সঙ্গে ছিল কিছু ইহুদীও। কিন্তু এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্রিটেনকে দায়িত্ব দেয় ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। ইহুদিরা এই অ লকে তাদের পূর্বপুরুষদের দেশ বলে দাবি করে। কিন্তু আরবদেরও দাবি, এই ভূমি তাদের এবং এবং তারা ইহুদিদের জন্য সেখানে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টার বিরোধিতা করে। ১৯২০ থেকে ১৯৪০ দশকের মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদি ফিলিস্তিনে যেতে শুরু করে এবং তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ইউরোপে ইহুদি নিপীড়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়ংকর ইহুদি নিধনযজ্ঞের পর সেখান থেকে পালিয়ে এরা নতুন এক মাতৃভূমি তৈরির স্বপ্ন দেখছিল। ফিলিস্তিনে তখন ইহুদি-আরবদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয়। একই সঙ্গে সহিংসতা বাড়ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেও। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে দুই টুকরো করে দুটি পৃথক ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলো। জেরুজালেম থাকবে একটি আন্তর্জাতিক নগরী হিসেবে। ইহুদি নেতারা এই প্রস্তাব মেনে নেন, কিন্তু আরব নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। জাতিসংঘের এই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি।
ব্রিটিশরা এই সমস্যার কোনো সমাধান করতে না পেরে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ছাড়ে। ইহুদি নেতারা এরপর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। বহু ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ জানান এবং এরপর যুদ্ধ শুরু হয়। প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সৈন্যরাও যেখানে যায় যুদ্ধ করতে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে তখন ঘরবাড়ি ফেলে পালাতে অথবা চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনাকে ‘আল নাকবা’ বা ‘মহাবিপর্যয়’ বলে থাকেন। পরের বছর এক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে যখন যুদ্ধ শেষ হলো, ততদিনে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ অ ল দখল করে নিয়েছে। জর্ডান দখল করেছিল একটি অ ল, যেটি এখন পশ্চিম তীর বলে পরিচিত। আর মিশর দখল করেছিল গাজা। জেরুজালেম নগরী ভাগ হয়ে যায়, ইসরায়েলি বাহিনী দখল করে নগরীর পশ্চিম অংশ, আর জর্ডানের বাহিনী পূর্ব অংশ।
দু’পক্ষের মধ্যে যেহেতু কখনোই কোনো শান্তিচুক্তি হয়নি, তাই উভয় পক্ষই অপর পক্ষকে দোষারোপ করতে থাকে। দুই পক্ষের মধ্যে পরের দশকগুলোতে এরপর আরও বহু যুদ্ধ হয়েছে।
১৯৬৭ সালে আরেকটি যুদ্ধে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের পূর্ব জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীর, সিরিয়ার গোলান মালভূমি, গাজা, এবং মিশরের সিনাই অ ল দখল করে নেয়। বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি শরণার্থী থাকেন গাজা এবং পশ্চিম তীরে। প্রতিবেশী জর্ডান, সিরিয়া এবং লেবাননেও রয়েছেন অনেক ফিলিস্তিনি। ইসরায়েল এই ফিলিস্তিনি এবং তাদের বংশধরদের কাউকেই আর নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে দেয়নি। ইসরায়েল বলে থাকে, এদের ফিরতে দিলে সেই চাপ ইসরায়েল নিতে পারবে না এবং ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
ইসরায়েল এখনো পশ্চিম তীর দখল করে রয়েছে। গাজা থেকে তারা যদিও সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে, জাতিসংঘের দৃষ্টিতে এটি এখনো ইসরায়েলের দখলে থাকা একটি এলাকা।
ইসরায়েল এখন পুরো জেরুজালেম নগরীকেই তাদের রাজধানী বলে দাবি করে। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে চায়। পুরো জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কেবল যুক্তরাষ্ট্রসহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশ।
গত ৫০ বছর ধরে ইসরায়েল এসব দখলীকৃত জায়গায় ইহুদি বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে। ছয় লাখের বেশি ইহুদি এখন এসব এলাকায় থাকে। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইনে এগুলো অবৈধ বসতি এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়। তবে ইসরায়েল তা মনে করে না।
এখন কী ঘটছে? পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা থাকেন, তাদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের উত্তেজনা প্রায়শই চরমে ওঠে।
গাজা শাসন করে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে। গাজার সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল এবং মিশর, যাতে হামাসের কাছে কোনো অস্ত্র পৌঁছাতে না পারে। গাজা এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ইসরায়েলের নানা পদক্ষেপ ও কঠোর বিধিনিষেধের কারণে তারা খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। অন্যদিকে ইসরায়েল দাবি করে, ফিলিস্তিনিদের সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের এই কাজ করতে হয়।
মূল সমস্যাগুলো কী? ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা কিছু ইস্যুতে মোটেও একমত হতে পারছে না। এর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ব্যাপারে কী হবে; পশ্চিম তীরে যেসব ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো থাকবে নাকি সরিয়ে নেওয়া হবে; জেরুজালেম নগরী কি উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে; আর সবচেয়ে জটিল ইস্যু হচ্ছে- ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন।
ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনিদের মধ্যে প্রায় তিন দশক ধরেই শান্তি আলোচনা চলছে থেমে থেমে। কিন্তু সংঘাতের কোনো সমাধান এখনো মেলেনি।
তাহলে ভবিষ্যৎ কী? এক কথায় বলতে গেলে, খুব সহসা এই পরিস্থিতির কোনো সমাধান মিলবে না। সংকট সমাধানে সবশেষ একটি উদ্যোগ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এটিকে ‘ডিল অব দ্য সে ুরি’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এই উদ্যোগকে নাকচ করে দিয়েছিলেন একেবারে একতরফা উদ্যোগ বলে। ফলে ট্রাম্পের সেই উদ্যোগ খুব একটা কাজে আসেনি। ভবিষ্যতের যেকোনো শান্তিচুক্তির আগে দু’পক্ষকে জটিল সব সমস্যার সমাধানে একমত হতে হবে। সেটি যতদিন না হচ্ছে, এই সংঘাত চলতেই থাকবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা