বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে দেশের সাতটি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৪ কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গতকাল মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য-১ শাখা।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে দেশে প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি পিস ডিমের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে ডিমের বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় ও বাজারদর স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে সাময়িকভাবে সীমিত সময়ের জন্য এ আমদানি অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ আমদানির অনুমতির মেয়াদ আগামী ৩১/১২/২০২৪ খ্রি. পর্যন্ত বহাল থাকবে। আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকার দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর মেসার্স মিম এন্টারপ্রাইজকে এক কোটি পিস, যশোর চৌরাস্তা মোড়ের মেসার্স তাওসিন ট্রেডার্সকে এক কোটি পিস, সাতক্ষীরার লবশা এলাকার মেসার্স সুমন ট্রেডার্সকে ২০ লাখ পিস, রংপুরের ভগী এলাকার আলিফ ট্রেডার্সকে ৩০ লাখ পিস, রাজধানীর মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার হিমালয়কে এক কোটি পিস, শান্তিনগরের মেসার্স প্রাইম কেয়ার বাংলাদেশকে ৫০ লাখ পিস এবং তেজকুনিপাড়ার মেসার্স জামান ট্রেডার্সকে ৫০ লাখ পিস ডিম আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে।
যেসব শর্তে ডিম আমদানি করা যাবে: (ক) The World Organization for Animal Health (WOAH)-এর গাইডলাইন অনুযায়ী বার্ড ফ্লু মুক্ত জোনিং/কম্পার্টমেন্টালাইজেশনের স্বপক্ষে রপ্তানিকারক দেশের ঈড়সঢ়বঃবহঃ অঁঃযড়ৎরঃু কর্তৃক জোনিং/কম্পার্টমেন্টালাইজেশনের সার্টিফিকেট/ঘোষণা দাখিল করতে হবে;
(খ) আমদানিকৃত ডিমের প্রতিটি চালানের জন্য রপ্তানিকারক দেশের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত/ক্ষমতাপ্রাপ্ত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু ভাইরাস ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মুক্ত মর্মে সনদ দাখিল করতে হবে;
(গ) সরকার কর্তৃক নির্ধারিত শুদ্ধ-কর পরিশোধ ও অন্যান্য বিধি-বিধান প্রতিপালন করতে হবে;
(ঘ) ডিম আমদানির প্রতি চালানের অন্যূন ১৫ (পনের) দিন পূর্বে সংশ্লিষ্ট সংগনিরোধ কর্মকর্তাকে অবহিত করতে হবে; (৩) আমদানির অনুমতি পাওয়ার পরবর্তী ৭ দিন পর পর অগ্রগতি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দাখিল করতে হবে।
ডিম থেকে শুল্ক-কর প্রত্যাহারে আবারও সুপারিশ
চলতি বছর বন্যার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের মাঠ ও খামার। এ কারণে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের ওপর শুল্ক কমানোর সুপারিশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্যারিফ কমিশন। ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে আলু ও পেঁয়াজের ওপর বিদ্যমান শুল্ক-কর কমানো হয়। সে সময় ডিমের ওপর প্রযোজ্য শুল্ক প্রত্যাহারেরও সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
এমন অবস্থায় ডিমের দাম ডজনপ্রতি বেড়ে ১৮০-১৮৫ টাকা হয়েছে। এতে ফের ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্ক প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। ডিম আমদানিতে বর্তমানে ৩৩ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হয়।
গতকাল মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যনীতি বিভাগ থেকে দেওয়া এক চিঠিতে এনবিআরকে আবারও অনুরোধ করা হয়েছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন থেকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য পেঁয়াজ, আলু ও ডিম আমদানিতে শুল্ক-করাদি হ্রাসকরণ বিষয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন এনবিআরে পাঠানো হয়। সুপারিশ অনুযায়ী ৪ সেপ্টেম্বর এনবিআর থেকে আলু ও পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। এতে স্থানীয় বাজারে এ দুটো পণ্যের মূল্যে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে বলে দেখা গেছে।
অন্যদিকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ডিম আমদানিতে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী শুল্ক ছাড়ের বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি স্থানীয় বাজারে ডিমের পর্যাপ্ত সরবরাহে ঘাটতিজনিত কারণে এর দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, গত এক মাসে ডিমের স্থানীয় মূল্য ১৫ শতাংশ এবং ১ বছরে ২০ দশমিক ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রতিক বন্যার কারণে পোলট্রি শিল্পের ক্ষতি হওয়ায় এবং পরিপূরক অন্য খাদ্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে ডিমের সরবরাহ ব্যবস্থায় এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় স্থানীয় বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য দেশের পোলট্রি শিল্পে সুরক্ষা বিবেচনায় সুনির্দিষ্ট মেয়াদে শুল্ক ছাড়ের মাধ্যমে ডিম আমদানির অনুমতি প্রদান করা হলে পোলট্রি শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের সম্ভাবনা কম। শর্ত সাপেক্ষে আমদানিযোগ্য পণ্য হওয়ায় সরকারের অনুমতি ছাড়া ডিম আমদানি করা যায় না। গত বছরগুলোতে ডিম আমদানি না হওয়ার কারণে স্বল্প মেয়াদে এই শুল্ক-করাদি ছাড়ের ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতিরও আশঙ্কা নেই। বর্তমানে ডিম আমদানিতে ৩৩ শতাংশ শুল্ক-কর অব্যাহত রয়েছে। কমিশন মনে করে, আমদানি পর্যায়ে ডিমের ওপর শুদ্ধ-করাদি স্বল্প সময়ের জন্য প্রত্যাহার করা হলে সাধারণ জনগণ স্বস্তির জায়গা খুঁজে পাবে। এ অবস্থায় স্থানীয় বাজারে উচ্চ মূল্যের প্রবণতা রোধে এবং বৃহৎ জনস্বার্থে উপর্যুক্ত সূত্রে প্রেরিত প্রতিবেদন অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য হিসেবে স্বীকৃত ডিমের উপর সুনির্দিষ্ট মেয়াদে শুল্ক-কর প্রত্যাহার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুনরায় অনুরোধ করা যাচ্ছে।
সংকটের অজুহাতে প্রতিদিনই বাড়ছে দাম: সরকারি হিসাবে দেশে বছরে ডিমের উৎপাদন হয় ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ৯৭ লাখ পিস। এর বিপরীতে চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৬০ লাখ পিস। এ হিসাবে চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত থাকছে ৩০ শতাংশ। অথচ ব্যবসায়ীরা উৎপাদনের সংকট দেখিয়ে প্রতিদিনই বাড়াচ্ছেন ডিমের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডজনপ্রতি বেড়েছে ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত। খোলাবাজারে এখন প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়।
প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগ, দেশের পোলট্রি পণ্যের বাজারের সিংহভাগই বড় কয়েকটি কোম্পানির দখলে। তারাই মূলত বাজারের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ বেশি দামে ডিম বিক্রি হলেও প্রান্তিক খামারিরা পাচ্ছেন না ন্যায্যমূল্য।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে গতকাল ফার্মের ডিমের হালি বিক্রি হয় ৫৮-৬০ টাকা করে। যদিও সরকার নির্ধারিত দামে নিত্যপণ্যটি সর্বোচ্চ দাম হওয়ার কথা ৪৮ টাকা। গত সপ্তাহেও এসব ডিমের হালি ছিল ৫৫ টাকা করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও দাম বাড়ছে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করে পদক্ষেপ নেয়া গেলে দাম কমিয়ে আনা সম্ভব। আবার সবজি, মাছ ও মাংসের দাম বাড়ার প্রভাব ডিমের ওপর পড়েছে বলেও মনে করেন তারা। মৌসুমগত কারণেই এখন ডিমের চাহিদা বেশি। আর এ সুযোগে ছয়-সাতবার হাতবদল হওয়ায় উত্তপ্ত হচ্ছে ডিমের বাজার।
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার চুপ থাকায় ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে বাজার অস্থির করছেন। নতুন সরকারের প্রথম দুই সপ্তাহে অবশ্য দাম বাড়েনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাজারে কোনো পদক্ষেপ না থাকায় দাম বাড়তে থাকে।’
দেশে বর্তমানে দৈনিক সাড়ে চার কোটি ডিমের চাহিদা থাকলেও চার কোটি পিস উৎপাদন হচ্ছে বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। অথচ সরকারি হিসাবে উৎপাদন হচ্ছে চাহিদার চেয়েও বেশি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৬০ লাখ পিস। বিপরীতে উৎপাদিত হয় ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ৯৭ লাখ। উদ্বৃত্ত থাকে ৫৬৫ কোটি ৩৭ লাখ পিস ডিম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮০৬ কোটি ৪৮ লাখ, উৎপাদিত হয়েছে ২ হাজার ৩৩৭ কোটি ৬৩ লাখ পিস। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫৩১ কোটি ১৫ লাখ পিস।
এর আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) উদ্বৃত্ত থাকে ৫৭৬ কোটি ৬৭ লাখ পিস, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯১ কোটি ৭২ লাখ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ কোটি ৭৯ লাখ পিস ডিম। অর্থাৎ কয়েক বছর ধরেই চাহিদার তুলনায় ডিমের উৎপাদন বেশি।
চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদন হলেও বাজার সিন্ডিকেটের কারণেই দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন প্রান্তিক খামারিরা। এক্ষেত্রে বড় কয়েকটি গ্রুপের দায় দেখছেন তারা। পাশাপাশি তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি থেকে দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দিনে চার কোটি ডিমের চাহিদা থাকলেও উৎপাদন হয় সাড়ে চার কোটি পিস। কিন্তু বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করছে। তেজগাঁও ডিম সমিতি মেসেজের মাধ্যমে সারা দেশে দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। মুরগির ফিড ও একদিনের মুরগির দামও নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। ফলে ডিমের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। তাই ডিমের দাম কমাতে হলে সবার আগে এ সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।’
ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করছে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি। এ বিষয়ে সংগঠনটির সভাপতি আমান উল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের তেজগাঁও থেকে দিনে মাত্র ১৪-১৫ লাখ ডিম সরবরাহ করা হয়। কাজেই এখান থেকে দাম নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। আমরা মেসেজের মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করি না। কেউ এমনটা করে থাকলে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে।’ দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘এখন বৃষ্টির সময়, এ সময় ডিমের চাহিদা এমনিতেই বেশি থাকে। অন্যদিকে টানা বৃষ্টির কারণে অনেকে ফার্ম থেকে ডিম সরবরাহ করতে পারেননি। তবে আগামী দু-এক মাসে বাজারে শীতের সবজি এলে ডিমের দাম কমে আসবে।’
চাহিদার তুলনায় গত কয়েক অর্থবছরে বেশি উৎপাদন হওয়ার পরও দিন দিন বেড়েছে ডিমের দাম। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক খুচরা বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালের বাজারে ডিম বিক্রি হয়েছে ২৭ থেকে ৩০ টাকা হালি। ২০২২ সালের মে মাসে এসে হালিপ্রতি দাম দাঁড়ায় ৩৭ থেকে ৪২ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৬ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বরের বাজারমূল্যের তালিকায় দেখা যায়, প্রতি হালি ডিম ৩৬ থেকে ৩৮ টাকায় বিক্রি হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি।
গত বছরের মে মাসের বাজারমূল্যে দেখা যায়, হালিপ্রতি ডিমের বাজারদর বাড়ে আগের বছরের তুলনায় ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ওই সময় বাজারে ডিম বিক্রি হচ্ছিল ৪৭ থেকে ৫০ টাকা দরে। আর অক্টোবরে গিয়ে এ দাম আরো বেড়ে ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় গিয়ে ঠেকে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। বর্তমানে ফার্মের ডিমের হালি ৬০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও দাম নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে মনিটরিং জোরদারের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বাপন দে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতি পিস ডিমে নির্ধারিত দামের চেয়ে ৩-৪ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। কারণ বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না। ছয়-সাতবার ডিম হাতবদল হচ্ছে। আর প্রতিজনই লাভ নিচ্ছেন। ফলে উৎপাদনকারী কম লাভ পাচ্ছেন, কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে বাজার মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন। তবে মাছ-মাংস ও সবজির দাম বাড়ার প্রভাবও কিছুটা পড়েছে ডিমের ওপর। আর চাহিদা বাড়লে ব্যবসায়ীদের লাভ করার প্রবণতাও বেড়ে যায়।’
ডিমসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে বন্যাকে সামনে আনছেন ব্যবসায়ীরা। সাম্প্রতিক এ বন্যা নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বন্যায় দেশে ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে মোট ক্ষতির মধ্যে পোলট্রি খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল মাত্র ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। বাজার বিশ্লেষকরাও বলছেন, বন্যায় পোলট্রি খাতের কিছুটা ক্ষতি হলেও তা সারা দেশে প্রভাব ফেলার মতো ছিল না।
ডিমের বাজার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ার পেছনে কাজী ফার্মস পোলট্রি ফিড অ্যান্ড হ্যাচারিসহ বড় কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয় বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে। কিন্তু করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে দায়ী করা হয় ‘ভুল’ সরকারি পরিসংখ্যান এবং সরবরাহ সংকটকে। এ বিষয়ে কাজী ফার্মস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডিম নিয়ে সরকারি হিসাব সম্পূর্ণ ভুল। সরকারি সংস্থা বা সরকার যখন উৎপাদন দেখায় তখন সবসময় বেশি বেশি দেখায়। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও দেখা যায় উৎপাদন বেশি, তার পরও দেখা যায় দেশে নেই বলে আমদানি করতে হয়। তখন বলা হয়, পেঁয়াজ লুকিয়ে রেখে দাম বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে ডিমের দৈনিক উৎপাদন সাড়ে তিন কোটির মতো। সারা দেশে একসময় দৈনিক সাড়ে পাঁচ কোটির মতো উৎপাদন হয়েছে। সেটা দিয়ে আমাদের চাহিদা মেটানো গেছে। প্রায় পাঁচ কোটি সবসময়ই উৎপাদন হতো, কিন্তু এখন এটা সাড়ে তিন কোটি। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কম।’
সরবরাহ সংকটের কোনো খবর অবশ্য সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে নেই। সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ থেকে ডিম ও মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তখনো সংস্থাটির কাছে দেশে বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ডিমের উৎপাদন বেশি থাকার তথ্য ছিল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বাজারে ডিমের যৌক্তিক দর নির্ধারণের কাজটি সম্পাদন করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে করি না। চাহিদা ও সরবরাহের তথ্য নিয়েই আমরা দাম নির্ধারণ করেছি। তবে দাম কেন মানা হচ্ছে না তা জানার জন্য মঙ্গলবার (আজ) আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসব। এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিশেষ যৌথ টিম গঠন করা হয়েছে, যেখানে ভোক্তা অধিকার ও আমাদের লোকজনও থাকবে। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে বাজারে তারা মনিটরিংয়ের কাজ করবে।’
বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে ইলিশের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। এখন ডিমের বাজারও বেসামাল। একটি ডিমে প্রায় ৬ গ্রাম আমিষ থাকে। যার বাজারমূল্য গতকাল ছিল ১৪-১৫ টাকা। ফলে সাধারণ মানুষের আমিষের জোগানেও টান লেগেছে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। পরে তাকে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি।