রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৩ পূর্বাহ্ন

সলিম উম্মাহর রূহানি সংস্কার

মাসুম আলভী:
  • আপডেট সময় বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪

আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অগণিত নবী ও রাসূল প্রেরণ করেন, সত্য ও সুন্দরের বার্তাবাহকরূপে। মানুষকে অন্যায় ও পাপের কাজ থেকে বিরত রাখতে সতর্ককারী হিসেবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি তোমাকে সত্যসহ পাঠিয়েছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে; আর এমন কোনো জাতি নেই যার কাছে সতর্ককারী আসেনি।’ (সূরা ফাতির, আয়াত-২৪) রূহ পরিশুদ্ধ করে, সুনির্মল মানুষ গড়তে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আত্মশুদ্ধির দাওয়াত দিতে গিয়ে কটুকথা, অত্যাচার, শারীরিক নির্যাতন, সামাজিক হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। তবুও বিন্দুমাত্র দমে যাননি। অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবজাতিকে আলোর বার্তা অবিরাম দিয়ে যান। কারণ মনন-মানস নিষ্কলুষ বা সংস্কার ছাড়া বৃহৎ উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেক নবী ও রাসূল সর্বাগ্রে রূহানি সংস্কার করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি। সুতরাং আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১০)
মনন-মানস গঠন : এক বংশ, রক্তের সম্পর্ক হওয়া সত্ত্বেও আবু লাহাব, আবু জাহল মহানবীর সা:-এর চরম দুশমন ছিলেন। অহঙ্কার, স্বার্থবাদী নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে মনগড়া রীতি-নীতি সমাজে আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। যুগে যুগে ফেরাউনের উত্তরসূরিরা কায়েমি শক্তি বাস্তবায়ন করতে মনন-মানসের সংস্কারকদের মিথ্যা অপবাদ, অত্যাচার ও দেশত্যাগে বাধ্য করে। তাদের অন্তর থাকা সত্ত্বেও বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর আমি তো জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় রয়েছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা বুঝে না; তাদের চোখ রয়েছে, তা দিয়ে তারা দেখে না এবং তাদের কান রয়েছে, তা দিয়ে তারা শুনে না। এরা চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তা অপেক্ষাও অধিক পথভ্রষ্ট। তারাই উদাসীন।’ (সূরা আরাফ, আয়াত-১৭৯) নবুয়ত লাভের পর মহানবী সা: মনন-মানস গঠনে মনোযোগী হন। মজবুত ঈমান, আল্লাহর আনুগত্য এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করলে জান্নাতে আর বিপরীতে শিরকের ভয়াবহ পরিণতি জাহান্নাম। পার্থিব লোভ লালসা, প্রবৃত্তির অনুসরণ দুনিয়া ও আখিরাতে ধ্বংস ডেকে আনে আর আল্লাহভীরুদের জন্য রয়েছে দুনিয়াতে কল্যাণ এবং পরকালীন মুক্তি আর অনাবিল শান্তি। মানুষের সামনে নানা চিত্র তুলে ধরেন, যা প্রবল অত্যাচার ও নিপীড়নের সময় মনোবল দৃঢ় রাখতে সাহায্য করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘নিশ্চয় আমি তোমার কাছে যথাযথভাবে এই কিতাব নাজিল করেছি; অতএব আল্লাহর ইবাদত করো তাঁরই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে।’ (সূরা জুমা, আয়াত-২) তিনি বুঝাতে সক্ষম হন, মুসলমানরা পরস্পর ভাই ভাই। গোত্র ভিন্ন হলেও আল্লাহর জন্য সবাই এক সুতোয় আবদ্ধ। পরস্পর সংঘবদ্ধ, সহযোগী ও আশ্রয়দানকারী মনোভাবের কারণে অল্প সময়ে ইসলামের সুমহান বার্তা দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আর তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালোবাসার সঞ্চার করেছেন। এরপর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে।’ (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত-১০৩)
মনন-মানস সংস্কারে মুহাম্মদ সা:- মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে বিচক্ষণরা অপরাধবোধ অনুভব করে এবং সংশোধনের চেষ্টা করে। রূহের পরিশুদ্ধতা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। তাই সময়ের প্রয়োজনে ও মানবজাতিকে সংশোধনের জন্য আল্লাহ তায়ালা নবী ও রাসূল প্রেরণ করেন। আত্মশুদ্ধির জন্য মহানবী সা: অপরাধীর প্রতি কথায় নম্রতা ও আচরণে বিনয় প্রদর্শন করেন এবং অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলেন। প্রয়োজনে রাগ ও ক্ষমা করে দেন। আবু উমামা আল-বাহেলি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, একদিন রাসূল সা:-এর কাছে এক যুবক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন। এ কথা শুনে লোকজন চিৎকার দিয়ে উঠল। কিন্তু রাসূল সা: যুবকটিকে কাছে নিয়ে বললেন, কেউ তোমার মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হোক এটা কি তুমি চাও? যুবকটি বলল, আপনার জন্য আমি কোরবান হই। কোনো মানুষ চায় না তার মায়ের সাথে কেউ ব্যভিচার করুক। রাসূল সা: আবার বললেন, কেউ তোমার মেয়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হোক এটা কি তুমি চাও? যুবকটি বলল, আপনার জন্য আমি কোরবান হই। কোনো মানুষ চায় না তার মেয়ের সাথে কেউ ব্যভিচার করুক। এভাবে রাসূল সা: তার বোন, ফুফু ও খালার কথা উল্লেখ করেন আর যুবকটি তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। এরপর রাসূল সা: যুবকটির গায়ে হাত রেখে বলেন, হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন। তার অন্তরকে পরিচ্ছন্ন করে দিন। তার লজ্জাস্থানকে হিফাজত করুন।’ (মুসনাদে আহমদ-৪১১)
আত্মশুদ্ধিতে আদর্শ : মানুষের পরিশুদ্ধিতে আদর্শ তথা ধর্মবিশ্বাস হলো অন্যতম মূল উপাদান। গোত্র, বর্ণ, জাতি, ভাষা, অঞ্চল ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও আনসার ও মুহাজির বন্ধুতে পরিণত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে।’ (সূরা আহজাব, আয়াত-২১) ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের মনন-মানস এত উচ্চতায় পৌঁছে যায় যে, লোমহর্ষক নির্যাতনে বেলাল, খাববাবরা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাননি। কারণ তারা জানেন, জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনের জান-মাল বিক্রি হয়ে গেছে। দুনিয়ার সামান্য দুঃখ-কষ্ট অনন্ত সুখের তুলনায় তুচ্ছ। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে, আর আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে জিহাদ করেছে, আল্লাহর কাছে তারা বড়ই মর্যাদাবান আর তারাই সফলকাম।’ (সূরা তাওবা, আয়াত-২০)
মনন গঠনে মহানবী সা:-মহানবী সা:-এর জীবন বইয়ের মতো প্রতিটি অধ্যায়, পরিচ্ছদ মানুষের পাঠ উপযোগী, যা অধ্যয়নে মনন-মানসের উৎকর্ষ সাধন হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘নিঃসন্দেহে সে সফলকাম হয়েছে, যে তাকে পরিশুদ্ধ করেছে এবং সে ব্যর্থ হয়েছে, যে তা (নাফস)-কে কলুষিত করেছে।’ (সূরা আশ শামস, আয়াত : ৯-১০) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মহানবী সা: যে সব কাজ করতেন, তার সব কিছু মনন সংস্কারে সহায়ক। মহানবী সা: বড়দের শ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ, সাথীদের কাছে বিশ্বস্ত, পরিবার-পরিজনের কাছে আদর্শ অভিভাবক, প্রতিবেশী, সমাজ এমনকি শত্রুর কাছে আমানতদার ও ইজ্জতের রক্ষক। সালাত ও আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে ছিলেন একনিষ্ঠ। দম্ভের সাথে চলাফেরা করতেন না; বরং বিনয়ের সাথে চলাফেরা করতেন। দৃষ্টি সংযত ও লজ্জাস্থান হিফাজতে রাখতেন। কর্কশ ও অহেতুক কথা বলতেন না; বরং মুচকি হাসি দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন। নিয়মিত পরিচর্যা করতেন চুল, দাড়ি, গোঁফ ও নখের। মিথ্যা, উপহাস, ঠাট্টা-তামাশা করতেন না। সবার মতামতের সম্মান করতেন এবং সর্বক্ষেত্রে ধৈর্যের পরিচয় দিতেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘অবশ্যই মুমিনগণ সফল হয়েছে, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়াবনত। আর যারা অনর্থক কথা ও কর্ম থেকে বিমুখ। আর যারা জাকাতের ক্ষেত্রে সক্রিয়। আর যারা তাদের নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজতকারী। তবে তাদের স্ত্রী ও তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে তারা ছাড়া, নিশ্চয় এতে তারা নিন্দিত হবে না। এরপর যারা এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী। আর যারা নিজেদের আমানতসমূহ ও অঙ্গীকারে যতœবান। আর যারা নিজেদের সালাতগুলো হিফাজত করে। তারাই হবে ওয়ারিস।’ (সূরা মুমিনুন, আয়াত : ১-১০) মনন সংস্কারের মধ্য দিয়ে মহানবী সা: সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, নৈতিকসহ সব সংস্কারের পথ সুগম করেন।
আজকের বিশ্বে মুসলিম উম্মাহর মনন-মানসের সংস্কারে আগ্রহ অপ্রতুল। পশ্চিমা সংস্কৃতির পেছনে ছুটে রূহ মৃতপ্রায়। তবুও যেটুকু আছে, সেখানেও চারিত্রিক দৈন্য, চিন্তা-ভাবনায় অদূরদর্শিতা, মতামতে একগুঁয়ে, কর্মে অনীহা ও অধৈর্য। কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন অনাগ্রহে অন্তর কলুষিত হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখিরাত সর্বোত্তম ও স্থায়ী।’ (সূরা আ’লা, আয়াত : ১৬-১৭) মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের জন্য মৌলিক বা প্রধান সংস্কার হলো মনন-মানসের সংস্কার। এই সংস্কার ফলপ্রসূ হলে সব ধরনের বিপ্লব সাধন করা সম্ভব। কেননা, মহানবী সা: মক্কা জীবনে মনন-মানসের সংস্কার করেন; পরে রাষ্ট্র সংস্কারে মনোনিবেশ করেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com