‘কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমার আজাব অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বেলায় অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল। আর যখন আমার আজাব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল তখন তাদের মুখে এ ছাড়া আর কোনো কথাই ছিল না যে, সত্যিই আমরা জালেম ছিলাম।’ (সূরা আল আরাফ ৪-৫) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন : ‘পূর্ববর্তী ইবরাহিমের জাতি এবং আদ, সামুদ ও নূহের জাতি এবং মাদায়েনবাসী ও মুতাফিকাতধারীদের ইতিহাস কি তারা জানে না? তাদের কাছে নবীরা সুস্পষ্ট নির্দেশমালা নিয়ে এসেছিল। আল্লাহ তাদের ওপর জুলুম করেননি বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করেছিল। পক্ষান্তরে ঈমানদার নারী-পুরুষরা পরস্পরের মিত্র ও সহযোগী। তারা ভালো কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজে নিষেধ করে।’ (সূরা : তাওবা : ৭০-৭১)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রায় সারা কুরআনেই ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির ইতিহাস বিশ্ববাসীর শিক্ষা গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহ বলেন : ‘তাদের প্রত্যেককে আমি দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়েছি এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেককে ধ্বংস করে দিয়েছি। আর সেই জনপদের ওপর দিয়ে তো তারা যাতায়াত করেছে, যার ওপর নিকৃষ্টতম বৃষ্টি বর্ষণ করা হয়েছিল। তারা কি তার অবস্থা দেখেনি? প্রকৃতপক্ষে এরা পরকালে ফিরে যেতে হবে তা চিন্তা করে না।’ (সূরা ফুরকান : ৩৯-৪০) ‘জনপদের লোকেরা কি এখন এ ব্যাপারে নির্ভয় হয়ে গেছে যে, আমার শাস্তি কখনো অকস্মাৎ রাত্রিকালে তাদের ওপর এসে পড়বে না, যখন তারা থাকবে নিদ্রামগ্ন ? অথবা তারা নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে যে, আমার মজবুত হাত কখনো দিনের বেলায় তাদের ওপর এসে পড়বে না, যখন তারা খেলাধুলায় মত্ত থাকবে ? এরা কি আল্লাহর কৌশলের ব্যাপারে নির্ভীক হয়ে গেছে? অথচ যেসব সম্প্রদায়ের ধ্বংস অবধারিত তারা ছাড়া আল্লাহর কৌশলের ব্যাপারে আর কেউ নির্ভীক হয় না।’ (সূরা আরাফ : ৯৭-৯৯) ‘যদি জনপদের লোকেরা ঈমান আনত এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতসমূহের দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা তো প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই তারা যে অসৎ কাজ করে যাচ্ছিল তার জন্য আমি তাদের পাকড়াও করেছি।’ (সূরা আরাফ : ৯৬) এসব জাতি ধ্বংসের মূল কারণ হিসেবে তাদের নবী ও রাসূলদের অস্বীকার, অসৌজন্যমূলক আচরণ ও হত্যা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘এদের পূর্বে নূহের কওম, আসহাবুর রাস, সামুদ, আদ, ফেরাউন, লুতের ভাই, আইকাবাসী এবং তুব্বা কওমের লোকেরাও অস্বীকার করেছিল। প্রত্যেকেই রাসূলদের অস্বীকার করেছিল এবং পরিণামে আমার শাস্তির প্রতিশ্রুতি তাদের জন্য কার্যকর হয়েছে।’ (সূরা কাফ : ১২-১৪) এ ছাড়া ধ্বংসের আরো বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। যখনই কোনো জাতি আল্লাহর হেদায়াত হতে মুখ ফিরিয়ে তাগুতের নেতৃত্বে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে পৃথিবীকে মানুষের বাস অনুপযোগী করে তোলে এবং পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব দুঃসহ এক অভিশাপে পরিণত হয়, তখন আল্লাহর আজাব এসে তাদের নাপাক অস্তিত্ব থেকে দুনিয়াকে মুক্ত করে। আল-কুরআনে উল্লেখিত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ধ্বংসের কারণ বর্ণনা দেয়া হলো :
আদ আল-কুরআনের সূরা আরাফ, হুদ, মুমিন ও আহকাফ, শুআরা, আনকাবুত ও হা-মীম আস সিজদায় এ জাতির আলোচনা করা হয়েছে। হজরত হুদ আ: কে এ জাতির কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। আদ ছিল আরবের প্রাচীনতম জাতি। তাদের অতীত কালের প্রতাপ-প্রতিপত্তি ও গৌরবগাথা প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছিল। তারপর দুনিয়ার বুক থেকে তাদের নাম নিশানা মুছে যাওয়াটাই প্রবাদে রূপ নেয়। কুরআনের বর্ণনা মতে, এ জাতির আবাসস্থল ছিল ‘আহকাফ’ এলাকা। এ এলাকাটি হিজায, ইয়ামন ও ইয়ামামার মধ্যবর্তী ‘রাবয়ুল খালী’র দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে এদের আবাস ভূমি ওমান থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃৃত ছিল। আল কুরআন থেকে তাদের ধ্বংসের কারণ জানা যায়। জুলুমই ছিল তাদের ধ্বংসের প্রধান কারণ।
এ ধরনের আরেকটি পরিচিত জাতির নাম সামুদ। আল-কুরআনের সুরা আরাফ, হুদ, হিজর ও নামলে এ জাতির আলোচনা করা হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম আরবের যে এলাকাটি আজও ‘আল-হিজর’ নামে খ্যাত সেখানেই ছিল এদের আবাস। আজকের সৌদি আরবের অন্তর্গত মদিনা ও তাবুকের মাঝখানে হিজায রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে, তার নাম মাদায়েনে সালেহ । এটিই ছিল সামুদ জাতির কেন্দ্রীয় স্থান। সামুদ জাতি পাহাড় কেটে যেসব বিপুলায়তন ইমারত তৈরি করেছিল এখনো হাজার হাজার একর এলাকাজুড়ে সেগুলো অবস্থান করছে। তাবুক যুদ্ধের সময় নবী সা: যখন এ এলাকা অতিক্রম করছিলেন তখন তিনি মুসলমানদের এ শিক্ষণীয় নিদর্শনগুলো দেখান এবং এমন শিক্ষাদান করেন যাতে একজন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তির শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তাদের ধ্বংসের কারণ ছিল, তারা দাম্ভিক ছিল এবং অন্যের ওপর জুলুম করত। ফলে তারা ভূমিকম্পের দ্বারা পাকড়াও হয়।
এভাবে আরেক পরিচিত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি হলো, লুত। আল কুরআনের সূরা আরাফ ও সূরা কাফে এ জাতির আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমান যে এলাকাটিকে ট্রান্স জর্ডান বলা হয় সেখানেই ছিল এ জাতির আবাস। ইরাক ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী স্থানে এ এলাকাটি অবস্থিত। এদের শহরগুলোর মধ্যবর্তী এলাকাগুলো এমনই শ্যামল সবুজে পরিপূর্ণ ছিল যে মাইলের পর মাইলজুড়ে বিস্তৃৃত এলাকা বাগান মনে হতো। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করত। কিন্তু আজ এ জাতির নাম-নিশানা দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমনকি তাদের জনপদগুলো কোথায় অবস্থিত ছিল তাও আজ ঠিকভাবে জানা যায় না। মৃত সাগরই তাদের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে টিকে আছে। বর্তমানে এটি ‘লুত সাগর’ নামে পরিচিত। পাথর বৃষ্টি দিয়ে তাদের ধ্বংস করা হয়। সূরা হুদে তাদের জনপদকে উল্টিয়ে দিয়ে ধ্বংসের কথাও বলা হয়েছে। কারণ তারা পৃথিবী এমন নিকৃষ্ট কাজ প্রথম চালু করেছিল যা আগে কেউ কখনো করেনি, তা হলো মেয়েদের বাদ দিয়ে পুরুষদের দ্বারা কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘আর লুতকে আমি পয়গাম্বর করে পাঠাই। তারপর স্মরণ করো, যখন সে সম্প্রদায়ের লোকদের বলল : ‘তোমরা কি এতটাই নির্লজ্জ হয়ে গেলে যে, দুনিয়ায় ইতোপূর্বে কেউ কখনো যা করেনি তোমরা এমন অশ্লীল কাজ করে চলেছ? প্রকৃত পক্ষে তোমরা একেবারেই সীমালঙ্ঘনকারী গোষ্ঠী।’ (সূরা ফুরকান : ৮০-৮১)
সাবা আরেক সমৃদ্ধশালী জাতি। আল্লাহ তায়ালা তাদের সামনে জীবনোপকরণের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং পয়গাম্বরদের মাধ্যমে এসব নিয়ামাতের শুকরিয়া আদায় করার আদেশ দান করেছিলেন। কিন্তু ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে তারা আল্লাহকে অস্বীকার করে। ফলে আল্লাহ ‘সাইলুল আরিম’ নামের বাঁধভাঙা বন্যার মাধ্যমে সাবা এলাকা ধ্বংস করে দেন। যে এলাকা একসময় জান্নাতসদৃশ ছিল তা আগাছা ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘সাবার জন্য নিজেদের আবাসেই ছিল একটি নিদর্শন। দুটি বাগান ডানে ও বামে। খাও তোমাদের রবের রিজিক থেকে এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। স্বাস্থ্যকর শহর এবং ক্ষমাশীল পালনকর্তা। এরপর কিন্তু তারা মুখ ফিরাল। শেষ পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে পাঠালাম বাঁধভাঙা বন্যা এবং তাদের দুটি বাগানের জায়গায় অন্য দুটি বাগান দিয়ে দিলাম যেখানে ছিল তিক্ত এবং বিস্বাদ ফল ঝাউগাছ ও সামান্য কিছু কুল। এ ছিল তাদের কুফুরীর প্রতিদান যা আমি তাদের দিয়েছি এবং অকৃতজ্ঞ মানুষ ছাড়া অন্য কাউকে আমি এহেন প্রতিদান দেই না।”(সুরা সাবা ঃ ১৫-১৭
আল কুরআনে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর মধ্যে আরো যাদের নাম উল্লেখ রয়েছে, তারা হলো, আহলে মাদইয়ান, তুব্বা জাতি, বনি ইসরাইল, আসহাবে উখদুদ, আসহাবুল কারিয়্যাহ, আসহাবুস সাবত, আসহাবুল রাস ও আসহাবে ফিল। তাদের প্রত্যেকের ধ্বংসের কারণ ছিল আবাধ্যতা, সীমালঙ্ঘন, জঘন্যতম কাজে লিপ্ত হওয়াসহ মানুষের ওপর জুলুম করা এবং বিভিন্নভাবে নিজেদের ওপরও জুলুম করা। আল কুরআনে এই জাতিগুলোর ইতিহাস উল্লেখ করে পৃথিবীবাসীকে সাবধান করা হয়েছে।