শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০১:২০ পূর্বাহ্ন

আগামীকাল দিবাগত রাতে পবিত্র শবে বরাত

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, শনিবার থেকে পবিত্র শাবান মাস গণনা শুরু হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামীকাল শুক্রবার ১৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে পবিত্র শবে বরাত পালিত হবে। হিজরি ১৪৪৬ বর্ষপরিক্রমা বা চান্দ্র মাসের অষ্টম মাস পবিত্র শাবান মাস। শাবান আরবি শব্দ অর্থ শাখা প্রশাখা।আর শাবান মাস এলেই চারদিকে ইবাদতের সুবাতাস বইতে শুরু করে। মুমিন হৃদয় জেগে ওঠে। নিজেদেরকে প্রভুপ্রেমে বিলিয়ে দেন বিনীদ্র রজনীতে।
ইবাদত-বন্দেগিতে কাটান দিনের বেশিরভাগ সময়। আসছে রমজানের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে মানসিকভাবে গড়ে তোলার অপূর্ব সুযোগ শাবান মাস।এ শাবান মাস হাদিসের আলোকে বিভিন্ন বিবেচনায় একটি ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস। মুসলিম উন্মাহর এ মাসে কিছু করণীয় রয়েছে। শাবান মাসের আগের মাস অর্থাৎ হিজরি বর্ষপরিক্রমায় সপ্তম মাস হচ্ছে পবিত্র রজব মাস। রাসূল (সা.) রজবের চাঁদ উঠলে দোয়া করতেন : ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান’ অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। ‘আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন’ এ কথার অর্থ হচ্ছেথ রমজান পর্যন্ত আমাদের জীবন দান করুন। যেন আমরা রমজান মাস পেয়ে অধিক হারে ইবাদত বন্দেগি, রোজা, তারাবি, লাইলাতুল কদরের ইবাদত, ইতিকাফ ইত্যাদির মাধ্যমে মহান পবিত্র রমজান মাসের ফজিলত লাভে ধন্য হই। এ জন্য পবিত্র রজব মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর রমজানের চাঁদ দেখা পর্যন্ত উপরোল্লিখিত দোয়াটি পাঠ করা সুন্নত বা মুস্তাহাব।
যেহেতু পবিত্র রমজান মাস বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস, সেহেতু পূর্ব থেকেই এ মাসের ইবাদত-বন্দেগির জন্য প্রস্তুতি নেওয়াটাই একজন মুমিনের কর্তব্য। হজরত রাসূল (সা.)-এর উপরোক্ত দোয়া-ই প্রমাণ করে তিনি পবিত্র রজব মাস শুরু থেকেই রমজানের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকতেন। বিভিন্ন হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় হজরত মুহাম্মদ (সা.) পবিত্র রজব ও শাবানে রমজানের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। রমজানে অধিক ইবাদতের জন্য সময়-সুযোগ বের করতেন। মানসিকভাবে তৈরি হতেন। আর এ কারণেই তিনি পবিত্র শাবানের দিন, তারিখ গুরুত্বসহকারে হিসাব রাখতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূল (সা.) পবিত্র শাবানের (দিন, তারিখ হিসাবের) প্রতি এত অধিক লক্ষ্য রাখতেন যা অন্য কোনো মাসের ক্ষেত্রে রাখতেন না (সুনানে আবু দাউদ ১/৩১৮)। অনেক হাদিসেই বর্ণিত হয়েছে : হজরত মুহাম্মদ (সা.) পবিত্র শাবানের চাঁদের দিন, তারিখের হিসাব রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
সুতরাং পবিত্র শাবান মাসের দিন-তারিখের হিসাব রাখাটাই সুন্নত এবং মুমিনদের করণীয়। পবিত্র শাবান মাসে অধিকহারে নফল রোজা রাখা উত্তম। এ প্রসঙ্গে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত উন্মে সালামা (রা,) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি হজরত নবী করিম (সা.) শাবান ও রমজান ব্যতীত দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি নবী করিম (সা.)কে শাবান মাসের মত এত অধিক (নফল) রোজা রাখতে আর দেখিনি। এ মাসের অল্প কিছুদিন ব্যতীত বরং বলতে গেলে সারা মাসটাই তিনি নফল রোজা রাখতেন (জামি তিরমিযী ১/১৫৫)। ১৪ ফেব্রুয়ারি রবিবার দিবাগত রাতে পবিত্র শবে বরাত পালিত হবে। পবিত্র শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত, অর্থাৎ পনের শাবান রাত হচ্ছে পবিত্র শবেবরাত, ভাগ্য রজনী, এ রাতের অশেষ ফজিলত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। বছরের শ্রেষ্ঠ পাঁচটি রজনীর অন্যতম এ রাত। এ রাতের করণীয় সম্পর্কে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন : পনের শাবান রাতে (শবেবরাত) তোমরা জেগে থেকে ইবাদত কর এবং পরদিন রোজা রাখ। এ জন্য শবেবরাতে জেগে থেকে ইবাদত করা এবং পরদিন রোজা রাখা উত্তম।
শাবান মাসে গুরুত্বপূর্ণ ৪টি আমল বা কাজ সুন্নাহর আলোকে শাবান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো জেনে নেয়া খুবই জরুরি। এ মাসে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ৪টি আমল বা কাজ। যা আমলে নববি বা সুন্নাতি আমল হিসেবে বিবেচিত।রমজান মাসের আমলগুলো ঠিকভাবে উদযাপন করতে শাবান মাসে ৪টি আমল বেশি বেশি করা খুবই জরুরি। শাবান মাসে এ আমলগুলো যথাযথভাবে আদায় করতে পারলেই রমজানের ইবাদতগুলো করা সহজ হবে। পরিপূর্ণ ফজিলত ও বরকত লাভ সম্ভব হবে। তাহলো :
বেশি বেশি রোজা রাখা।হজরত উসামা বিন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! শাবান মাসে আপনাকে যত রোজা রাখতে দেখি, অন্য মাসে এতো পরিমাণ রোজা রাখতে দেখিনি। অর্থাৎ আপনি কেন এ মাসে এতবেশি রোজা রাখেন?রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটি এমন একটি মাস। যা রজব এবং রমজানের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুইটি মাসের মধ্যে পড়ে। আর অধিকাংশ মানুষ এ মাসটি সম্পর্কে গাফেল থাকে। অর্থাৎ এ মাসটি সম্পর্কে তারা বেখবর থাকে, উদাসিন থাকে। যার ফলে তারা ভালো আমল করে না। তারা ভাবে যে, রমজান তো আছেই।’ (নাসাঈ)। মানুষ যে সময়টিতে আল্লাহকে স্মরণ করে না, সে সময়টিতে আল্লাহকে স্মরণ করায় রয়েছে অনেক ফজিলত ও মর্যাদা।
এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করতেন। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ আমলটি উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য অন্যতম শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘শাবান মাসে বেশি রোজা রাখার অন্য একটি কারণ হলো- এ মাসে আল্লাহর কাছে মানুষের আমলনামাগুলো উপস্থাপন করা হয়। আর আমি চাই রোজা থাকা অবস্থায় আমার আমলনামা আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করা হোক।’ এখন প্রশ্ন থাকতে পারে যে, কখন, কিসের ভিত্তিতে মানুষের আমলনামা আল্লাহর কাছে পৌছানো হয়? হ্যাঁ, ৩ অবস্থায় মানুষের আমলনামা আল্লাহর কাছে পৌছানো হয়। আর তাহলো– দৈনন্দিন ভিত্তিতে।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ফেরেশতারা প্রতিদিন এবং রাতে পালাবদল করে তোমাদের (মানুষের ) কাছে আসে। আসরের সময় এবং ফজরের সময় তারা একত্রিত হয়। অর্থাৎ আসরে একদল আসে আরেকদল চলে যায়। আবার ফজরের সময় একদল আসে আর আরেকদল চলে যায়। এভাবে ফেরেশতারা দৈনন্দিন ভিত্তিমে মানুষের আমল সকাল-বিকাল আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করে থাকে।আল্লাহ তাআলা তো বান্দার সব অবস্থাই জানেন। তারপরও তিনি সকাল-সন্ধ্যার এসব ফেরেশতাকে তিনি প্রশ্ন করেন- তোমরা আমার বান্দাদের কী অবস্থায় রেখে এসেছ? তখন ফেরেশতারা বলেন, আমরা সকাল-সন্ধ্যায় গিয়ে দেখেছি বা দেখে এসেছি, তারা নামাজ পড়ে।
হজরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু আরও বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ মর্মে জিজ্ঞাসা করলাম। হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলুন; যে আমল করলে আল্লাহ তাআলা আমাদের অনেক কল্যাণ দান করবেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি রোজা রাখ। অন্য কোনো আমল রোজার মতো হতেই পারে না।’ বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা।সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং প্রসিদ্ধ ইমামগণ শাবান মাস আসলেই বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কুরআন নাজিলের মাসের বরকত লাভে এ মাসে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করায়ও রয়েছে ফজিলত ও মর্যাদা। বেশি বেশি সাদাকাহ (দান-সহযোগিতা) করা।অনুরূপভাবে সালফে সালেহিনগণ এ মাসজুড়ে বেশি বেশি দান-সাদকাহ করে রমজানের দান-সাদকার অভ্যাস নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলতেন। যাতে রমজান জুড়ে দান-সাদকায় অতিবাহিত করা যায়। আবার গরিব অসহায়দের রমজানের কষ্ট দূর করা যায়। বেশি বেশি ইসতেগফার করা। রমজানে রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাতের জন্য শাবান মাস থেকেই সালফে সালেহিনগণ বেশি বেশি ইসতেগফার করতেন। যা মানুষকে রমজানজুড়ে আমলে উদ্যোগী করে তোলে। পরিশেষে বলতে চাই, মুমিন মুসলমানের উচিত, শাবান মাস জুড়ে নিজেদের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখা। তাই এই বিশেষ ফজিলতের মাসে প্রত্যেক মোমেনের জন্য করণীয় হলো উপরোক্ত আমল গুলোকে ফলো করা। এই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগা।আপনি রমজান পাচ্ছেন কিনা তা জানা নেই,তাই আপনি এই মাসকে, আজকের দিনকে আপনার জন্য সুযোগ মনে করে নিন,এবং প্রস্তুতি নিন।আগামীকাল আপনি পাবেন কিনা তার নিশ্চয়তা নেই।আজ থেকেই আমল শুরু করে দিন। রমাজানের প্রস্তুতি নিন।আর হাদিসের ভা-ার পর্যালোচনা করে পবিত্র শাবানের এসব ফজিলত ও করণীয় সম্পর্কে জানা যায়। সুতরাং এর বাইরে নিজেদের মনগড়া কোনো কিছু করা সম্পূর্ণ অনুচিত আল্লাহ তায়া’লা আমাদেরকে বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুক আমিন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com