রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত বনানীতে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ২০১০ সালে ছিল ১৩ হাজার টাকা। কভিডের আগে তা কমে ১১ হাজার টাকায় নেমে আসে। বর্তমানে দাম বেড়ে প্রতি বর্গফুট ১৩ হাজার ৫০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। একইভাবে কভিড-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারা, লালমাটিয়া, মিরপুর, উত্তরা, শ্যামলী, কলাবাগান ও শান্তিনগর এলাকায়। রাজধানীর এই ১১টি এলাকার গড় দাম বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৫ সালে ফ্ল্যাটের গড় মূল্য ছিল বর্গফুটপ্রতি ৩ হাজার ৬৪ টাকা। ২০১০ সালে এই দাম বেড়ে হয় ৯ হাজার ৫০০ টাকা। কভিডের আগে তা কমে গিয়ে ৯ হাজার ৯১ টাকায় ঠেকে। ২০২০ সালের শেষ দিকে সেই দাম আবার বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি বর্গফুট ১১ হাজার ৪৫৫ টাকায়।
কভিডে মানুষের জীবন-জীবিকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মহামারী প্রতিরোধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জারি করা হয়েছে লকডাউন। তবে এর মধ্যেও দেশের প্রপার্টি মার্কেট বা আবাসন খাতে জমজমাট ভাব বজায় রয়েছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্রেতাদের বেশির ভাগই সরকারি চাকরিজীবী। তাদের মধ্যে চাহিদা বাড়ার কারণেই মহামারীকালেও খাতটি ভালো ব্যবসা করছে। দেশের আবাসন খাতের জন্য সবচেয়ে ভালো সময় ছিল গত দশকের শেষ ভাগ। ২০১০ সালে সর্বোচ্চে উঠেছিল ফ্ল্যাটের দাম। এরপর হঠাৎ ধস নামে এ খাতে। দীর্ঘ সময়জুড়ে মন্দায় থাকা আবাসন খাতকে টেনে তুলতে বেশকিছু নীতিসহায়তা দিয়েছে সরকার। যার প্রভাবে এক দশক পর আবাসন খাতে আবারো মূল্যবৃদ্ধিতে উল্লম্ফনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। করোনার মধ্যেও বেড়েছে ক্ষেত্রবিশেষে।
শীর্ষ আবাসন প্রতিষ্ঠান শেলটেক ও আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ২০১০ সালে ফ্ল্যাটের দাম বর্গফুটপ্রতি ৭ হাজার টাকা ছিল। চাহিদার নি¤œমুখিতায় কভিডের আগেও সেখানে একই দামে ফ্ল্যাট কেনাবেচা হয়। তবে বর্তমানে ওই এলাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ৯ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। শুধু মোহাম্মদপুর নয়, রাজধানীর সব এলাকায়ই কম-বেশি ফ্ল্যাটের দাম বাড়তে শুরু করেছে। কলাবাগান এলাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ২০১০ সালে ছিল ৭ হাজার টাকা। প্রাক-কভিড কালেও এ দামে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু বর্তমানে প্রতি বর্গফুটের দাম ৯ হাজার ৫০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সাধারণ মানুষের কাছে টাকা অপ্রতুল। কভিডের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মাঝারি ব্যবসায়ীরাও। এর পরও চাহিদা বাড়ছে আবাসন খাতের। চাহিদার এ ঊর্ধ্বমুখিতায় চালকের আসনে রয়েছেন প্রধানত সরকারি চাকরিজীবীরাই। সরকারের দেয়া ঋণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে ফ্ল্যাট ও জমি কিনছেন তারা। সরকারি চাকুরেদের ৭০-৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত গৃহঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে। আবাসন খাতের কোম্পানিগুলোর দাবি, জমি ও ফ্ল্যাটের ব্যবসা স¤প্রসারণের ক্ষেত্রে এ সুবিধা বড় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া গত বছর ঘোষিত করবহির্ভূত আয় বিনিয়োগের অনুমোদনও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ সুযোগ ঘোষণার পর আবাসন খাতে করমুক্ত বিনিয়োগ এসেছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া গৃহঋণে ৯ শতাংশ সুদ, জমি হস্তান্তরে করহার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা এবং স্ট্যাম্প ডিউটি ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ করার মতো পদক্ষেপগুলোও খাতটির স¤প্রসারণে ভূমিকা রেখেছে। মহামারীর আগে গত বছরের শুরুতেও বেশ জমজমাট ছিল আবাসন খাত। মাঝে মহামারীর ধাক্কা এলেও ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নয়ন ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের মধ্যভাগের পর খাতটিতে বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। বর্তমানে মহামারীর নতুন প্রবাহ ও লকডাউনের মধ্যেও সে ধারা অব্যাহত আছে।
অনলাইনভিত্তিক আবাসন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বিপ্রপার্টির তথ্য বলছে, ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধেই খাতটি পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটতে শুরু করে। ব্যাপক চাহিদা দেখা যায় জমি ক্রয়ে। বছর শেষ হতে হতে জমির চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় শুরুর তুলনায় ১০ গুণে। প্রপার্টির চেয়ে জমিতে বিনিয়োগে মুনাফা বেশি। ফলে এ সময়ে জমির চাহিদাও ছিল বেশি। এক্ষেত্রে ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে পূর্বাচলের মতো এলাকাগুলোয় জমির দাম এখনো অনেকটাই গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। তবে সেখানেও তা দ্রুত হারে বাড়ছে। ফলে এসব এলাকায় জমি কেনায় অনেকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ ধারা চলতি বছরেও অব্যাহত থাকবে। কভিডের প্রভাব কাটলে সাধারণ মানুষও জমিতে বিনিয়োগ শুরু করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে আবাসন খাতের পরিস্থিতি এখন প্রাক-কভিড পর্যায়ে ফিরে গিয়েছে বলে অভিমত ব্যবসায়ীদের। তারা বলছেন, কভিডের আগে অনেক ডেভেলপার মূলধনি তহবিল সংগ্রহে বেশি নির্ভরশীল ছিলেন ফ্ল্যাট বিক্রির ওপর। মহামারীতে ক্রেতার সংখ্যা হ্রাস তাদের তারল্য সংকটে ফেলে দেয়। চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা অ্যাপার্টমেন্টের দামও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনতে বাধ্য হন। দাম এখনো মহামারীর পূর্বাবস্থায় আসেনি। এ পরিস্থিতিকে অনেকে সম্ভাবনা হিসেবেও দেখছেন। তাদের ভাষ্যমতে, দাম কমে যাওয়ায় আবাসন খাতে এখন বিনিয়োগের এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে প্রপার্টির দামও বাড়বে।
দেশের আবাসন খাতের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাশিওর গ্রুপ, বসুন্ধরা, নাভানা রিয়েল এস্টেট, বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেড (বিটিআই), আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, কনকর্ড রিয়েল এস্টেট, আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক, র্যাংগস প্রপার্টিজ লিটিটেড, শান্তা হোল্ডিংস লিমিটেড এবং শেলটেক। এছাড়া রয়েছে বিপ্রপার্টি, নকশি হোম লিমিটেড।
শেলটেকের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে যারা নিরাপদ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন ও পারছেন, তারাই বড় ক্রেতা। তাদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন। পেশাজীবীদের মধ্যে আরেক ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তারা বিলাসী আবাসন চাচ্ছেন; কিন্তু স্বল্পমূল্যে ও ছোট আকারের। স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টেরও বেশ চাহিদা বেড়েছে। কর্মজীবী দম্পতিদের মধ্যেই এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বেশি।
এ বিষয়ে শেলটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, চাহিদা বৃদ্ধিতে সরকারি চাকরিজীবীদের বড় ভূমিকা আছে, যেহেতু তারা ঋণ সুবিধা নিতে পারছেন। সরকারের দেয়া সুযোগ-সুবিধার সুবাদে তাদের একটা প্রভাব অবশ্যই আছে। সরকারি কর্মকর্তারা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ পাচ্ছেন। ফলে তারা এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন। এ ধরনের ক্রেতাদের ভালো আগ্রহ আছে। তবে শুধু তারাই নন, ক্রেতাদের মধ্যে আরো নানা পেশার লোক আছেন। বেশি দামি কিছু না, তবে মাঝামাঝি ক্যাটাগরির ৭০-৮০ লাখ টাকার ফ্ল্যাটগুলোর চাহিদা আছে।
আবাসন খাতের আরেক জায়ান্ট বসুন্ধরার কর্মকর্তারাও বলছেন, কভিডের শুরুর দিকে বাজার কিছুটা মন্দা ছিল। এরপর ২০২০ সালের জুলাই-আগস্টের পর থেকে পরিস্থিতি ভালোর দিকে। ওই সময় থেকে দেশের গোটা আবাসন খাতেই ইতিবাচক ধারা দেখা গেছে। বর্তমান চাহিদা কভিডের পূর্ব অবস্থায় ফিরে গেছে। বসুন্ধরা হাউজিংয়ের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (সেলস) বিদ্যুৎ কুমার ভৌমিকও মনে করছেন, এক্ষেত্রে সরকারি চাকুরেদের ঋণ সুবিধা বড় ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের ব্যবস্থা আছে। ক্রেতারা তিন বা চারজন মিলে জমি বা প্রপার্টি কিনতে পারছেন। স্বাভাবিকভাবেই এটা একটা বড় প্রভাবক। বাজারে তারল্য প্রবাহও ভালো। প্রচুর নির্মাণ ও উন্নয়নকাজ হচ্ছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যেও যেভাবে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, ততটা প্রভাব দেখা যায়নি। দেশের জনগোষ্ঠী সামান্য সঞ্চয় হলেই প্রপার্টি কেনার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এখন যেহেতু মূল্যটা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আছে, কাজেই মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।
সার্বিকভাবে আবাসন খাতের ব্যবসা যতটা হওয়ার কথা ছিল ততটা খারাপ হয়নি বলে মনে করছেন আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাবের নেতারা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো এক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় কাজ করছে। যেমন নিবন্ধন ফি হ্রাস, আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত আয় ব্যবহারের সুযোগ ইত্যাদি। অন্যদিকে কভিডের কারণে কিছুটা হলেও মূল্য সংশোধন হয়েছে। এসব কারণেই আগ্রহীদের পক্ষ থেকে বেশ ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তবে চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সরবরাহ না থাকলে দামও কিছুটা বাড়তে পারে। কারণ গত দেড় বছরে কোনো নতুন প্রকল্প দেখা যায়নি।
রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, বর্তমানে যে চাহিদা বৃদ্ধি তার কারণের মধ্যে সরকারি লোন ফ্যাসিলিটি যেমন আছে, ব্যাংকগুলোরও হোম লোনের ব্যবস্থা আছে। সরকারি ঋণ সুবিধা চাহিদা বৃদ্ধিতে একটা ভূমিকা রাখছে। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের যে পরিমাণ ঋণ দেয়া হয়, তা ১ হাজার ২০০, ১ হাজার ৩০০ বা ১ হাজার ৫০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের জন্য যথেষ্ট নয়। আমরা চাই সরকার যদি ঋণ সুবিধা বাড়াত তাহলে বাজার পরিস্থিতিটা আরো ভালো হতো। কারণ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেট দেয়া হয় না। বর্তমানে ফ্ল্যাটের দাম সংশোধন হওয়ার পর স্থিতিশীল আছে। এখন দাম আর নিচের দিকে যাচ্ছে না।