খাদ্য ও পানীয়ের একটি বিশেষ প্রকার হলো মাদকতাযুক্ত খাদ্য বা পানীয়। আমরা মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, মানবীয় অপরাধ, পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয় ও বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হলো মাদকতা, অশ্লীলতা ও জুয়া। আধুনিক সভ্যতার সব অবক্ষয়ের মূল বিষয়ও এগুলো। মদপান ও মাদকাসক্তি শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিরই ক্ষতি করে না, উপরন্তু তার আশপাশের সবারই ক্ষতি করে। বিশেষত ওই ব্যক্তির স্ত্রী ও পরিবার-পরিজন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব বিবেকবান মানুষই মদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন; কিন্তু কেউই তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। প্রায় আড়াই শতাব্দী ধরে ইউরোপ ও আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনেক আন্দোলন হয়েছে। নারীরা এসব আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এসব আন্দোলনের ভিত্তিতে গত শতাব্দীতে ইউরোপের অনেক দেশে মদ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়।
আমেরিকায় ১৯২০ সালে মদ নিষিদ্ধ করা হয়; কিন্তু মদব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তদের চাপে ১৯৩৩ সালে তা আবার বৈধ করা হয়। মদ, মাদকতা, মাদকাসক্তি, মদ-নির্ভরতা আধুনিক সভ্যতার ভয়ঙ্কর ব্যাধিগুলোর অন্যতম। এর ফলে নানাবিধ দৈহিক অসুস্থতা, মানসিক অসুস্থতা, লিভার সিরোসিসসহ অন্যান্য মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয় মানুষ। বিশ্বে অগণিত সফল ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, দক্ষ টেকনিশিয়ান, শ্রমিক ও অনুরূপ সফল মানুষদের জীবন ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে মদের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বের ৭৬ মিলিয়ন বা প্রায় ৮ কোটি মানুষ মদ পানের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রকমের কঠিন রোগে ভুগছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মদপানজনিত সমস্যায় ভুগছে। ধর্মীয় অনুভূতি একেবারেই নষ্ট করার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাশিয়ার মানুষ। রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মদপানজনিত মারাত্মক রোগব্যাধিতে ভুগছে। বর্তমান যুগে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মদপান ও মদ-নির্ভরতাকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা বলে চিহ্নিত করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমান বিশ্বের সব রোগব্যাধির ৩.৫ শতাংশ হলো মদপানজনিত। মদপানজনিত রোগব্যাধি ও সম্পদ ধ্বংসের কারণে প্রতি বছর শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ১৮৫ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, ধূমপান ও ড্রাগের চেয়েও মদপান মানবসভ্যতার জন্য বেশি ক্ষতিকর, অথচ বর্তমানে পাশ্চাত্য বিশ্ব ধূমপান ও ‘ড্রাগ’-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও ‘মদের’ বিরুদ্ধে সোচ্চার নয়। কারণ মদপান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলেই তারা ধরে নিয়েছে। যদিও এইডস, ক্যান্সার ও অন্যান্য মরণব্যাধির চেয়েও মদ মারাত্মক সমস্যা।
একমাত্র ইসলামই এ সমস্যা সফলভাবে সমাধান করেছে। ইসলাম মদপান ও সব ধরনের মাদকদ্রব্য হারাম করেছে এবং ভয়ঙ্কর কবিরা গোনাহ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে ঈমানের চেতনায় বেশির ভাগ মুসলিম মদপান থেকে বিরত থাকে। অতি সামান্যসংখ্যক হয়তো প্রবৃত্তির প্ররোচনায় মদপান করে ফেলে। মদপান যেন সমাজে প্রশ্রয় না পায় এবং ঘৃণিত ও নিন্দিত থাকে এ জন্য ইসলামী আইনে মদপান, মাদকদ্রব্য গ্রহণ বা মাতলামির জন্য প্রকাশ্য বেত্রাঘাতের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। কেউ প্রকাশ্যে মদপান করলে, মাদক গ্রহণ করলে বা মাতলামি করলে এবং তার অপরাধ প্রমাণিত হলে সে এ শাস্তি পাবে।
তবে এই শাস্তি কার্যকর করবে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা; কোনো ব্যক্তি এই শাস্তি বাস্তবায়ন করবে না। এভাবে ঈমান, তাকওয়া ও আইনের মাধ্যমে মানবসভ্যতার ভয়ঙ্করতম ব্যাধি মদ ও মাদকতা ইসলাম সবচেয়ে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ বরং র্নির্মূল করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাকে মদ এবং জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। তুমি বলো এতদুভয়ের মধ্যে বড় পাপ রয়েছে এবং মানুষের জন্য কিছু কল্যাণ রয়েছে। তাদের উপকারের চেয়ে তাদের পাপ অধিকতর’ (সূরা বাকারা-২১৯)।
সভ্যতার ইতিহাস ও বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, মদ বা জুয়ার মধ্যে যে কল্যাণকর দিক তা খুবই সামান্য আর এর অকল্যাণ ভয়ানক ও ভয়ঙ্কর। আর এ জন্যই ইসলাম এগুলো নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, মদ, জুয়া, পূজার বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তীর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কর্ম, কাজেই তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও সালাতে বাধা দিতে চায়। তাহলে তোমরা কি বিরত হবে না’ (সূরা মায়িদাহ : ৯০-৯১)?
রাসূলুল্লাহ সা: মদপান বা মাদকদ্রব্য গ্রহণের ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে উম্মতকে সাবধান করেছেন। কোনো মানুষ যখন মদপান করে বা মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে তখন সে আর মুমিন থাকে না। মাদকদ্রব্যের ব্যবহারকারী, প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী, বহনকারী, বিক্রেতা-ক্রেতা বা কোনোভাবে মদ বা মাদক ব্যবসায়ের উপার্জন ভোগকারী অভিশপ্ত বলে তিনি বারবার বলেছেন। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস জেনে নেই- ‘ব্যভিচারী যখন ব্যভিচার করে তখন সে মুমিন থাকে না; মদপানকারী যখন মদপান করে তখন সে মুমিন থাকে না; চোর যখন চুরি করে তখন সে মুমিন থাকে না’ (বুখারি, আস-সহিহ ২/৮৭৫, ৫/২১২০; মুসলিম, আস-সহিহ ১/৭৬-৭৭)।
‘মহান আল্লাহ মদকে অভিশপ্ত করেছেন। আর অভিশপ্ত করেছেন মদ পানকারীকে, মদ সরবরাহকারীকে, মদ বিক্রেতাকে, মদ ক্রেতাকে, মদ প্রস্তুতের ব্যবস্থাকারীকে, মদ বহনকারীকে, যার কাছে মদ বহন করা হয় তাকে এবং মদের মূল্য যে ভক্ষণ করে তাকে। রাসূল সা: বলেন, ‘সব মাদকদ্রব্যই মদ বলে গণ্য এবং সব মাদকদ্রব্যই হারাম’ (বুখারি, আস-সহিহ ৪/১৫৭৯, ৫/২২৬৯; মুসলিম, আস-সহিহ ৩/১৫৮৫-১৫৮৭)।
তিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন : মাদকাসক্ত ব্যক্তি, পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি ও দাইয়ুস ব্যক্তি যে নিজের স্ত্রী-পরিবারের অশ্লীলতা মেনে নেয়’ (আহমদ, আল-মুসনাদ ২/৬৯, ১২৮; হাইসামি, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩২৭; আলবানি, সহিহুত তারগিব ২/২৯৯, হাদিসটি হাসান)।
‘তোমরা মদ-মাদকদ্রব্য বর্জন করবে; কারণ তা হলো সব অকল্যাণ ও ক্ষতির উৎস’ (হাকিম, আল-মুসতাদরাক-৪/১৬২, হাদিসটি সহিহ, আরো দেখুন : ইবনে মাজাহ, আস-সুনান-২/১১১৯, ১৩৩৯)।
লেখক: খতিব, বাইতুল কুদ্দুস জামে মসজিদ, মিরপুর-১০, ঢাকা-১২১৬