শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ০৮:৩৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::

নবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কুরআনি নির্দেশনা

মাওলানা আসজাদ ক্বাসেমী নদবী:
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১

কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মুসলিম উম্মাহকে আদেশ করা হয়েছে রাসূল সা:-এর সঙ্গে সম্মান ও শিষ্টাচারের সাথে আচরণ করতে, রাসূল সা:কে মর্যাদা দিতে এবং রাসূলের ইহতিরাম করতে। গুরুত্বসহ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যেন এমন কোনো আচরণ না পাওয়া যায়, যা আদবের খেলাফ এবং নববী দায়িত্ব ও মর্যাদার সাথে বেমানান। কুরআনের গভীর মুতালায়া থেকে বোঝা যায়, রাসূলের সম্মানের ব্যাপারে মৌলিক পাঁচটি বিষয়ে মুসলিমদেরকে আদেশ করা হয়েছে। নিচে সেই পাঁচটি দিক তুলে ধরা হলো-
১. নাম ধরে ডাকার নিষেধাজ্ঞা : কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা একে অপরকে যেভাবে ডাকো, রাসূল সা:কে সেভাবে ডেকো না।’ (সূরা নূর, আয়াত-৬৩)
এই আয়াতে তিনটি বিষয় উদ্দেশ্য হতে পারে- ক. রাসূলের আহ্বানকে সাধারণ মানুষের আহ্বানের মতো মনে করো না; বরং রাসূলের আহ্বান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলের আহ্বান বিচারক সুলভ আহ্বান। রাসূল সা: ডাকলে আসা আবশ্যক হয়ে যায়। আয়াতের পূর্বাপর থেকে এই তাফসিরই অগ্রগণ্য। তাই বয়ানুল কুরআন এবং তাফসিরে মাজহারিতে এই তাফসির পছন্দ করা হয়েছে। (মাআরিফুল কুরআন-৬/৪৫৫ : অনুবাদক)
খ. রাসূলের দোয়াকে সাধারণ মানুষের দোয়ার মতো মনে করো না; বরং রাসূলের দোয়াই সবচেয়ে বড় নিয়ামত। আর রাসূলের বদদোয়া সবচেয়ে ভয়াবহ।
গ. রাসূল সা:কে একজন সাধারণ মানুষের মতো করে ডেকো না। বরং চূড়ান্ত আদবের সাথে সম্মানসূচক শব্দে ডেকো।
আয়াতের তিনটি উদ্দেশ্যের মধ্যে এই তৃতীয় উদ্দেশ্যটিই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা:-এর বর্ণনা থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, মানুষ রাসূল সা:কে “হে মুহাম্মাদ’ ‘হে আবুল কাসেম’ জাতীয় শব্দে ডাকত। স্বীয় নবীর সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এভাবে ডাকতে নিষেধ করেছেন। ‘হে আল্লাহর নবী’ ‘হে আল্লাহর রাসূল’ জাতীয় শব্দ দ্বারা ডাকতে আদেশ করেছেন।” (তাফসির ইবনে কাছির-৫/১৩০)
বিখ্যাত মুফাসসির ক্বাতাদা বলেন, ‘এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে আদেশ করেছেন তাঁর নবীর ইহতিরাম-আযমত, সম্মান-মর্যাদা, ভয় ও শ্রদ্ধা এবং তাঁর বড়ত্ব ও মহিমা নিজেদের অন্তরে সুদৃঢ়ভাবে গেঁথে রাখতে।’
সাইয়েদ কুতুব শহীদ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন, ‘অন্তরসমূহে রাসূলের সম্মানের তরঙ্গ থাকা আবশ্যক। রাসূল সা:-এর শানে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের সাথে ইহতিরাম ও মর্যাদার মাধুর্য টপকানো একান্ত জরুরি। রাসূল সা:-এর জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকা অপরিহার্য। রাসূল সা:-এর বিনয়ী আর নম্র হওয়া বিশেষ গুণ, সেটা স্বস্থানেই আছে। কিন্তু উম্মতের অন্তরে তাঁর আযমত ও সম্মান থাকা এবং মুখের সাহায্যে সেই সম্মান আর মর্যাদার প্রকাশ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ (ফি যিলালিল কুরআন-৪/২৫৩৫)
মাওলানা আবুল কালাম আযাদ বলেন, ‘তোমাদের পরস্পরের আহ্বান এবং ডাকাকে যেমন মনে করো, আল্লাহর রাসূল সা:-এর আহ্বান ও ডাককে তেমন মনে করবে না। বরং তাঁর প্রতিটি আহ্বান তোমাদের জন্য একেকটি আইন এবং তা মানা আবশ্যক। এখান থেকে বোঝা যায়, যে ব্যক্তি কোনো দলের নেতৃত্ব ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, তার আহ্বানও গুরুত্বের সাথে শুনতে হবে; নচেৎ দলের শৃঙ্খলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে।’ (তরজুমানুল কুরআন-৪/১০০৬)
২. রাসূল সা: থেকে আগে বেড়ে যাওয়া থেকে নিষেধাজ্ঞা : কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে আগ বেড়ে যেও না। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সব কিছু শোনেন, সব কিছু জানেন।’ (সূরা হুজুরাত- ১)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সালাফ থেকে অনেকগুলো বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে। নিচে কয়েকটা উল্লেখ করা হলো-
ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘কুরআন-সুন্নাহর বিরোধিতা করবে না। কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কিছু বলবে না।’ (তাফসিরে তাবারি-২৬/৭৪)
ইমাম দাহহাক রহ. বলেন, ‘জিহাদ ও অন্যান্য শরয়ি বিধানের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানের বিপরীতে নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।’ (তাফসিরে বাগাবি-৪/২০৯)
ইমাম ইবনে জারির রহ. বলেন, ‘নিজেদের জিহাদ ও দ্বীনী বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্তের আগে তাড়াহুড়া করে নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত করবে না। যেন আল্লাহ ও রাসূলের ইচ্ছার বিরোধী এবং হক ও সত্যের বিপক্ষে কিছু করা না হয়ে যায়।’ ‘লা তুকাদ্দিমু’ বা ‘আগ বেড়ে যেও না’ আরবি ভাষায় আদেশ-নিষেধে তাড়াহুড়া করার অর্থে ব্যবহৃত হয়। (তবারি-২৬/৭৪) কুরতুবি রহ. বলেন, ‘কথায় ও কাজে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে অগ্রবর্তী হবে না। রাসূল থেকে আগ বেড়ে যাওয়া মানে আল্লাহ থেকে আগ বেড়ে যাওয়া; কারণ রাসূল তো আল্লাহর কথাই পৌঁছান।’ (আল-জামে লিআহকামিল কুরআন-১৬/৩০০) ইবনে কাছির রহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী, এই আয়াতের উদ্দেশ্য হলো- প্রত্যেক বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগামী হয়ে যাও। (তাফসির ইবনে কাছির-৪/২৪০)
এসব বক্তব্যে মূলত কোনো বিরোধ নেই। আয়াতে সব ধরনের অগ্রবর্তিতা এবং আগ বেড়ে যাওয়াকে নিষেধ করা হয়েছে। প্রত্যেক বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানকে নিজের সিদ্ধান্তের উপর রাখতে আদেশ করা হয়েছে। আয়াতের বাহ্যিকতা থেকে নির্ধারিত কোনো ক্ষেত্রে অগ্রবর্তিতাকে নিষেধ করা হয়েছে বলে অনুমিত হয় না। এই বাহ্যিকতা এই ইঙ্গিত করে যে, প্রত্যেক জিনিসেই অগ্রবর্তিতা নিষিদ্ধ এবং আগ না বাড়ার আদেশটি ব্যাপক। রাসূলের আগে আগে হাঁটা, রাসূলের আগে খাবার শুরু করা সবই এই আয়াতের আওতাভুক্ত। অবশ্য যদি রাসূল সা: স্পষ্ট করে আগে বাড়ার অনুমতি দেন, তাহলে সুযোগ আছে। এই আয়াত যেন এই পয়গাম দিচ্ছে যে, রাসূলের পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করতে হবে, কুরআন-সুন্নাহকে নিজের ইজতিহাদ আর গবেষণার উপরে রাখতে হবে এবং যেকোনো বিষয়ের সমাধান অনুসন্ধানে সর্বপ্রথম কুরআন-সুন্নাহরই দ্বারস্থ হতে হবে।
মুআজ ইবনে জাবাল রা:কে ইয়েমেনের বিচারক করে প্রেরণের সময় রাসূল সা: তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবে? উত্তরে তিনি বললেন, কুরআন অনুযায়ী। রাসূল বললেন, যদি কুরআনে না পাও, তাহলে? মুআজ রা: বললেন, রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ অনুযায়ী। এবারে রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, যদি সুন্নাহতেও না পাও, তাহলে কী করে সিদ্ধান্ত নেবে? উত্তরে মুআজ রা: বললেন, আমি ইজতিহাদ করব। উত্তর শুনে রাসূল সা: তার বুকে হাত রেখে বললেন, কৃতজ্ঞতা সেই আল্লাহর, যিনি স্বীয় রাসূলের দূতকে সেই পদ্ধতির তাওফিক দিয়েছেন, যা তাঁর রাসূল পছন্দ করেন।’ (সুনানে আবু দাউদ) এই ঘটনায় মুআজ রা:-এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ এবং কুরআন-সুন্নাহকে সর্বাগ্রে রাখার প্রতি তার হিম্মত ও পরিকল্পনার কথা পাওয়া যাচ্ছে।
উপরে বর্ণিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূলের সাথে স্বীয় নাম রাসূলের সম্মানার্থে উল্লেখ করেছেন। আর এটা বুঝিয়েছেন যে, কোনো কথা বা কাজে রাসূলের থেকে আগ বেড়ে যাওয়া আল্লাহর সাথে বেআদবি করার সমতুল্য; কারণ রাসূলের কথা তো আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ীই হয়ে থাকে। মোট কথা, সম্মান আর বড়ত্বের আবশ্যিক দাবিই হলো আল্লাহর রাসূল সা: থেকে আগ না বাড়া। বান্দার সৌভাগ্য আর সফলতার ভিত্তি এই আনুগত্য আর সম্মান প্রদর্শনেরই ওপর।
৩. উঁচু আওয়াজে কথা বলার নিষেধাজ্ঞা : কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, নবীর আওয়াজের উপর নিজের আওয়াজকে উঁচু করো না। তোমরা যেমন উচ্চ আওয়াজে পরস্পর কথা বলো, নবীর সাথে তেমন উচ্চ আওয়াজে কথা বলো না। নচেৎ তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে, অথচ তোমরা টেরও পাবে না’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত-৩)।
এই আয়াতে রাসূলের মাজলিসে আওয়াজ উঁচু করতে এবং রাসূলের সাথে উচ্চ আওয়াজে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে; কারণ উচ্চ আওয়াজে কথা বলার মধ্যে তাঁর প্রতি অসম্মান এবং অমর্যাদা প্রকাশ পায়। উচ্চ আওয়াজে কথা বলতে নিষেধ করে দিয়ে রাসূলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এই আয়াতে ভিন্ন আরেকটি বাস্তবতাও তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে স্থান একমাত্র রাসূল সা:-এর জন্য। তিনি ছাড়া অন্য কেউ যতই সম্মানিত হোক না কেন, তাকে অসম্মান করলে ততটা শাস্তি আল্লাহ দেবেন না, যতটা শাস্তি দেবেন কুফরের কারণে। বেশি থেকে বেশি, সেটাকে অসৌজন্যতা এবং অভদ্রতা সাব্যস্ত করা হবে। পক্ষান্তরে রাসূল সা:-এর প্রতি মর্যাদা প্রদানে এবং তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সামান্য ত্রুটিও এত বড় অপরাধ যে, তা দ্বারা মানুষের পুরো জীবনের উপার্জিত নেক আমল এবং সওয়াব সব বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। কারণ রাসূল সা:-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন মূলত আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন। আর রাসূল সা:-এর ব্যাপারে কোনো অসৌজন্যতা, আল্লাহর সাথেই অসৌজন্যতার শামিল। এর পরবর্তী আয়াতে এটাও বলা দেয়া হয়েছে যে, রাসূলের সাথে নিচু আওয়াজে কথা বলা, অন্তরে সুপ্ত থাকা তাকওয়ার বাহ্যিক নিদর্শন। এটাই অন্তকরণের পবিত্রতার প্রমাণ। এ থেকে এটাও স্পষ্ট যে, রাসূলের সম্মুখে উচ্চ আওয়াজে কথা বলা, অন্তরের অপরিচ্ছন্নতা এবং তাকওয়া শূন্যতার উন্মুক্ত নিদর্শন। বর্ণিত আছে, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর উমর রা: এত আস্তে কথা বলতেন, রাসূল সা: দ্বিতীয়বার তাকে না জিজ্ঞেস করলে কী বলেছেন, বুঝতেই পারতেন না।
ইমাম ইবনুল আরাবি রহ: বলেন, ‘জীবিত অবস্থায় রাসূল সা:-এর সম্মান ও ইহতিরাম যেমন আবশ্যক ছিল, ইন্তেকালের পরও ঠিক একইভাবে আবশ্যক। যখনই তাঁর কোনো হাদিস পাঠ করা হবে, প্রত্যেক শ্রোতার জন্য আদব ও সম্মানের সাথে শোনা আবশ্যক। হাদিস পাঠের সময় শ্রোতাদের উঁচু আওয়াজ করা এবং শোনার প্রতি মন না দেয়া অন্যায়’ (ইবনুল আরাবি কৃত আহকামুল কুরআন-৪/১৭১৪)।
ইবনে কাছির রহ: লিখেন, ‘রাসূল সা:-এর রওজার সামনেও উঁচু আওয়াজ করা নিষেধ। রাসূল সা: স্বীয় কবরেও সম্মান পাওয়ার হকদার। রাসূল সা:-এর মসজিদে উচ্চ আওয়াজে পরস্পর আলোচনাকারী দুই ব্যক্তিকে উমর রা: এ জন্যই কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন এবং তাদেরকে ধমক দিয়েছেন’ (তাফসির ইবনে কাছির-৪/২২২)।
মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহি এই আয়াতের পয়গাম ও বাণী উল্লেøখ করতে গিয়ে লিখেন, ‘আওয়াজ উঁচু করার কথা মানুষের অভ্যন্তর সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত সত্তার মতো বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি নিজের আওয়াজকে অন্যের আওয়াজের উপর উচ্চ রাখার চেষ্টা করে, তার এই কাজ মূলত এই সাক্ষ্য প্রদান করে যে, সে নিজেকে শ্রোতা থেকে উপরের স্তরের জ্ঞান করে। এই ধারণা ও ভাবনা অন্যের থেকে উপকার গ্রহণের পথ একেবারেই রুদ্ধ করে দেয়। যদি রাসূলের সাথে কোনো ব্যক্তি এই পদ্ধতি গ্রহণ করে, তাহলে সে তো কেবল রাসূল সা: থেকে উপকৃত হওয়া থেকেই বঞ্চিতই হলো না, বরং আল্লাহর তাওফিক থেকেও মাহরুম হয়ে গেল; কারণ রাসূল সা: তো আল্লাহর কথাই বলেন। আল্লাহর পথই দেখান’ (তাদাব্বুরে কুরআন-৭/৪৮৯-৪৯০)।
৪. নির্জনে কথা বলার বাহানায় কষ্ট দেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা যখন রাসূল সা:-এর সাথে নির্জনে কথা বলতে চাও, তখন নির্জনে কথা বলার আগে কিছু সদকা দেবে। এটা তোমাদের জন্য উত্তম এবং পবিত্রতর। যদি তোমরা সদকা দেয়ার মতো কিছু না পাও, তাহলে আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু’ (সূরা মুজাদালা, আয়াত-১২)।
মুসলমানরা সর্বদাই রাসূল সা: থেকে উপকৃত হতে আগ্রহী হয়ে অপেক্ষায় থাকতেন। সাধারণ মজলিস ব্যতীতও অনেক মানুষ গোপনে নিভৃতে রাসূল সা:-এর সাথে কথা বলতে চাইতেন। রাসূল সা: সবাইকে সময়ও দিতেন। কিন্তু রাসূল সা:-এর জীবন তো অনেক বেশি ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ ছিল। তাই সবাইকে সময় দেয়াও খুব কঠিন ছিল। এ ছাড়া কিছু কিছু মুনাফিকও অনিষ্ট করার জন্য রাসূল সা:-এর সাথে নির্জনে কথা বলত। কিছু সাধারণ মুসলমানও গুরুত্বহীন বিষয়ে রাসূল সা:-এর সাথে নির্জনে দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলত। রাসূল সা: তাদেরকে নিজের সত্তাগত সৌজন্যতার দরুন সময়ও দিতেন। কিন্তু এটা তাঁর জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা:কে এই কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য প্রথম দিকে তাঁর সাথে নির্জনে কথা বলার আগে তাঁর কাছে সদকা প্রদান করার আদেশ করেছেন। তাই এই বিধান আসার পর সর্বপ্রথম আলী রা: এক দিনার সদকা দিয়ে রাসূল সা:-এর সাথে নির্জনে কথা বলেছেন। কিন্তু এই বিধান অল্প ক’দিন পরই রহিত হয়ে গেছে। এই সূরার পরের আয়াতেই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নির্জনে কথা বলার আগে সদকা দিতে কি তোমরা ভয় পেয়ে গেছ? যদি তোমরা সদকা দিতে না পারো- আর আল্লাহ তায়ালাও তোমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, তাহলে পাবন্দির সাথে নামাজ আদায় করো। জাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। আর তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত’ (সূরা মুজাদালা, আয়াত-১৩)।
মুফতি মুহাম্মাদ শফি রহ. লিখেন, ‘এই বিধান যদিও রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু যেই কল্যাণের স্বার্থে এই বিধান দেয়া হয়েছে, সেটা অর্জিত হয়ে গেছে। মুসলমানরা নিজেদের অন্তরে থাকা মুহাব্বতের কারণে এই ধরনের নির্জন মজলিস দীর্ঘ করা থেকে বিরত হয়ে গেছে। আর মুনাফিকরা সাধারণ মুসলমানদের কর্মধারার বিপরীত করতে গেলে তাদের নেফাক প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিরত হয়ে গেছে।’ (মাআরিফুল কুরআন-৮/৩৪৮)
নির্জনে কথা বলার আগে সদকা দেয়ার বিধানের রহস্য বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম রাজি রহ. চারটি রহস্য উল্লেখ করেছেন-
ক. এর মাধ্যমে রাসূল সা:-এর সম্মান ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং তাঁর সাথে নির্জনে কথা বলার গুরুত্ব প্রকাশ করা হয়েছে। মানুষ কষ্টের পর কিছু পেলে, গুরুত্বসহ গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে সহজে কিছু পেলে সেটাকে সাধারণ মনে করে। নির্জনে কথা বলার আগে সদকা দিতে হলে, নির্জনে কথা বলাকে গুরুত্ব দেবে।
খ. এই সদকার মাধ্যমে দরিদ্রদের উপকার হবে।
গ. আখিরাতপ্রত্যাশী ও দুনিয়াপ্রত্যাশীদের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। যারা নির্জনে কথা বলার আগে সদকা প্রদান করল, তারা প্রকারান্তরে আখিরাতের মুহাব্বত ও দুনিয়ার তুচ্ছতা প্রকাশ করল।
ঘ. এর দ্বারা রাসূল সা:-এর আরাম আর শান্তি প্রতিষ্ঠা হলো। কষ্ট-ক্লেশ থেকে তাঁর পরিত্রাণ হলো। (তাফসিরে কাবির-১৫/২৭২)। মোট কথা, এই বিধানের মাধ্যমে রাসূল সা:-এর সম্মান, মহত্ব আর বড়ত্ব বজায় রাখার সবক দেয়া হয়েছে এবং তাঁর সময়ের প্রতি যতœ নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
৫. নবীর পরিবার সম্পর্কীত নির্দেশনা: আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, নবীর ঘরে প্রবেশ করো না। অবশ্য তোমাদেরকে খাবারের জন্য আসার অনুমতি দেয়া হলে ভিন্ন কথা। তখন এভাবে আসবে যে, তোমরা তা প্রস্তুত হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকবে না। বরং যখন তোমাদেরকে ডাকা হবে, তখন যাবে। তারপর যখন তোমাদের খাওয়া হয়ে যাবে, তখন নিজে নিজে চলে যাবে, কথাবার্তায় লিপ্ত হয়ে যাবে না। কারণ, তোমাদের এই আচরণ নবীকে কষ্ট দেয়। কিন্তু তিনি (তোমাদেরকে তা বলতে) সঙ্কোচবোধ করেন। আর আল্লাহ সত্য বলতে সঙ্কোচবোধ করেন না। নবীর স্ত্রীদের কাছে তোমরা কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ পন্থা তোমাদের এবং তাদের অন্তরকে অধিকতর পবিত্র রাখতে সহায়ক হবে। আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া তোমাদের জন্য জায়েজ নেই। তাঁর (ইন্তেকালের) পরে কখনো তাঁর স্ত্রীদেরকে বিয়ে করা তোমাদের জন্য জায়েজ নেই। আল্লাহর কাছে এটি গুরুতর অপরাধ। তোমরা কোনো কিছু প্রকাশ করো বা গোপন করো, আল্লাহ তো প্রতিটি বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন।’ (সূরা আহজাব : ৫৩-৫৪)। এই আয়াতে মোট চারটি বিষয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে-
ক. অনুমতি ব্যতীত মুমিনদেরকে রাসূল সা:-এর রুমে এবং ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এটিও স্পষ্ট করা হয়েছে যে, যারা রাসূল সা:-এর ঘরে খাবারের জন্য দাওয়াত পায়, তারা যেন খাবার প্রস্তুত হওয়ার আগে ঘরে না যায়; কারণ এতে ঘরের মানুষ সঙ্কীর্ণতায় নিপতিত হয়। বরং খাবার প্রস্তুত হওয়ার পর যখন ডাকা হয়, তারা যেন তখনই যায়।
খ. খাবার শেষ হওয়ার পর চলে যাওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময় আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত হয়ে রাসূল সা:কে কষ্ট দিতে নিষেধ করা হয়েছে।
গ. রাসূল সা:-এর স্ত্রীদের সাথে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতে আদেশ দেয়া হয়েছে। পর্দার এই বিধান সব নারীর ক্ষেত্রেই। এখানে শুধু নবীপতীদের কথা বলা হয়েছে বিশেষ প্রেক্ষাপটের প্রতি লক্ষ্য রেখে।
ঘ. রাসূল সা:-এর সম্মানিতা স্ত্রীদের সাথে কোনো মুসলমানের জন্য কখনোই বিয়ে বৈধ না হওয়ার মর্মে নির্দেশনা প্রকাশ করা হয়েছে।কারণ তারা তো মুমিনদের মায়ের স্তরের। চিন্তা করলে বোঝা যায়, এই সব বিধান কেবল রাসূলের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে দেয়া হয়েছে।
নবীর প্রতি সম্মানের এই পাঁচটি নির্দেশনায় মূলত উম্মতের প্রতিটি সদস্যকে সবসময় এবং সব পদ্ধতিতে রাসূল সা:-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সাহাবিরা এই আয়াত এবং বিধানসমূহ অনুযায়ী আমল করে এবং রাসূল সা:-এর সম্মানের হক আদায় করে পুরো উম্মতের সামনে দৃষ্টান্ত প্রকাশ করে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ রাসূল সা:-এর প্রতি সাহাবিদের সম্মান প্রদর্শনের একটি ঘটনার উল্লেখ করা হচ্ছে। সপ্তম হিজরিতে কুরাইশ যখন উরওয়া বিন মাসউদকে হুদাইবিয়ার সন্ধির বিষয়ে রাসূল সা:-এর সাথে কথা বলতে পাঠাল। তখন সে সাহাবিদের অন্তরে রাসূলের প্রতি সম্মানের যে অবাককর নমুনা দেখেছে, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছে, ‘মুহাম্মাদ যখন অজু করে, তখন তাঁর অজুুর পানির উপর সাথীরা ঝাঁপিয়ে পড়ত। মুহাম্মাদ থুথু নিক্ষেপ করলে সাহাবিরা সেই থুথু হাতে নিয়ে চেহারা এবং শরীরে মাখিয়ে নিত। মুহাম্মাদের কোনো চুল পড়ে গেলে, তারা দ্রুত তা লুফে নিত। মুহাম্মাদ কোনো আদেশ করলে, তারা তা বাস্তবায়নে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। যখন তিনি কথা বলেন, তখন তারা একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে থাকে। চোখ মেলে কেউ তাঁর দিকে তাকাতে পারত না।’ এসব দেখে উরওয়া কুরাইশদের কাছে ফিরে এসে বলল, শোনো কুরাইশ, আমি কিসরা, কায়সার এবং নাজাশির দরবার দেখেছি, আল্লাহর কসম, আমি কোনো বাদশাহকে তার প্রজাদের মধ্যে এতটা সম্মানিত আর মর্যাদাবান পাইনি, মুহাম্মাদ সা:কে স্বীয় সাথীদের মধ্যে যতটা সম্মানিত আর মর্যাদাবান পেয়েছি। (সহিহুল বুখারি) সাহাবিদের অন্তরে রাসূলের প্রতি ভালোবাসা আর মর্যাদার যে অবস্থান ছিল, এ ঘটনা ছিল তার একটা ঝলক মাত্র। এই জজবা আর আন্তরিকতা গ্রহণের জন্যই প্রত্যেক মুসলমান নির্দেশিত। এটাই ঈমানি এবং কুরআনি দাবি। অনুবাদ : মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com