আবু মহসিনই হোক সর্বশেষ
আবু মহসিন খানের ঘটনাই হোক সর্বশেষ এমন নির্মম ঘটনা। আর আমরা এমন অসহায়ত্ব দেখতে চাই না। রাষ্ট্র-সমাজ প্রবীণদের দায়িত্ব নিতে হবে। ফেসবুক লাইভে নিজের পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি করে আবু মহসিন খানের (৫৮) আত্মহত্যার ঘটনা সবার চোখ খুলে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ঘটনা তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। সমাজ বিশ্লেষক ও বাধর্ক্য বিশেষজ্ঞরা এ ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলছেন। তারা বলছেন, করোনা মহামারিতে প্রবীণ নাগরিকরা জীবন বাঁচানোর কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ। সন্তানদের জীবন-জীবিকাই যেখানে টালমাটাল এবং সীমাহীন অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন, তখন ইচ্ছা থাকলেও দিশেহারা সন্তানেরা প্রবীণ পিতা-মাতার দায়িত্ব ততটা বহন করতে পারছে না। বিশ্বায়নের যুগে পরিবারগুলো যখন ক্ষুদ্র হয়ে পড়ছে তখন প্রবীণ সদস্যদের সংস্থান নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। একদিকে একাকিত্ব, অন্যদিকে চাওয়া-পাওয়া মেলানোর সামঞ্জস্যহীনতা। নানাবিধ জটিলতায় প্রবীণরা বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ।
এতদিন তা চোখের আড়ালে এসব ঘটলেও গতকাল তা প্রকাশ্যে এসেছে নায়ক রিয়াজের শ্বশুর আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার মধ্যদিয়ে। গত বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাত ১০টার কিছু আগে রাজধানীর ধানম-িতে নিজের বাসায় ফেসবুক লাইভে এসে মাথায় গুলি করে ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় পুলিশ মনে করছে, তার দীর্ঘদিনের একাকী জীবন, ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই, ব্যবসায় লোকসান-সবকিছু মিলিয়ে চরম অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন আবু মহসিন খান। এটাই তার আত্মহননের পথ বেছে নেবার কারণ হতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ। এ বিষয়ে বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, প্রবীণ নিবাসের ব্যবস্থাপক ড. মহসিন কবীর জাগো নিউজকে বলেন, মানসিক চাপে পড়ে একজন মানষ আত্মহত্যা করে। কেউ যখন নিজের সঙ্গে লড়াই করে আর পারে না, সেই সময় মানুষ এই সিদ্ধান্ত নেয়। মেডিকেলের ভাষায় এটা একটা রোগ। বিশ্বায়নের কারণে সামাজিক যে পরিবর্তনের প্রভাব, কাল সেটা আমরা দেখতে পেরেছি। যৌথ পরিবার সব ভেঙে গেছে, এখন সব নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি বা একক পরিবার। মানুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রবীণ বয়সে মানুষের অর্থের সংস্থান হয় না। পরিবার কোনো সাহায্য করে না, কাল আমরা সেটা দেখতে পেরেছি। এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম বাংলাদেশে, আগে কখনো ঘটেনি। এই বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ভিডিওর ১৪ মিনিটে গিয়ে বোঝা গেছে তিনি আসলে সুইসাইড করবেন। যারা দেখছিলেন তারা কিন্তু আগে বোঝেননি। শেষের দিকে তিনি আত্মহত্যার কথা বললেন। দোয়া পড়া শুরু করলেন। এখানও আমি সোসাইটিকে (সমাজ) দোষারোপ করবো। তার আশপাশে কেউ ছিল না? তার ভবনে কেউ ছিল না? কেউ লাইভটা দেখছিল না? তার মানে আমাদের সমাজব্যবস্থা এতটাই ভেঙে পড়ছে যে আমরা একজন আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি না। পাশের ফ্ল্যাটের কেউ যদি দৌড়ে আসতো, কেউ যদি এসে কথা বলতো, কিংবা জড়িয়ে ধরতো, তাহলে এমন ঘটনা ঘটতো না। এই জায়গাটা অ্যাড্রেস করতে হবে।
অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে প্রবীণদের জন্য ব্যবস্থা রাখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সামাজিক ব্যবস্থায় প্রবীণদের সম্মানের সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি পরিবার না দেখে তাহলে সোসাইটি দায়িত্ব নিতে পারে, রাষ্ট্র দায়িত্ব নিতে পারে। আমাদের আরও বেশি প্রবীণবান্ধব হতে হবে। আমরা তো ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে যাইনি। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একজন বয়স্ক মানুষ কেন একা থাকবে। তাহলে কিসের সোসইটি, কিসের প্রতিবেশি যারা খোঁজ-খবর রাখে না? বার্ধক্যে অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না। প্রবীণরা বেশিরভাগ সময়ই এসব উপসর্গের কথা আত্মীয়স্বজনকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন না। এসব কারণে প্রবীণদের এ ধরনের রোগের চিকিৎসাও ঠিকমতো হয় না। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বয়স্কদের শতকরা প্রায় ১৫ জন নানা ধরনের বিষণ্নতায় ভোগেন।
বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বিষণ্নতায় ভোগে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে এই হার প্রায় তিনগুণ।
এ বিষয়ে ড. মহসীন বলেন, প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্য একেবারেই অবহেলিত আমাদের এখানে। কোনো প্রবীণই মানসিকভাবে সুস্থ নন। বার্ধ্ক্যে পৌঁছানোর পর মানুষ সারা জীবনের হিসাব-নিকাশ করতে বসে। যেটা গতকাল আমরা দেখতে পেলাম। সুইসাইড করার আগে ওই ব্যবসায়ী এসব বলেছেন। কী পেলেন, কী হারালেন এ বিষয়গুলো প্রবীণ বয়সেই আসে। তারা একটা মানসিক চাপে থাকেন। আগে একটা সময় ছিল, যখন ছেলে-মেয়ে দায়িত্ব নিতেন, এখন তারা দায়িত্ব নিচ্ছেন না। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতার ইমপ্যাক্ট পড়ে প্রবীণ বয়সে।
‘এ ঘটনা থেকে আমাদের আমাদের শিখতে হবে। এটা কেবল শুরু, ভবিষ্যতে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। এটা আমাদের সমাজের জন্য অ্যালার্মিং। এ ঘটনা থেকে আরও ১০ জন এ ধরনের কাজে উৎসাহিত হতে পারে। বাংলাদেশে এই ট্রেন্ড চালু ছিল না। প্রবীণ মানেই একাকিত্বে ভোগা, বিষন্নতায় ভোগা। এটার নেতিবচক ইমপ্যাক্ট যাতে না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে।’
এ ঘটনা থেকে তরুণ প্রজন্মও অনেক কিছুতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের তরুণদের সাবধান হতে হবে। তরুণ বয়স থেকেই নিজের জন্য পরিকল্পনা করা উচিৎ, শুধুমাত্র ছেলে-মেয়ের ওপর নির্ভরশীল হওয়া ঠিক নয় ইভেন জীবনসঙ্গীর ওপরও না। সবাইকে নিয়ে থাকেতে হবে- এমন পরিকল্পনার পাশাপাশি বার্ধক্যে কীভাবে থাকবো, কী করবো, অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে সেটার একটা প্রি-প্ল্যান রাখতে হবে। এটা নিয়ে তরুণদের ভাবতে হবে।
ফেসবুক লাইভে মহসিনের আত্মহত্যার ভিডিও অপসারণে হাইকোর্টের নির্দেশ: চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান (৫৮) ফেসবুক লাইভে এসে মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার ঘটনার ভিডিও ছয় ঘণ্টার মধ্যে অপসারণে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস, এম, মনিরুজ্জামান সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ বিটিআরসির প্রতি গতকাল বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। এই ভিডিও সবধরনের প্রচার মাধ্যমে প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সকল ডিজিটাল প্লাটফর্ম থেকে এই ভিডিও অপসারণে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিটিআরসিকে আগামী বুধবারের মধ্যে আদালতের আদেশ প্রতিপালনের প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। ঘটনাটি নিয়ে গনমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন তুলে ধরে সিনিয়র অ্যাডভোকেট এ কে এম ফয়েজ আদালতের আদেশ প্রার্থনা করেন। বিষয়টি আমলে নিয়ে আদালত আদেশ দেন।
গত বুধবার রাত পৌনে ১০টার দিকে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান (৫৮)। ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডের ২৫ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন আবু মহসিন খান। আত্মহত্যা করার আগে থেকে তিনি তার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভে কথা বলছিলেন। আত্মহত্যার আগে তিনি লাইভে বলেন, আমি মহসিন। ঢাকায় থাকি। আমার বয়স ৫৮ বছর। কোনো এক সময়ে আমি ভালো ব্যবসায়ী ছিলাম। বর্তমানে আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। ভিডিও লাইভে আসার উদ্দেশ্য হলো, মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং আমার যে এক্সপেরিয়েন্স, সেটা শেয়ার করলে হয় তো সবাই জানতে পারবে। সবাই সাবধানতা অবলম্বন করবে। তার জীবনের বিভিন্ন কষ্টের কথা বলে কালেমা পড়তে পড়তে তিনি নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন। লাইভের ১৬ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের মাথায় তিনি আত্মহত্যা করেন। তার আত্মহত্যার পরও লাইভ চলছিল। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এই লাইভ চলমান থাকে।
মর্মান্তিক এ আত্মহত্যার ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় এবং মানুষ নানাভাবে এর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।
রিয়াজের শ্বশুরের আত্মহত্যা, যা বলছে পুলিশ: চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর ও ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের ফেসবুক লাইভে আত্মহত্যার ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে তার পরিবার। গত বুধবার রাত ১০টার কিছু আগে রাজধানীর ধানম-িতে নিজের বাসায় ফেসবুক লাইভে পিস্তল মাথায় তাক করে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। ধানমন্ডির সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, ময়নাতদন্ত শেষে আবু মহসিন খানের লাশ গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, আবু মহসিন খান যে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আত্মত্যা করেছেন, মাত্র দুইদিন আগেই তিনি সেটির লাইসেন্স নবায়ন করেছেন।
এই ঘটনাটি ঠেকানো যেতো কি না, তা নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। পুলিশ মনে করছে, দীর্ঘ দিনের একাকী জীবন, ক্যান্সারের সাথে লড়াই, ব্যবসায় লোকসান, এই সব কিছু থেকে চরম অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন ৫৮ বছর বয়সী ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান। সেটিই তার আত্মহত্যার পথ বেছে নেবার কারণ হতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ। ধানমন্ডি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া বলেন, ‘ওনার অনেক ডিপ্রেশন ছিলো। বিগত পাঁচ বছর যাবত তার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে অস্ট্রেলিয়া থাকেন। উনি একাকী জীবন যাপন করতেন। তিনি ব্যবসা করতেন কিন্তু অসুস্থতার কারণে ব্যবসাটা ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারেননি। অনেক ব্যবসায়িক লস করেছিলেন তিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যেটা বুঝতে পারলাম এই বয়সী একটা লোক, দীর্ঘদিন এরকম একা থাকা থাকা, এই সবকিছু নিয়েই ওনার ডিপ্রেশনটা ছিল। প্রাথমিকভাবে আমরা তার প্রতিবেশী, আত্মীয়দের সাথে কথা বলে এমনটাই মনে করছি।’
ফেসবুক লাইভ: ফেসবুক লাইভে গুছিয়ে শান্ত গলায় ১৬ মিনিটের বেশি সময় কথা বলেছেন আবু মহসিন খান। কথা বলার সময় সুস্থির ছিলেন। তার চোখের চশমার কাঁচ ঝাপসা দেখাচ্ছিল। নিজের পরিচয় দিয়ে শুরু কথা করেছেন। পরিবারের কয়েকজন সদস্যের প্রতি তিনি সংক্ষুব্ধ সেটি তার কথায় প্রকাশিত হয়েছে। কথার মাঝে তিনি অনেকবার ছোট-বড় বিরতি নিয়েছেন। তার গলার স্বর বুজে আসছিলো মাঝে মাঝে। দুইবার কালেমা পড়েছেন, বিড়বিড় করে সুরা পাঠ করেছেন। যে পিস্তলটি ব্যাবহার করে তিনি নিজের প্রাণ শেষ করে দেবেন সেটি যে বৈধ তাও তিনি নিশ্চিত করেছেন ফেসবুক লাইভে সেটির লাইসেন্স প্রদর্শন করে। পুলিশ জানিয়েছে তিনি আগেই দরজায় কাগজ টাঙিয়ে রেখেছিলেন যাতে টাইপ করে লেখা ছিল দরজা খোলা আছে। ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢোকার কথা লিখেছেন। সাদা কাপড় রেখে গেছেন নিজেকে দাফন করার জন্য। কোন কবরস্থানে দাফন হবে সেটি অনুরোধ করে গেছেন। পুলিশ আরো জানিয়েছে, তার লাশের পাশে একটি নোট পাওয়া গেছে। সেখানেও তিনি একই ধরনের কথা লিখেছেন। আবু মহসিন খানের এভাবে আত্মহত্যা করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেককেই নানা ধরণের প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে। সূত্র : বিবিসি