গ্যাস, বিদ্যুতের পর পানির দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেছে ক্যাব। গতকাল মঙ্গলবার কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর উদ্যোগে আয়োজিত ‘পানির অন্যায্য মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রতিবাদ’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনায় সভায় এই প্রতিবাদ জানানো হয়। ক্যাব বলেছে, ওয়াসার অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি-অপচয়ের দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা থেকেই ওয়াসায় চলে মূল্য বৃদ্ধির খেলা। অথচ ভোক্তাদের তা বাধ্য হয়েই সহ্য করতে হ্য়। একটা পক্ষ হওয়া সত্ত্বেও একতরফা চাপিয়ে দেয়ার সময় ভোক্তাদের এনিয়ে ক্থা বলার কোন জায়গা নেই।
ক্যাব -এর প্রশ্ন এখন কেন? গত ১০ বছরে দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে ৩ গুণ। এরমধ্যেই বিদ্যুতের দাম ৬৭% বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছর গ্যাসের অভাবে জ্বলানী তেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ৯০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। জ্বালানির সঙ্কটে এলএনজি এনে তার দাম সমন্বয় করায় বিদ্যুতে খরচ আরো বাড়বে। যা বিবেচনায় রেখে ৬৭% বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
আবার দেশীয় কোম্পানীর গ্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ড এসময় ৫০% দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এদের প্রত্যেকেই লাভজনক প্রতিষ্ঠান, তারপরও তারা দাম বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। সামগ্রিক ভাবে গ্যাস খাতে ভর্তুকি অনেক কমে যাওয়ায় পেট্রোবাংলা এখন অনেক লাভজনক অবস্থায় আছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করে সিএনজির সাথে সমন্বয় করে তারা লাভবান হয়েও ১১৭% মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এদিকে সঞ্চালন-বিতরণ কোম্পানীগুলোর সবাই লাভে থাকার পরও মূল্য বাড়াচ্ছে।
একদিকে ডিজেলের দাম বাড়ায় দেশের সকল ক্ষেত্রেই দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। তার ওপরে আবার সোয়াবিন তেলের দাম বাড়ার সাথে সাথে দেশের সকল দ্রব্য মূল্যে আরও একদফা উল্লম্ফন ঘটতে শুরু করেছে। অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমুল্যের বৃদ্ধিতে নির্দিষ্ট আয় দিয়ে সংসার চালানো যখন অসম্ভব। তখন পরিবার প্রধানরা পরিবার পরিচালনার জন্য, অধিক আয়ের জন্য দিশেহারা হয়ে উঠেছেন। করোনার প্রত্যক্ষ প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বেসরকারি খাতের বিরাট এক অংশ।
সরকারি বেসরকারি সব পর্যায়ের চাকরিজীবীরা পরিবারের চাহিদা পূরণ করতে দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়ছে। মহাবিপদে আজ দেশের সাধারন জনগন! ঢাকা ওয়াসা বোধকরি ভেবেছে, এইতো সময়।
করোনা মহামারির সময়েও ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের এপ্রিলে। এরপর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আরেক দফা বাড়ে দাম। এ দুই দফায় আবাসিকে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম বেড়েছিল ৩ টাকা ৬১ পয়সা (৩১ শতাংশ)। বাণিজ্যিকে বেড়েছিল ৪ টাকা ৯৬ পয়সা (১৩ শতাংশ)। জনগণকে একটি অতিপ্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা আবারও ২০ শতাংশ পানির দাম বাড়াতে চায় ঘাটতির টাকা তুলতে। অথচ সংস্থাটির অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন করেই ঘাটতির টাকা সমন্বয় করা সম্ভব,মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না।
কেন ঘাটতি: তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দামবৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়ে ঢাকা ওয়াসা প্রতিহাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা দেখিয়ে বলেছে তারা ১০ টাকা কমে ১৫ টাকায় বিক্রি করছে। সরকার এই টাকা ভর্তূকি দেয়, যা আর দিতে চায় না।
এ অবস্থায় এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সংস্থাটির অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি-অপচয়ের সব দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভর্তুকি কমানোর পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে কোনো সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না।“ কিন্তু ঢাকা ওয়াসা হচ্ছে একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান, লাভ বা বাণিজ্য এর উদ্দেশ্য নয়। অথচ সেবার চেয়ে বানিজ্যের দিকেই এর নজর এখন বেশী। দেশে বিভাগীয় শহর গুলোতে আরও ৬টি ওয়াসা আছে। তাদের পানির দাম ঢাকা ওয়াসার চেয়ে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। হাজার লিটারের ইউনিট প্রতি খরচ এত বেশী না বলেই তারা পারছে।
অন্যদিকে সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোথাও পৌর কর্তৃপক্ষ, কোথাও বা পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং পানি সরবরাহ করে। সেগুলোর বেশিরভাগই প্রকল্প হিসেবেই সরকারী টাকায় পরিচালিত হয়। সেগুলোতে যে বিপূল ভর্তূকি দেয়া হয় তাওকি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে? যদি তা না হয় তবে ঢাকায় ভর্তুকি বন্ধ করে সরকার কি এক দেশে পানি সরবরাহ বাবদে বৈষম্য মূলক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন?
বর্তমানে আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। ওয়াসার বোর্ড মিটিংয়ে প্রস্তাব ছিল আবাসিকে এ দর ২১ টাকা ২৫ পয়সা করা। আর বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম বর্তমানের ৪২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৮ দশমিক ৮ টাকা করা। আগামী ১লা জুলাই থেকে নতুন দর কার্যকর করতে অনুমোদন চায় ওয়াসা। কিন্তু এই মূল্যবৃদ্ধির কথা প্রকাশ হলে চারদিকের সমালোচনার মুখে এমডি ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব কমিয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠাবেন বলে জানান। সামগ্রিক বিষয়টি খতিয়ে দেখলে দেখা যায়,পানির দাম ২০শতাংশ বাড়লে ভোক্তা পর্যায়ে কার্যতঃ বৃদ্ধি পাবে ৪৬ শতাংশ। প্রতিটি পানির বিলে সমপরিমান সুয়োরেজ বিল দিতে হয়। আর মোট বিলের ওপর ১৫ শতাংশ দিতে হয় ভ্যাট। ফলে ১০০ টাকার পানির বিলে বর্ধিত ২০ টাকা, সুয়োরেজ বিল বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ২৪০ টাকা। বর্ধিত ৪০ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাটে আরও ৬ টাকা মিলিয়ে মোট বিলে ২০% এর ভর দাঁড়াবে ৪৬ টাকা। যার অর্থ হচ্ছে পানির ১০০টাকা বিলে ভোক্তাকে গুনতে হবে ২৪৬ টাকা।
যে ওয়াসা নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার পানি কিনে ফুটিয়ে পান করতে হয়! অন্যথায় যার পানি খেতে হলে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে ফিল্টার কিনে রাখতে হয়! যে পানি পাশে রেখে ১৫ টাকা দিয়ে এক গ্লাস পানির সমান বোতলজাত পানি কিনে খেতে হয়! সেই ওয়াসায় এমডি হিসেবে ২০০৯ সালের অক্টোবরে তাকসিম এ খান নিয়োগ পেয়ে এ পর্যন্ত পানির দাম বাড়িয়েছেন ১৪ বার,আর নিজের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিয়েছেন ৪২১ শতাংশ। ভিক্ষা করে চলা এই সংস্থার প্রধান নির্বাহী এখন মাসিক বেতন নেন সোয়া ছয় লাখ টাকা। এমডি হিসেবে ৩ বছরের জন্য চুক্তিতে তিনি যখন নিয়োগ পান, তখন তার সর্বমোট মাসিক বেতন ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
ক্যাব বলেছে, প্রতিবার পানির দাম বৃদ্ধির সময় প্রচার করা হয় ভর্তূকির কথা। ভর্তুকির কারণ দেখানো হয় তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দামবৃদ্ধিকে। সঙ্গে থাকে পানির স্তর নেমে যাওয়া। তথা খরচ বৃদ্ধিটা মূলতঃ গভীর নলকূপের খরচ। ঢাকা ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করে ৬৫ ভাগ। যার উতপাদন খরচ বৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে সামনে আনা হয়। বাকি ৩৫ ভাগ নদীর পানি পরিশোধন ও সরবরাহ ব্যয় প্রসঙ্গ উহ্য রাখা হয়। নন রেভিনিউ ওয়াটার বা সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো চুরি বন্ধের কোন উদ্যোগ সম্পর্কে থাকেনা কোন তথ্য। অপর দিকে বেতন বোনাস বাড়ানোর সময় এমডি হিসাব দেন, ঢাকা ওয়াসা লাভের দিকে যাচ্ছে। মাত্র এক বছর আগে তিনি বলেছিলেন, এক সময় যেখানে ৭০০ কোটি টাকা রেভিনিউ পাওয়া যেত এখন সেখানে সাত হাজার কোটি টাকা আসছে। গত বছরও তারা ৪০ কোটি টাকা মুনাফা দেখিয়ে ইন্সেন্টিভ বোনাস নিয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, যে সংস্থা ভিক্ষা করে চলে-সেই সংস্থার প্রধান নির্বাহীর বেতন কি সোয়া ছয় লাখ হওয়া উচিত? কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুই ঈদে দুই বোনাস ছাড়াও ৪টি ইন্সেন্টিভ বোনাস দেয়া কি যুক্তিযুক্ত?
রয়েছে অদৃশ্য আয়ের হরেক খাত- দেখাগেছে, পানির দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে অনেক বড় অদৃশ্য আয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ প্রাপ্ত এলাকার ৭০% এলাকাই সুয়োরেজ সেবা বহির্ভূত। অথচ তাদের কাছ থেকেও অন্যায়ভাবে পানির বিলের সঙ্গে জুলুম করে সুয়োরেজ বিল আদায় করা হয়।
প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি এবং তার মূল্য শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদেরই বহন করতে হয়। ঢাকা ওয়াসার ১১টি দুদক চিহ্নিত দুর্নীতি এবং সরকারি অর্থের অপচয় নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন মাথাব্যথা দেখায়নি ওয়াসা।
নতুন আরেক খাত বের করা হচ্ছে, বিত্তবান আর সাধারণ মানুষের বসতি এলাকার শ্রেণীভেদ করে পানির দাম নির্ধারণের মাধ্যমে। যেন উচ্চবিত্তের পশ এলাকায় সাধারণের এবং সাধারণের আবাসিক এলাকায় বিত্তশালীদের থাকতে নেই! নাকি নতুন লেনদেনে ভোক্তার শ্রেণীভেদ পরিবর্তনের করে বিলে হেরফের করার ক্ষমতা অর্জন করাই এর লক্ষ্য এখনও বোঝার সময় হয়নি।
এক কথায় ওয়াসার অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি-অপচয়ের দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা থেকেই ওয়াসায় চলে এই মূল্য বৃদ্ধির খেলা। অথচ ভোক্তাদের তা বাধ্য হয়েই সহ্য করতে হ্য়। একটা পক্ষ হওয়া সত্ত্বেও একতরফা চাপিয়ে দেয়ার সময় ভোক্তাদের এনিয়ে ক্থা বলার কোন জায়গা নেই।