শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১৮ অপরাহ্ন

ভারতের প্যাসিফিক ও মোহন জুট মিলস বাংলাদেশের পাটকল ইজারা নিতে চায়

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ২০ এপ্রিল, ২০২২

বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) বন্ধ হয়ে যাওয়া ১৭টি জুট মিল ইজারার মাধ্যমে সচলের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে দুটি চালু হয়েছে। চালু হওয়ার পথে আরো দুটি। বাকি ১৩টি মিল ইজারায় নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ১৮টি দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দুটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
আগ্রহী দুই ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের একটি হলো প্যাসিফিক জুট লিমিটেড। আরেকটি মোহন জুট লিমিটেড। দুটি প্রতিষ্ঠানই আলাদাভাবে প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস, ইস্টার্ন জুট মিলস লিমিটেড, খালিশপুর জুট মিলস লিমিটেড, দৌলতপুর জুট মিলস লিমিটেড, স্টার জুট মিলস লিমিটেড, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও কার্পেটিং জুট মিলস লিমিটেড—এ সাত কারখানা ইজারা নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
কারখানা সাতটির মধ্যে ইস্টার্ন জুট মিলস লিমিটেড, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও কার্পেটিং জুট মিলস লিমিটেড ইজারা নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে দুবাইভিত্তিক এশিয়াটিক ট্রেডিং এলএলসিও। প্রতিষ্ঠানটির কলকাতায়ও কার্যালয় রয়েছে। এছাড়া হংকং ও অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক দুটি প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশী অংশীদারের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের ভিত্তিতে কয়েকটি কারখানা ইজারায় নেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।
২০২০ সালের ৩০ জুন গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর বেসরকারি খাতে ইজারা দেয়ার মাধ্যমে ১৭টি চালুর ঘোষণাও দেয়া হয়। এরই মধ্যে দুটি জুট মিল ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের হাতে ইজারা দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী জুট মিলস লিমিটেড ২০ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে ব্যক্তি খাতের ইউনিটেক্স গ্রুপ। নরসিংদীর বাংলাদেশ জুট মিলস ইজারা নিয়েছে বে গ্রুপ। আরো দুটি পাটকল ইজারায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বাকি ১৩টি ইজারা নিতে আগ্রহী ১৮ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় দেশী বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানেরও নাম রয়েছে।
গুল আহম্মদ কার্পেটিং জুট মিলস, এমএম জুট মিলস ও আরআর জুট মিলস ইজারা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ইস্পাত খাতের জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড। ইজারা নিতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় জোবায়দা করিম জুট মিলস ও করিম জুট স্পিনার্স ছাড়া দেশের পাট খাতের বিদ্যমান আর কোনো কোম্পানির নাম নেই।
বিজেএমসির মহাব্যবস্থাপক মো. নাসিমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ইজারা দেয়ার ঘোষণার পর এরই মধ্যে দুটি মিল নিয়েছে ব্যক্তি খাতের দুই প্রতিষ্ঠান। সেগুলোয় উৎপাদনও শুরু হয়েছে। এছাড়া আরো দুটি মিল ক্রিসেন্ট ও হাফিজ জুট মিল ইজারা দেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। জামানত জমা পড়লে এ দুটি মিলও উৎপাদনের বিষয়ে অগ্রসর হতে পারবে। বাকি ১৩টি মিলের বিষয়ে আগ্রহপত্র চাওয়া হলে ১৮টি প্রতিষ্ঠান সাড়া দিয়েছে। এখন এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আবার আর্থিক ও কারিগরি প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে, যা আগামী ২৫ মের মধ্যে জমা দিতে হবে। জানা গেছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট পাটকল ইউনিটের সংখ্যা প্রায় ৩০০। এর মধ্যে ব্যক্তি বা বেসরকারি খাতে বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) ও বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) সদস্য সক্রিয় পাটকল ইউনিট আছে প্রায় ২৪০টি।
গোটা বিশ্বেই এখন পাটজাত পণ্যের চাহিদায় ভাটা পড়েছে। এর ধারাবাহিকতায় দেশের পাট খাতেও এখন মন্দাবস্থা বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন ব্যক্তি খাতের পাটকল উদ্যোক্তারা। তাদের ভাষ্যমতে, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই আর্থিক সক্ষমতা দুর্বল। অনেকেই উৎপাদন সক্ষমতা কমিয়ে এনেছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন পরিস্থিতি আরো কঠিন করে তুলেছে।
বাংলাদেশে সরকারি মিল ইজারায় পরিচালনার পূর্বাভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো না জানিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বলছেন, এসব মিলের অনেক জমি। স্থাপনাও অনেক বড়। কিন্তু উৎপাদনশীলতা অনেক কম। যন্ত্রপাতিও অনেক পুরনো। শ্রমিক যারা আছেন, তারাও অনেক পুরনো। তাদের দিয়ে নতুন আধুনিক মেশিন পরিচালনাও কষ্টকর হতে পারে। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা নিজ ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী মিল পরিচালনা করতে পারবেন না। অনেক শর্ত পূরণ করে এসব মিল পরিচালনা করতে হবে। এছাড়া উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করতে চাইলেও নানা জবাবদিহিতার বিষয় রয়েছে। সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেয়ার চেয়ে অনেক কম বিনিয়োগে নতুন মিল স্থাপন করা বেশি সহজ বলে মনে করছেন বিজেএসএর ভাইস চেয়ারম্যান মৃধা মনিরুজ্জামান মনির। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, প্রায় দেড় বছর ধরে দেশের ব্যক্তি খাতের পাটকলগুলো চরম দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই উৎপাদন কমিয়ে নিয়ে এসেছে। আর্থিক সক্ষমতা কম হওয়ায় এখন আর কেউ সম্প্রসারণের বিষয়ে ভাবছেন না। আবার সরকারি মিল ইজারা নিয়ে সেগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে পূর্বাভিজ্ঞতাও এ বিষয়ে অনেককে অনাগ্রহী করছে। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত মিল ইজারা নিয়ে পরিচালনায় স্থানীয়দের আগ্রহ তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না।
এছাড়া উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের দেয়া সুযোগ-সুবিধাও সব খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য সমান নয় বলে অভিযোগ রয়েছে পাট খাতের উদ্যোক্তা প্রতিনিধিদের। বিজেএমএর সেক্রেটারি জেনারেল এ বারিক খান বণিক বার্তাকে বলেন, অন্যান্য খাতের মতো ব্যক্তি খাতে পাটকলের উদ্যোক্তারাও দেখেন সরকারের নগদ ও নীতিগত সহায়তাগুলো কোন খাতে বেশি। তারা দেখেন সরকার কোন খাতে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। সবকিছু পর্যালোচনায় তারা দেখেন কিছু পণ্যের শিল্পোদ্যোক্তারা সরকারের পক্ষ থেকে যেমন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, তা অন্যান্য খাতে পাচ্ছেন না। এমন বৈষম্যের কারণে সরকারি মিল ইজারা নিয়ে পরিচালনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন না তারা। যেসব খাতে সুযোগ-সুবিধা বেশি পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর দিকেই ঝুঁকছেন তারা।
সরকারি সুযোগ-সুবিধার সমতা থাকলে দৃশ্যপটটি ভিন্ন হতো দাবি করে তিনি আরো বলেন, আর্থিক সক্ষমতার দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা কোনো সমস্যা না, যদি সরকারের সহায়তা নিশ্চিত হয়। এ সহায়তাকে কাজে লাগিয়ে আধুনিকায়নের ভিত্তিতে পাটকল চালানো যেতে পারে। আবার পুরনো শ্রমিকও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নয়, যদি সঠিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। নীতিনির্ধারণী বৈষম্য না থাকলে পাট নিয়ে ব্যক্তি খাতের আগ্রহ এখনো রয়েছে।
সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণার পর শুরুতে প্রায় ৮০ হাজার স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকের পাওনা পরিশোধে কার্যক্রম শুরু করে বিজেএমসি। প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিকের ৯০ শতাংশ পাওনা পরিশোধও করে দেয়া হয়েছে। এরপর বিজেএমসির বন্ধ মিলগুলো বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ইজারার ভিত্তিতে পুনরায় চালুর বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। বিজেএমসির ইজারা নীতিমালা সূত্রে জানা গিয়েছে, সারা দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া ২৫টি পাটকলের মোট জমির পরিমাণ এক হাজার একরেরও বেশি। মিলগুলোর শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের আবাসন, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ অব্যবহূত অনেক জমি ছিল। বেসরকারি মিলমালিকদের বিপুল এ জমির প্রয়োজন হবে না। তাদের শুধু চাহিদামতো জমি ও ভবন ছেড়ে দেয়া হবে। পাশাপাশি মিলের অফিস ভবনও ইজারাগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে ছেড়ে দেয়া হবে। বিজেএমসি মিলের অভ্যন্তরে নতুন স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য তদারককারী অফিস স্থানান্তর করবে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট ধরনের উদ্যোক্তাদের জন্য অতিরিক্ত কোনো সুবিধা দেয়ার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে না। পাট খাতে পুরনোদের পাশাপাশি নতুনদের আগমনকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশের পাট খাত আবারো নতুনভাবে সম্প্রসারিত হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা।
এ প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ বলেন, পাট খাতকে এগিয়ে নিতেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতে ইজারা দেয়া হয়েছে। এখানে শুধু বেসরকারি খাতের পুরনো উদ্যোক্তারা এলেই যে খাতটির উন্নয়ন হবে, তা নয়। আমরা বেসরকারি খাতের নতুন-পুরনো সব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা নিজেরাই আরো বৃহৎ কিছু করতে চায়। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান ইজারা নেয়ার মাধ্যমে ভালো করছে। তাছাড়া পুরনো উদ্যোক্তারা চাইলে নিজেরাই জমি কিনে নতুন কারখানা করতে পারেন। এজন্য পুরনোরা সবাই এগিয়ে না এলেও বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে যুক্ত রয়েছেন। ইজারা নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর নয় মাসের মধ্যে উৎপাদনে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও দুই মাসের মধ্যেই উৎপাদনে যেতে পেরেছে। এটা দেশের পাট খাতের জন্য খুবই ইতিবাচক। পুরনোদের পাশাপাশি নতুনদের আগমনে দেশের পাট খাত আবারো নতুনভাবে সম্প্রসারিত হবে।-বণিকবার্তা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com