পিবিত্র ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, নববর্ষসহ উৎসবের দিনগুলোতে কার্ড বিতরণের রীতি বহু পুরনো। তবে এখন নানান দিবসে ডিজিটাল কার্ডের মাধ্যমেই শুভেচ্ছা বিনিময় করেন মানুষ। ঈদকে কেন্দ্র করে নেই সেই ‘ঈদ কার্ড’ বিতরণের চিরায়িত রীতি। ফলে প্রযুক্তির যুগে হারিয়ে যাচ্ছে ছাপা কার্ডে শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রচলন।
কার্ড ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০১৫-১৬ সালের দিকেও ছাপা কার্ড বিতরণের হিরিক থাকলেও এখন প্রযুক্তির যুগে এসে ছাপা কার্ড বিতরণে আগ্রহ হারিয়েছে মানুষ। এখন ডিজিটাল মাধ্যমে কার্ড বানিয়ে ই-মেইল কিংবা ফেসবুকে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন মানুষ। ফলে ঈদ কার্ডের মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়ার যে কালচার সেটি হারিয়ে যাচ্ছে। একই অবস্থা নববর্ষের ক্ষেত্রেও।
পুরানা পল্টনে বহু পুরনো কার্ডের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, ঈদকে কেন্দ্রে করে নেই কোনো বাড়ছি ব্যস্ততা। উল্টো অন্য সময়ের তুলনায় ফাঁকা দোকানগুলো। কয়েকজন কার্ডের কাজ করলেও তা বিয়ের কার্ড। ঈদের কার্ডের অর্ডার নেই বললেই চলে। তাই ঈদ কার্ড কেন্দ্রিক ব্যবসা এখন আর নেই আজাদ প্রোডাক্ট, আইডিয়াল প্রোডাক্টসসহ স্বনামধন্য কার্ডের দোকানগুলোতে।
আজাদ প্রোডাক্টসের ম্যানেজার মোস্তফা কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন তো ঈদ কার্ড বিক্রি আগের তুলনায় অনেক কম। আগে রমজানের আগেই প্রস্তুতি নিতাম ঈদ কার্ড ছাপানো জন্য। শত শত ডিজাইন থাকতো আমাদের ঈদ কার্ডের জন্য। তখন সবচেয়ে বেশি চলতো ঈদ কার্ড, বাচ্চাদের কার্ড ছিল। এগুলো এখন জিরোতে নেমে আসছে। এবছর তো কোনো কার্ডেই চলছে না। এবছর শুধু শরীয়তপুরের মেয়র ঈদ কার্ড ছেপেছেন। এর বাইরে আর কেউ কার্ড অর্ডার করেনি। খুচরা বিক্রি তো একেবারেই নেই। মোবাইল আসার পর থেকে ধীরে ধীরে কার্ড বিক্রি কমেছে। এখন তো একেবারে তলানিতে এসে পড়েছে। ২০১৫-১৬ সালেও লোকজন লাইন দাঁড়িয়ে কার্ড কিনেছে। এখন তো নববর্ষের কার্ডও চলে না। আমাদের কার্ড বিক্রির দু’টি সিজনই ছিল, একটি নববর্ষ আরেকটি ঈদ। এখন তো কিছুই নেই। আমাদের আগে চাঁদরাত পর্যন্ত শোরুম খোলা রাখতে হতো, লাখ লাখ কার্ড বিক্রি হতো।’
সামনের দিনগুলোতে কি কোনো সম্ভাবনা দেখছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সামনে ঈদ কার্ড বিক্রির সেইদিন আর ফিরবে কি না সন্দেহ আছে। প্রতিনিয়তই মানুষের জীবনযাত্রা আপডেট হচ্ছে, তাই এমন ছাপা কার্ড বিতরণ বাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এখন কিছুটা বিয়ের কার্ড চলছে। সামনে সেটিও হারিয়ে যায় কিনা চিন্তায় আছি। এভাবে অনলাইনে যদি বিয়ের আমন্ত্রণও দিয়ে দেয় তাহলে তো বিয়ের কার্ডও চলবে না। আসলে একটি ছাপা কার্ড বিতরণ করলে হৃদ্যতা বাড়ে। কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে দিলে সেটা সেভাবে কেউ দেখেও না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিছু কার্ড ছাপালেও বিভিন্ন প্রেসে কম খরচে কার্ড ছেপে দিচ্ছেন। রমজানে ঈফতার পার্টির দাওয়াতের জন্যও কার্ড ছাপাতো, এখন তাও ছাপছে না।’
আইডিয়াল প্রোডাক্টসের ম্যানেজার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মোবাইলের কারণে ঈদ কার্ড অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কার্ড করতো। এখন সেই কার্ড বিতরণটা সেভাবে করছে না। শুধু ঈদ কার্ড নয়, নববর্ষের কার্ডও এখন সেভাবে বিতরণ হয় না। এক সময় এলাকায় এলাকায় ছেলেরা কার্ড বিক্রি করতো, তারা আমাদের এখানে এসে লাইন দিয়ে কার্ড নিতো। ২০১৫-১৬ সালের দিকেও ছিল। তখন এমন হতো আমরা টিকিট দিতাম, সিরিয়াল অনুযায়ী তারা এসে যার যেটা পছন্দ সেই কার্ডগুলো নিতো। দীর্ঘ লাইন লেগে যেতো। সেই সময়টা এখন আর নেই।’
তিনি বলেন, ‘এখন ঈদ কার্ড বিক্রি হয় না বললেই চলে। অফিসিয়ালি প্রতিষ্ঠানগুলো যে শুভেচ্ছা জানাতো সেই কার্ডগুলো খুব সীমিত আকারে ছাপায়। আগে যেমন বিশাল পরিসরে ছাপাতো সেটা আর নেই। এখন একশো’ কিংবা ৫০টা কার্ড নিয়ে যেখানে না দিলেই নয় সেখানে হয়তো দিচ্ছে। ঈদ কেন্দ্রিক সেই ব্যবসা এখন আর নেই।’
নিউ কার্টুন প্রোডাক্টসের স্বত্বাধিকারী এফ এম আরাব আলী বলেন, ‘বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তি এসে আমাদের অনেক কিছুই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিয়ের কার্ডও কমে যাচ্ছে। একজন শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হলে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করলে দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের কাছে চলে যাচ্ছে। তাই আমরা এখন ৫ হাজার ঈদ কার্ড ছাপালে দেখা যায় একশো কার্ডও বিক্রি হয় না। আগে আমরা বাসায় কার্ড দিয়ে আসতাম, স্কুল-কলেজে কার্ড দিতো। কিন্তু এখন বাসায় বসেই ডিজিটাল মাধ্যমে কার্ড পাঠাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘২০১৫-১৬ সালের দিকেও কার্ড বিক্রি হয়েছে। এরপর অল্প কিছু বিক্রি হতো। কিন্তু করোনার পর তো কার্ড বিক্রি একেবারেই নেই। করোনায় মানুষ কার্ড কিনতে পারেনি, দিতেও পারেনি। প্রোডাকশন বন্ধ ছিল, তাই মার্কেটে কার্ড পায়নি। তাই তারা ডিজিটাল কার্ডে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সামনের দিনগুলোতে সবকিছুই বিলীন হয়ে যাবে। কালের বিবর্তনে সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে। আগে মানুষ অনুষ্ঠানের জন্য যেখানে পাঁচশ’ কার্ড ছাপাতো সেখানে এখন একশ’ কার্ড ছাপায়। অনেকে একটা কার্ড বানিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে দেয়। আগে রোজার সময় আমরা ইফতার-সেহরি খাওয়ার সময় পেতাম না। এখন রাত ৯টার মধ্যেই দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। সেই কার্ডের দিন আর ফিরে আসবে না।’