লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত। শবে কদর নামেও এ রাতটি পরিচিত। ফার্সিতে বলা হয় শবে কদর। আরবিতে লাইলাতুল কদর। শব ও লাইলাতুল শব্দের অর্থ রাত। কদর শব্দের অর্থ হচ্ছে মাহাত্ম্য ও সম্মান। সুতরাং লাইলাতুল কদর অর্থ হচ্ছে সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা মর্যাদার রাত। এ রাতেকে সম্মানিত ও মহিমান্বিত বলার কারণ- আমলহীনতার কারণে যার পূর্বে কোনো সম্মান ও মূল্য থাকে না, সে এ রাতে তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে সম্মানিত হয়ে যায়। এছাড়া কদরের আরেক অর্থ হচ্ছে ভাগ্য, পরিমাণ, তাকদীর নির্ধারণ করা ইত্যাদি। এ রাতে পরবর্তী এক বছরের প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক ইত্যাদির পরিমাণ লাওহে মাহফুজ থেকে নিদিষ্ট ফেরেশতাগনকে লিখে দেওয়া হয়।
হজরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এ কাজের দ্বায়িত্ব চার ফেরেশতাকে দেওয়া হয়, তারা হলেন- হজরত ইসরাফিল আ., হজরত মীকাঈল আ., হজরত আজরাইল আ. ও হজরত জিবরাইল আ.। আল কুরআনের ভাষ্যমতে, আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এ রজনীর ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সাওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রতি বছর মাহে রমজানে লাইলাতুল কদর মুসলিম উম্মাহের জন্য অশেষ সাওয়াব অর্জনের সুযোগ বয়ে আনে। লাইলাতুল কদর কেবলমাত্র হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের বৈশিষ্ট্য, পূর্বের কোনো নবীর উম্মতের সময়ে লাইলাতুল কদর ছিল না।
একদা প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী ইসরায়েলের এক ইবাদতকারী ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। সে সারারাত ইবাদত মশগুল থাকত, সকাল হতেই জিহাদের জন্য বেরিয়ে যেত এবং সারাদিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। এভাবে সে এক হাজার মাস ইবাদতে কাটিয়ে দেয়।
এ কথা শোনার পর সাহাবারা আশ্চর্য হয়ে গেল এবং আফসোস করতে লাগল যে, আমরা তো এত লম্বা হায়াত পাব না আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারব না। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতায়ালা সূরা কদর নাজিল করে এবং সাহাবারা তথা হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের জন্য হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রজনীর সুসংবাদ দিলেন।
লাইলাতুল কদর কখন? আমাদের অনেকের মনে এই ভুল ধারণা রয়েছে, রমজান মাসের ২৭ রাত্রি হচ্ছে লাইলাতুল কদর। এই ধারণাটি ঠিক নয়। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দিষ্টভাবে সাতাশের রাতকে লাইলাতুল কদর বলেন নি। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. হতে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদরকে সন্ধান করতে বলেছেন। আরেক বর্ণনা রয়েছে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদরকে সন্ধান কর। সুতরাং হাদিসের আলোকে লাইলাতুল কদর হচ্ছে, রমজান মাসের ২১,২৩,২৫,২৭ কিংবা ২৯ এর মধ্যে যেকোনো এক রাত্রিতে হতে পারে।
কীভাবে লাইলাতুল কদর লাভ করব? লাইলাতুল কদর লাভ করার সর্বোত্তম উপায় হলো শেষ দশকে ইতেকাফ করা। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের শেষ ১০দিন ইতেকাফ করবে সে দুটি ওমরা ও দুটি কবুল হজ আদায় করার সাওয়াব পাবে। তাই, যারা ইতেকাফ করবে লাইলাতুল কদর পাওয়ার পাশাপাশি অধিক সাওয়াবও লাভ করবে। হাদিসে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে রাতটি লাইলাতুল কদরের রাত হবে, তা চেনার কিছু নির্দেশন বলেছেন। তা হল- ১.রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না। ২.রাতটি নাতিশীতোষ্ণ হবে। ৩.মৃদ বাতাস প্রবাহিত থাকবে। ৪.সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত তৃপ্তিবোধ করবে। ৫.কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়ে দিতে পারেন। ৬. ওই রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হবে। ৭. সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। উম্মুল মুমিনীর হযরত আয়েশা রা. হতে বর্নিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে তখন কোন দোয়াটি পাঠ করব। তিনি বললেন, তুমি বল, আল্লাহুমা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফ্ওয়া ফা’ফু আন্নী। এর অর্থ হচ্ছে – হে আল্লাহ! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। অতএব, আমাকে ক্ষমা করে দেন (তিরমিযী)। লাইলাতুল কদরে আল্লাহ বান্দার নেক দোয়া কবুল করেন। এ রাতে আল্লাহ অধিক সংখ্যক রহমতের ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যা সকাল না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে এক অনন্য শান্তি বিরাজ করে। তাই একজন মুমিন মুসলমানের কাছে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসীম লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য মুমিন মুসলমান রমজানের শেষ দশকের বেশি বেশি নফল নামাজ, আল-কুরআন তেলাওয়াত, দরুদ ও সালাম,তওবা-ইস্তেগফার, দান-সদকা ইত্যাদি কাজের মধ্যে নিজেকে মগ্ন রাখে। আসুন, আমরা আল্লাহর নিকট দোয়া করি, আল্লাহ তায়ালা লাইলাতুল কদরের বরকতে এই করোনা মহামারী থেকে আমাদের রক্ষা করেন এবং পৃথিবী যেন আগের মতো সুস্থ স্বাভাবিক করে দেন। আমিন।