করোনা মহামারির রেশ কাটতে না কাটতেই বিশ্ব অর্থনীতির ঘাড়ে চেপে বসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। আমদানি ব্যয় বাড়লেও বাড়েনি রফতানি আয়। এর মধ্যে বাড়ছে ডলারের দামও। মূল্যস্ফীতি চলে যাচ্ছে লাগামের বাইরে। সরকারি বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে বিদ্যুৎ, গ্যাস, সারের দাম নিয়ে। পরিস্থিতির সামাল দিতে এসবে বাড়াতে হতে পারে ভর্তুকি।
ভর্তুকি বাড়লে বাজেট ঘাটতিও বাড়বে। তাতে সমস্যা নেই বলে অভয় দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। এ পরিস্থিতিতে আমদানি করা সার ও জ্বালানির ওপর শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। জানা গেছে, দেশের সারের বাজারের অনেকটাই আমদানি নির্ভর। বছরে চাহিদা আছে ৬০ লাখ টনের। এর ৭০ শতাংশই সরকারি সংস্থার নির্ধারিত মূল্যে আমদানি ও বিক্রি হয়।
এখন আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্য বেড়েছে কয়েক গুণ। আগের অর্থবছরে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ছিল ৩২ টাকা। চলতি অর্থবছরে বেড়ে ৯৬ টাকা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি প্রণোদনা ও নগদ ঋণ বাবদ ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের মূল্য বাড়িয়ে সমন্বয় করা না হলে এই তিন খাতেই ভর্তুকি লাগবে ৫০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এদিকে, বিশ্ববাজারে এলএনজির দামও বেড়েছে।
কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গত বুধবার (১৮ মে) পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চলছে। অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, সারের দাম বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। অর্থ বিভাগের হিসাবে, মূল্য সমন্বয় না হলে আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি লাগবে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। ভর্তুকি খাতে এটিই হবে সর্বোচ্চ। এ টাকা চলতি অর্থবছরের বরাদ্দের প্রায় দ্বিগুণ। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম ১৪ বছরের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ। প্রাকৃতিক গ্যাস ও সারের দামও রেকর্ড ছুঁয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সারের দাম বাড়ানো হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদনের ওপর। তাই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সারের দাম না বাড়লে বাজেটে বিপুল ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করলে বা ভর্তুকি দিলে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে সেটার ধারণা পেতে কাজ করছে অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগের হিসাবে, নতুন বাজেটে গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করা না হলে এলএনজি আমদানি ও প্রণোদনা প্যাকেজের সুদ মিলিয়ে ব্যয় হবে ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ আছে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে যদি সারের মূল্য সমন্বয় করা না হয়, তবে কৃষি প্রণোদনা বাবদ ১৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে। কৃষি খাতে চলতি অর্থবছরে ভর্তুকিতে বরাদ্দ ৯ হাজার কোটি টাকা। বিভাগটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দাম সমন্বয় না হলে আগামী অর্থবছরে ভর্তুকিতে যে পরিমাণ বরাদ্দ লাগবে, তার বেশিরভাগ যাবে এই তিন খাতে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, দাম সমন্বয় করা হলে কত খরচ পড়বে এবং সমন্বয় না করা হলে খরচ কত পড়বে, তার হিসাব অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে দেওয়া হয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তারা আরও জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই তিন পণ্যের কোনোটিরই দাম বাড়ানোর পক্ষে নন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ডলারের দামও বাড়ছে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এমন সময়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, সারের দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভর্তুকিতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সরকারের কাছে হয়তো দাম না বাড়ানোর বিকল্প পথ থাকবে না। তবে ভর্তুকি বাড়িয়ে জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার কৌশল ঠিক আছে। এই জটিল সময়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, সারের দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। বাংলাট্রিবিউন