আমাদের জীবন সেকেন্ড মিনিট আর ঘণ্টার সমষ্টি এ এভাবে দিন মাস বছর পুরো জীবন পার হয়ে যায়। আসে মৃত্যু। চলে যাই পরপারে। আপনজনেরা কিছু দিন মনে রাখে তার পর ভুলে যায়। খুব কাছের মানুষেরা মাঝে মধ্যে মনে করে। আস্তে আস্তে তারাও বিদায় নেয়। তখন আর কেউ মনে রাখে না। এভাবে কালের গর্ভে সব হারিয়ে যায়। এ সময় নিয়েই সব কিছু। এ সময় সবচেয়ে বেশি দীর্ঘস্থায়ী আবার এটিই সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী। সবচেয়ে বেগবান আবার সবচেয়ে ধীর। আমরা সবাই তাকে হেলায় নষ্ট করি আবার পরে আফসোস করি। এ সময় ছাড়া কিছুই করা যায় না। আবার একেই সবচেয়ে বেশি অবজ্ঞা করি। সুখী মানুষের কাছে সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। আবার দুঃখীর সময় যেন পার হতে চায় না। এ সময় দিয়েই আমাদের জীবন গঠিত। এ সময়ের নাট্যশালায় আমরা অভিনেতা। এ সময়কে ঘিরেই আমাদের পথচলা।
সময়ের সদ্ব্যবহারে আসে জীবনের সফলতা। সময়ের অপব্যবহারে জীবনের ব্যর্থতা। এ পৃথিবীতে যত ভালো কাজ হয়েছে তা সময়ের উত্তম ব্যবহারের ফলেই হয়েছে। খারাপ কিছুও সময়ের ব্যবহারেই হয়েছে। পৃথিবীতে যারা স্মরণীয় হয়ে আছেন তারা তো সময়কে ঘিরেই স্মরণীয় হয়ে আছেন।
একজন দিনমজুর দিনে ৫০০ টাকা রোজগার করে তার প্রতি ঘণ্টার মূল্য ৬২.৫০ টাকা। একজন ব্যাংকের এমডি তার প্রতি ঘণ্টার মূল্য তিন হাজার টাকা বা তারও বেশি। দুই জায়গায় সময় কিন্তু একই। এটি নির্ভর করে আমি সময়কে কিভাবে নিয়েছি। যে সময়কে যত মূল্যবান মনে করে জীবন পরিচালনা করেছে তার সময়ের মূল্যও তত বেশি, তার কর্মঘণ্টার মূল্যও তত বেশি। আমরা রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে আবার জেগে উঠি তখন আমার পকেটে ২৪ ঘণ্টা সময় থাকে। আমি ২৪টি ঘণ্টার মালিক হয়ে যাই। কিন্তু সময় আমার অধীন নয় যে খরচ না করলে কমবে না। ২৪ ঘণ্টা পকেটে ঢোকার সাথে সাথে আবার তার সরে যাওয়াও শুরু হয়ে যায়। আমি তাকে কাজে লাগাই অথবা না লাগাই সে বইতে শুরু করে। তাকে কোনো বাধ দিয়ে আটকানো যায় না। সে সদা চলমান। পৃথিবীর শুরু থেকে তার চলা শুরু সে সামান্য সময়ের জন্য থেমে নেই। রাসূল সা: বলেন, দু’জন ফেরেশতার নিম্নরূপ আহ্বান ব্যতীত একটি সকালও আসে না। তারা বলে হে আদম সন্তান, আমি একটি নতুন দিন এবং আমি তোমার কাজের সাক্ষী। সুতরাং আমাকে ভালোভাবে ব্যবহার কর। শেষ বিচার দিনের আগে আমি আর কখনো ফিরে আসব না। আমাদেরকে কেউ নামাজের কথা বললে বা ভালো কোনো কাজের কথা বললে আমরা বেশির ভাগ সময়ই বলি, আগামীকাল থেকে শুরু করব বা আগামীকাল করব। এ সপ্তাহে নয় আগামী সপ্তাহে করব। আগামী বছর করব ইত্যাদি। এভাবে আমরা কাঁদা মাটিতে আটকিয়ে আছি। আমাদের সময় চলে যাচ্ছে। জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। আগামী আগামী আর শেষ হচ্ছে না। সচেতন ব্যক্তি কখনো বলে না আগামীকাল, সে বলে আজই আমার সময়। আজকের দিনটি আর কখনো ফিরে পাবো না।
আমরা অর্থ খুব ভালোবাসি। অর্থের জন্যই আমাদের চাকরি ব্যবসায় আরো কত কাজ। অর্থ আমরা নষ্ট হতে দেই না। একটি টাকার খুব কম দাম। তার পরও কি একটি টাকা হেলায় ফেলে দেই। দেই না। অথচ সময়ই তো অর্থ। সময় নষ্ট করা শুধু অপরাধই নয় হত্যা বা খুনের মতো অপরাধ। কারণ জীবন তো সময়ের সমষ্টি। যখন কেউ আমাকে কোনো কাজের কথা বলে তখন অনেক সময় বলি আমার হাতে সময় নেই। এর দ্বারা এটিই বোঝানো হয় এর চেয়ে আমার আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।
প্রতিদিন এক ঘণ্টা কাজে ফাঁকি দেয়া বা অবহেলায় কাটানো মানে বছরে দুই কর্ম মাস ফাঁকি দেয়া। আমরা কি কখনো এভাবে চিন্তা করি। জীবনে গড়ে প্রতিদিন এক ঘণ্টা অপচয় করা মানে ৬০ বছরের জীবন থেকে ২.৫০ বছর পচে যাওয়া। দিনে ১ মিনিট খসে যাওয়া অর্থ জীবন থেকে ১৫ দিন ঝরে যাওয়া। আমি যদি আমার হায়াতের ৬০ বছর দিয়ে চিন্তা করি তাহলে দেখব। আমি কমপক্ষে ২০ বছর ঘুমে কাটিয়েছি। আমি ছোটকালের বেশির ভাগ সময় আমি ঘুম আর খেলায় কাটিয়েছি। প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা করে টেলিভিশনের সামনে বসে থাকলে জীবনের ৭.৫০ বছর খুইয়েছি। শুধু খাওয়া দাওয়ায় আমার প্রায় চার বছর সময় লেগেছে। নিজের দাঁত মেজে পুরো পাঁচ মাস সময় কাটিয়ে দিয়েছি। গোসল করতে যদি প্রতিদিন ১৫ মিনিট কাটিয়ে থাকি তা হলে প্রায় আট মাস গোসল করতে লেগেছে। পড়ালেখায় ১৫ বছরে যদি স্কুল-কলেজ বা মাদরাসার ক্লাস এবং বাড়িতে পড়ায় গড়ে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা সময় দিয়ে থাকি তা হলে জীবনের মাত্র পাঁচ বছর সময় জীবন গড়ার জন্য ব্যয় করেছি। ইবাদতে যদি আমি ১০ বছর বয়স থেকে গড়ে প্রতিদিন এক ঘণ্টা সময় দিয়ে থাকি তাহলে মাত্র ২.০৮ বছর সময় দিয়েছি। রোজগারে যদি সপ্তাহের পাঁচ দিনে গড়ে ১০ ঘণ্টা সময় দিয়ে থাকি তা হলে ৩৮ বছরে ১১ বছর এখানে কাটিয়েছি। আমার প্রতিদিন গড়ে পাঁচ মিনিট সময় নষ্ট হলে জীবন থেকে আড়াই মাস সময় ঝরে যায়। ১০ মিনিট সময় নষ্ট হলে জীবন থেকে পাঁচ মাস সময় চলে যায়। এখন চিন্তা করার বিষয় হলো, আমার হায়াতের সময়গুলো কিভাবে কাজে লাগিয়েছি? জীবন গড়ার জন্য কতটুকু সময় ব্যয় করেছি? আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার জন্য কতটুকু সময় দিয়েছি? আল্লাহ তায়ালাকে একান্তে পাওয়ার জন্য কতটুকু সময় দিয়েছি? এসব প্রশ্ন নিজেকে করলেই আমার অবস্থান আমার জানা হয়ে যায়। লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা