দুনিয়াতে প্রতিটি মানুষই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ও ভালোবাসার পাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। মানুষ তাকে ভালোবাসুক, শ্রদ্ধা করুক, সম্মান করুক; এটাই চায়। আবার যারা বড় বড় দায়িত্বশীল বা ক্ষমতাধর ব্যক্তি- তাদের আনুকূল্য কিংবা আস্থাভাজনও হতে চায় মানুষ। আর এ দু’টি ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারলেই মানুষ দুনিয়ায় অনেক সুবিধা ভোগ করতে পারে । কিন্তু এসবই কি প্রকৃত ভালোবাসা? প্রকৃত সুখ-সফলতা কি এতেই নিহিত রয়েছে? চোখ বুজলেই কি এ পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সমাপ্তি ঘটবে না? মানুষ ভালোবাসার কাঙাল ভালোবাসা পেতে কী না করতে পারে! তাই আসুন প্রকৃত ভালোবাসার স্বরূপ জেনে নেয়া যাক! ভালোবাসার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসার চেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা আর কী হতে পারে? আহকামুল হাকিমিন, রাজাধিরাজ মহান আল্লাহর আস্থাভাজন হওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোন বিষয় হতে পারে? আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে বান্দার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ার কথা বলেছেন এভাবে- ‘আর যারা মুমিন আল্লাহর সাথে তাদের ভালোবাসা প্রগাঢ়’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৬৫)।
সুতরাং মুমিন বান্দার লোভ-লালসা, চাওয়া-পাওয়া ও কামনা-বাসনা হওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বেশি নৈকট্য পাওয়া, আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পাওয়ার চেষ্টাকে প্রাধান্য দেয়া। আর আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা পাওয়া মুমিন বান্দার ঈমানি দায়িত্বও বটে। কুরআনুল কারিমের একাধিক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তার ভালোবাসা পাওয়ার উপায় তুলে ধরেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে কোন কাজে বেশি ভালোবাসবেন, কোন কাজে রহমত নাজিল করবেন; কোন কাজে অভিশাপ দেন, রহমত থেকে বি ত করেন তা-ও জানতে হবে। সে অনুযায়ী আমল করা মুমিনের একান্ত কাজ। আল্লাহ তায়ালা যাদের ভালোবাসেন- ১. তাওবাহকারী : যারা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি তাওবাহ করে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাহকারীদের ভালোবাসেন’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২২২)।
এ তাওবাহর মর্মার্থ কি? মানুষ প্রতিনিয়ত-অহরহ গুনাহ করে থাকে। আর এ গুনাহ থেকে ফিরে আসা কিংবা বিরত থাকা। অতীত জীবনে যেসব গুনাহ হয়েছে, আল্লাহর কাছে সেসব গুনাহকে অপরাধ হিসেবে স্বীকার করে এ অপরাধ বা গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া; এ অন্যায়-অপরাধ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করার নামই হলো তাওবাহ।
যারাই এ প্রতিজ্ঞা করে গোনাহ থেকে ফিরে আসে বা গোনাহ থেকে বিরত থাকে আল্লাহ তায়ালা এসব তাওবাহকারীকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন।
এ তাওবাহ এভাবে করা যায়- ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ অর্থ- আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ‘আস্তাগফিরুল্লাহা ওয়া আতুবু ইলাইহি’ অর্থ- আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁর দিকেই ফিরে আসছি। ‘রাব্বিগ্ ফিরলি ওয়া তুব আলাইয়্যা ইন্নাকা (আংতাত) তাওয়াবুর রাহিম’ অর্থ- হে আমার প্রভুু! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবাহ কবুল করুন নিশ্চয় আপনি মহান তাওবাহ কবুলকারী করুণাময়।
২. রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুসরণকারী : রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুসরণ ও অনুকরণকারীকে মহান আল্লাহ ভালোবাসেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘(হে রাসূল! আপনি) বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ করো; তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা ইমরান, আয়াত-৩১)।
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতে পারলে, জীবনের প্রতিটি দিক-বিভাগে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করতে পারলেই মহান আল্লাহ বান্দাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবেন।
৩. পবিত্রতা অর্জনকারী : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা পবিত্র; তিনি পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালোবাসেন। এ পবিত্রতা শুধু শারীরিক পবিত্রতাই নয়; বরং এ পবিত্রতা হচ্ছে জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে শারীরিক, মানসিক, আদর্শিক; লেনদেন, কথাবার্তা ও আচার-আচরণসহ সব ধরনের পবিত্রতা অর্জনকারীকে মহান আল্লাহ ভালোবাসেন। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমেও এ কথার ঘোষণা এভাবে দিয়েছেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২২২)।
৪. দানকারী : আল্লাহ তায়ালা সব মানুষকে নেয়ামত দান করেন। দুনিয়ার দানে আল্লাহ বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী কাউকে নেয়ামত দানে আলাদা করেন না। দান করা মহান আল্লাহর গুণ। যারা আল্লাহর এ গুণের অনুসরণে দান করবে; আল্লাহ তাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবেন। দুস্থ মানুষের কষ্ট লাঘবে যার যে সম্পদ আছে, তা নিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী দুয়ারে দুয়ারে হাজির হয়ে দান করবে; মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালোবাসবেন।
হাদিসে এসেছে- যারা দানবীর; দানশীলতাকে যারা অগ্রাধিকার দেবে; নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাদের মহব্বত করেন; সুতরাং যারা দুর্দিনে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে দান করবে; আল্লাহর রাস্তায় অকাতরে দান করবে; আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালোবাসেন
৫. ন্যায়বিচারকারী : ন্যায়বিচারকারীকে মহান আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন। এ কারণেই মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে- ‘আর তোমরা ন্যায়বিচার করো। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন’ (সূরা হুজরাত, আয়াত-৯)।
এখন প্রশ্ন হলো- এ ন্যায়বিচার কি শুধু বিচারকই করবে, নাকি অন্য কেউ এ দায়িত্ব পালন করবে? সহজভাবে বলা যায়- জবাবদিহিতার প্রশ্ন যাদের কাছে আসে, তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, জাস্টিজ মেইনটেন করতে হবে; তবেই আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালোবাসবেন।
তা হতে পারে সে শিক্ষকের ক্ষেত্রে, হতে পারে পরিবারের কর্তার ক্ষেত্রে, হতে পারে মসজিদে ইমামের ক্ষেত্রে। শিক্ষক তার ছাত্রের প্রতি ন্যায়বিচার করবে; পরিবারের কর্তা তার স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালন করবে; মসজিদে ইমাম তার মুসল্লি বা মুক্তাদির প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে। দায়িত্বশীল যে-ই হোক না কেন, দায়িত্ব পালনের সব ক্ষেত্রে সঠিক জবাবদিহিতার প্রশ্নে ন্যায়বিচার বা জাস্টিজ মেইনটেন করতে পারলেই সবার সাথে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই কেবল সম্ভব মহান আল্লাহর ভালোবাসায় ধন্য হওয়া। তবেই তাদের সাথে মহান আল্লাহর ভালোবাসা হবে প্রগাঢ় হবে।
৬. আল্লাহর প্রতি ভরসাকারী : সব কাজ নিয়ম মেনে করার পাশাপাশি আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে। আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল হতে হবে। যারা সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করেন, মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালোবাসেন মর্মে কুরআনে এভাবে ঘোষণা দিয়েছেন- ‘অতঃপর তুমি কোনো সঙ্কল্প গ্রহণ করলে আল্লাহর প্রতি নির্ভর করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ (তাঁর ওপর) নির্ভরশীলদের ভালোবাসেন’ (সূরা ইমরান, আয়াত-১৫৯)। মনে রাখতে হবে, কোনো ভয় ও বিপদে মুমিন হতাশাগ্রস্ত হতে পারে না। কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেও সুস্থ হওয়ার ব্যাপারে মহান আল্লাহর ওপর প্রবল ভরসা রাখতে হবে। নিরাশায় নিজের জীবন বিপন্ন করতে পারে না। কোনো মুমিন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা ব্যক্তির মধ্যে কখনো আত্মহত্যা কিংবা আত্মঘাতী কোনো কাজের সিদ্ধান্ত আসতে পারে না। কারণ যারা আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল কিংবা ভরসাকারী, আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালোবাসেন।
৭. মুত্তাকিদের ভালোবাসেন : মুত্তাকি তথা যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালোবাসেন। কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন- ‘অবশ্যই যে তার অঙ্গীকার পালন করে এবং সংযত হয়ে (আল্লাহকে ভয় করে) চলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন’ (সূরা ইমরান, আয়াত-৭৬)। মুত্তাকি মানে কি? মুত্তাকি হচ্ছে, কুরআন-সুন্নাহর ওপর পরিপূর্ণ আমল করা। তাকওয়া মানে হলো- আল্লাহ তায়ালা বান্দার গতিবিধির ওপর পরিপূর্ণ নজর রাখছেন, বান্দা কী করছে সব কিছুই রেকর্ড হচ্ছে, বান্দার ছোট-বড় সব কাজই আল্লাহ রেকর্ড করছেন, সব কাজের ব্যাপারেই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে- এ বিশ্বাসকে অন্তরে রেখে কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক জীবন গঠন করাই হলো তাকওয়া। এভাবে তাকওয়া অর্জন করে যে নিজেকে মুত্তাকি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে; আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ওই মুত্তাকি বান্দাকে তিনি ভালোবাসেন।
৮. কোমলতাকে ভালোবাসেন : হাদিসের বর্ণনায় এসেছে- আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যারা কাজকর্মে কোমলতা প্রদর্শন করবে, কঠোরতা নয়; (সহকর্মী, আত্মীয়স্বজনের সাথে) সর্ব ক্ষেত্রে যার মধ্যে বিনয় আছে; আমি আল্লাহ তায়ালা তাকে মহব্বত করি, ভালোবাসি। আর জটিলতা ও কঠিনতা নয়; বরং সহজতাকে যে প্রাধান্য দেবে; আমি আল্লাহ তায়ালা তাকে মহব্বত করি, ভালোবাসি। যে বান্দা প্রতিনিয়ত মুক্তি পেতে আমার কাছে দোয়ার মধ্যে মশগুল থাকে; আমি সেই বান্দাকে মহব্বত করি, ভালোবাসি।
মুমিন-মুসলমানের উচিত, কুরআন-সুন্নাহ ঘোষিত সব ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করা। আর এসব কাজের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা পেলে তিনি বান্দাকে ভালোবাসবেন। আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হজরত দাউদ আ:-এর দোয়াটি বেশি বেশি পড়ার কথা হাদিসে এসেছে- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা হুব্বাকা ওয়া হুব্বা মাইঁ ইউহিব্বুকা ওয়াল আমালাল্লাজি ইয়াবলুগুনি হুব্বাকা আল্লাহুম্মাযআল হুব্বাকা আহাব্বা ইলাইয়্যা মিন নাফসি ওয়া আহলি ওয়া মিনাল মায়িল বারিদি’ (মিশকাত)। অর্থ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার ভালোবাসা লাভের আহ্বান করছি। তোমার সাথে যেন আমার ভালোবাসা হয়ে যায়। তোমাকে যারা ভালোবাসে তাদের সাথেও যেন আমার ভালোবাসা হয়ে যায়। আর যে কাজে তুমি পছন্দ করো সে কাজের সাথে অর্থাৎ তোমার হুকুম-আহকামের সাথে যেন ভালোবাসা হয়ে যায়। হে আল্লাহ! তোমার ভালোবাসা যেন আমার কাছে আমার নিজের চেয়েও বেশি হয়। আমার পরিবারকে যত বেশি ভালোবাসি তার চেয়েও যেন বেশি হয়। এমনকি ঠা-া পানীয় থেকেও যেন তোমার ভালোবাসা আমার কাছে বেশি হয়। সুতরাং যারা আল্লাহর ভালোবাসা পাবে দুনিয়া ও আখিরাতে তারাই হবে সফল ও কামিয়াব। তারাই হবে চিন্তামুক্ত ঈমানদার মুসলমান। লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া, চট্টগ্রাম