রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে টানা তৃতীয় মৌসুমও উৎপাদন বন্ধ থাকবে ছয়টি মিলের। আট লাখ টন আখ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে নতুন মাড়াই মৌসুম। নয়টি চিনিকলে চলতি মৌসুমের চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার টন চিনি। যা সর্বশেষ মৌসুমের মোট চিনি উৎপাদনের প্রায় দ্বিগুণ। তবে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) উৎপাদন বিভাগ-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, টানা লোকসানের বোঝা, পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন, মূলধন ও জনবল সংকট, বকেয়ার কারণে আখ সরবরাহে চাষীদের অনীহাসহ বিভিন্ন কারণে লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। শুক্রবার নর্থবেঙ্গল চিনিকলে মৌসুমের প্রথম আখ মাড়াই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী ২ ডিসেম্বর নাটোর সুগার মিলস, রাজশাহী সুগার মিলস ও জিলবাংলা সুগার মিলসের উৎপাদন শুরু হবে। ২৩ ডিসেম্বর উৎপাদন শুরু হবে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি) লিমিটেড, মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস, ফরিদপুর সুগার মিলসের। সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বর উৎপাদনে যাবে জয়পুরহাট সুগার মিলস লিমিটেড। তবে গত দুই মৌসুমের মতো প গড়, সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুর, রংপুর, পাবনা ও কুষ্টিয়া সুগার মিলের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। টানা লোকসান, মূলধন সংকটের কারণে এসব চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএসএফআইসি।
বিএসএফআইসি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সরকারি মিলগুলোর প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন খরচ হয় ২০০ টাকারও বেশি। এ কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত সিংহভাগ চিনিকল দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে রয়েছে। সরকার ভর্তুকি দিয়ে এসব মিলের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে আসছে। বর্তমান বিশ্বে তিন-চার টন আখ দিয়ে এক টন চিনি উৎপাদন করলেও দেশীয় মিলগুলোর টনপ্রতি চিনি উৎপাদনে সাড়ে ছয় টন আখের প্রয়োজন হয়। দীর্ঘদিনের পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন চালানোয় খরচও বেশি হয়। এ কারণে সরকারি চিনিকলের লোকসানের পরিমাণও বেশি। দীর্ঘদিনের লোকসানের কারণে অর্থ বরাদ্দের অপ্রতুলতায় সরকার ছয়টি মিলের চিনি উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের পরিচালক (উৎপাদন ও প্রকৌশল) মো. এনায়েত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, নভেম্বর থেকে উৎপাদন মৌসুম শুরু হলেও আখ পাওয়া সাপেক্ষে এপ্রিল-মে পর্যন্ত চিনি উৎপাদন করে সরকারি মিলগুলো। বিগত কয়েক বছর আখের সরবরাহ কম থাকায় মৌসুমের শুরুতেই ছয়টি মিলের উৎপাদন স্থগিত রাখা হয়েছিল। আসন্ন মৌসুমেও আগের মতোই নয়টি মিলে উৎপাদন শুরু হবে। তবে আখ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে বিগত কয়েক বছরের চেয়ে নতুন মৌসুমে চিনি উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি মিলগুলোতে ১ লাখ ১৫ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও উৎপাদন হয়েছিল ৮২ হাজার টন। ২০২০-২১ মৌসুমে উৎপাদন হয়েছিল ৪৮ হাজার ৮১ দশমিক ৬০ টন এবং সর্বশেষ ২০২১-২২ মৌসুমে রেকর্ড ২৫ হাজার টন চিনি উৎপাদন করেছে সরকারি নয়টি চিনিকল। আগামী উৎপাদন মৌসুমে ৫৩ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও সেটি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়ে রয়েছে বিএসএফআইসির উৎপাদন বিভাগ।
দেশে কয়েক মাস ধরে চিনির বাজারে অস্থিরতা চলছে। ব্যাংকে ডলার সংকট, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ রিজার্ভ সংকটে ঋণপত্র খোলার হার কমেছে। জ্বালানি সংকটের কারণে বেসরকারি বিভিন্ন মিলের উৎপাদন কমেছে অর্ধেকে। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকা, আমদানি কমে যাওয়ার কারণে দেশের চিনির দাম অতীতের রেকর্ড ভেঙে খুচরা পর্যায়ে ১২০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ কয়েক দফায় দাম বাড়িয়ে কেজিপ্রতি খোলা চিনির দাম সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে ১০২ টাকা। দেশীয় রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলোর চিনির উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণেও সরকারি ভূমিকা আগের তুলনায় কমছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এক মাসে চিনির মণপ্রতি দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। এ সময় প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করলেও বর্তমানে সেটি ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। মিলগুলো থেকে চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ না থাকায় বাজারে সংকট রয়েছে। যার কারণে সরকারি নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চিনি।
বিএসএফআইসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চিনি শিল্পের আধুনিকায়ন ও পর্যাপ্ত মূলধন পাওয়া না গেলে সরকারি মিলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি এবং লাভের ধারায় ফেরা কঠিন। জনবল কাঠামো ও উৎপাদন সংকটের কারণে প্রায় বাজারমূল্যের সমান খরচ হয় উৎপাদনে। এর পরও রাষ্ট্রায়ত্ত মিল রক্ষা, শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, আখচাষীদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিবেচনায় দুই-তৃতীয়াংশ মিল চালু রাখা হয়েছে। এখনো বন্ধ মিল ও চালু মিলগুলোতে আখ সরবরাহকারী অনেক চাষীর বিপুল পরিমাণ পাওনা বকেয়া রয়েছে বিএসএফআইসির কাছে। নতুন করে উদ্যোগ ও বিনিয়োগ করা না গেলে রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলোর লোকসানের ভার বইতে হবে বলে মনে করছেন তারা।