শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৫৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::

মিরাজের তাৎপর্য ও শিক্ষা

মাওলানা কাওসার আহমদ যাকারিয়া:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

মিরাজ রাসূল সা:-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি মুজিজা। মিরাজের এ মুজিজা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ এবং মহিমান্বিত। মুহাম্মাদ সা:-এর দু’টি বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যা অন্য কোনো নবীর ভাগ্যে হয়নি। দুনিয়াতে এ মিরাজের ঘটনা এবং আখিরাতে মাকামে মাহমুদ ও শাফায়াত। রাসূল সা:-এর জীবনে দু’টি ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর একটি মিরাজ। অন্যটি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত। মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মাদ সা:-কে যে সম্মাননা দিয়েছেন, এ সম্মাননা মাখলুকাতের মধ্যে আর কাউকে দেয়া হয়নি। একজনের জন্য একবারই এ মিরাজের আয়োজন করা হয়েছে।
মিরাজকে মিরাজ এ জন্যই বলা হয়, মিরাজ অর্থ সিঁড়ি। মসজিদে আকসা থেকে বের হওয়ার পর রাসূল সা:-এর জন্য জান্নাত থেকে সিঁড়ি আনা হয়েছিল এবং এর মাধ্যমেই তিনি আসমানে পৌঁছেছেন।
কেউ কেউ বলেছেন, মিরাজের অর্থ চড়া, আরোহণ করা বা উঁচুতে ওঠা। একইভাবে মিরাজ তথা সিঁড়ি বা সোপানকেও বলা হয়। রাসূল সা: যেহেতু ওই রাতে ভূম-লের এ গৃহবসতি ছেড়ে সাত আকাশ, সিদরাতুল মুনতাহা এবং এ থেকেও আরো উঁচুতে উঠে আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনগুলো দেখেছেন সে জন্য এ মহিমান্বিত ও গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণকে মিরাজ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
কুরআনুল কারিমের দু’টি সূরা- সূরা বনি ইসরাইল ও সূরা নাজমে মিরাজের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। অধিকাংশ বর্ণনানুযায়ী হিজরতের আগে, নবুওয়াতের ১২তম বছর রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত নবীজী সা:-এর মিরাজের ঘটনা ঘটে।
মিরাজের ঘটনায় জান্নাত ও জাহান্নামসহ বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ করেছেন নবীজী। বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত বর্ণনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বিচিত্র ঘটনা থেকে নির্ভরযোগ্য ঘটনা উল্লেখ করলে বিবরণ পূর্ণতা পাবে বলে মনে হয়। যেমন-
১. এ রাতে নবীজী জাহান্নাম পরিদর্শনে গেলে মালেক নামক জাহান্নামের প্রধান রক্ষী নবীজীকে সালাম ও অভ্যর্থনা জানান।
২. তিনি দাজ্জালকেও দেখেছিলেন।
৩. এমন এক দল লোকের পাশ দিয়ে নবীজী গমন করেছিলেন, যাদের নখ ছিল তামার। এই নখ দিয়ে তারা স্বীয় মুখমণ্ডল ও বক্ষ আঁচড়াচ্ছিল। এদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জিবরাইল নবীজীকে জানালেন, এরা সেই লোক, যারা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত। অর্থাৎ একে অপরের গিবত ও মানহানি করত। অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়; বরং দুনিয়াতে গিবতকারী এসব লোকদের মৃত ভক্ষণ করতে দেখেছিলেন নবীজী।
৪. এই মহান রাতে নবীজী এমন কিছু লোককে দেখতে পেয়েছিলেন, যাদের ঠোঁট কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল, ঠোঁট কাটা মাত্র তা পুনরায় জোড়া লেগে পূর্ববৎ হয়ে যেত। এদের সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জিবরাইল নবীজীকে উত্তর দিলেন, এরা এমন বিষয়ে বক্তৃতা ও ওয়াজ করত, যা তারা নিজেরা আমল করত না।
৫. শবেমিরাজে নবীজী এমন লোকদের দেখলেন, যাদের পেট ছিল এক একটি গৃহের মতো। পেটের ভেতরটি ভর্তি ছিল সাপে, যা বাইরে থেকেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। প্রশ্ন করা হলে জিবরাইল জানালেন, এরা সুদখোর।
৬. মহানবী সা: জান্নাত দেখার সৌভাগ্যও লাভ করেছিলেন।
৭. প্রাসাদে ঘেরা একটি নহর দেখতে পেলেন, যার পানি ছিল মেশকের চেয়ে বেশি সুগন্ধীময়। এটি কী- নবীজী জানতে চাইলে জিবরাইল আ: বললেন, এর নাম ‘কাওসার’, যা আপনার প্রতিপালক একমাত্র আপনার জন্যই সুরক্ষিত করে রেখেছেন।
৮. মহানবী চারটি নদীও দেখেছিলেন। এর মধ্যে দু’টি জাহেরি আর দু’টি বাতেনি। বাতেনি দু’টি জান্নাতে প্রবাহিত আর জাহেরি দু’টি হচ্ছে নীল ও ফোরাত।
৯. নবীজী জান্নাতে প্রবেশ করে একপাশে একটি হালকা আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কিসের আওয়াজ? জিবরাইল বললেন, মুয়াজ্জিন বেলালের কণ্ঠ। মিরাজ থেকে ফিরে নবীজী সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বললেন, বেলাল সাফল্য অর্জন করেছে, আমি তার জন্য এমন সব মর্তবা দেখেছি। বিভিন্ন বর্ণনায় জানা যায়, নবী করিম সা: বায়তুল মাকদিসে যাওয়া বা আসার পথে মক্কার কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাও দেখতে পেয়েছিলেন।
শবেমিরাজের সকাল বেলা। নবীজী হাতিমে কাবায় চিন্তিত মন নিয়ে একান্তে বসে আছেন। মনে মনে ভাবছেন, রাত্রে সংঘটিত মিরাজ ও ইসরার কথা প্রকাশ করলে মানুষ আমাকে মিথ্যুক ঠাওরাবে না তো? ইতোমধ্যে কাছ দিয়ে যাচ্ছিল আবু জাহল। নবীজীর কাছে বসে বিদ্রƒপের ছলে বলল, কোনো ব্যাপার আছে নাকি? নবীজী বললেন, হ্যাঁ। সে বলল কী? তিনি জবাব দিলেন, আজ রাতে আমার মিরাজ হয়েছে। সে বিস্ময়ের সাথে সুধাল, কতদূর পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল? নবীজী বললেন, বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত। সে আরো ঠাট্টা করে বলে উঠল, চমৎকার তো! এরপর সকালেই তুমি আমাদের কাছে এসে গেলে? তিনি দৃঢ়তার সাথে বললেন, হ্যাঁ। এরপর আবু জাহল কথা না বাড়িয়ে তাঁকে বলল, আচ্ছা! আমি যদি পুরো কওমকে ডেকে নিয়ে আসি তাহলেও কি তুমি একই কথা বলতে পারবে? নবীজী আরো সুদৃঢ় হয়ে বললেন, অবশ্যই। আবু জাহল লুয়াই ইবনে কাব গোত্রের নাম ধরে ডাকতে লাগল। আর তারাও দলে দলে খানায়ে কাবায় সমবেত হতে লাগল। সবাই এসে উপস্থিত হলে আবু জাহল বলল, আমাকে যা কিছু তুমি শুনিয়েছিলে, পারলে তা এদের কাছেও ব্যক্ত করো। নবীজী পুনরায় একই ঘটনা তাদের সম্মুখে ব্যক্ত করলে কিছু লোক বিস্ময়ে হাতের উপর হাত রাখল। আবার অনেকেই হতবাক হয়ে মাথায় হাত দিলো। তারা বলল, তাহলে তুমি কি আমাদের কাছে বায়তুল মুকাদ্দাসের অবস্থা বর্ণনা করতে পারবে? উল্লেখ্য, উপস্থিত অনেকেই বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিল।
নবীজী বলেন, আমি তাদের কাছে বায়তুল মুকাদ্দাসের অবস্থা বর্ণনা করতে লাগলাম। কিছু বিষয় আমার কাছে অস্পষ্ট মনে হচ্ছিল। মনে মনে আমি খুব চিন্তিত হচ্ছিলাম। আমি তখনো কাবার হাতিমে পুরো কওমের সামনে দ-ায়মান, ইতোমধ্যে পুরো বায়তুল মুকাদ্দাস আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত করা হলো। আকিলের ঘরের উপর উদ্ভাসিত বায়তুল মুকাদ্দাস আমি স্বচক্ষে দেখে দেখে সব কিছু নিঃসঙ্কোচে বলতে লাগলাম। শুনে উপস্থিত লোকেরা মন্তব্য করল, মানচিত্র ও অবস্থা তো সঠিকই বর্ণিত হয়েছে।
মক্কার কোনো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন হজরত আবু বকর রা:। মক্কার কাফেররা তাকে এ বিস্ময়ের কথা বলে সুধাল, তবুও কি তুমি তাকে বিশ্বাস করবে? হজরত আবু বকরের হৃদয়ে ঈমানের বহ্নিশিখা জ্বলে উঠল। তিনি এক আকাশ আস্থা নিয়ে সুদৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি তো এর চেয়েও আরো দূরের অনেক জটিল বিষয়েও তাঁকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে আসা আসমানি বার্তাগুলোর ওপর রয়েছে আমার অটল বিশ্বাস ও সুদৃঢ় ঈমান।
মিরাজের শিক্ষা : মিরাজের এ মর্যাদাপূর্ণ ঘটনা সিরাতেরই একটি অংশ। এ ঘটনায় আমাদের জন্য অনেক সবক রয়েছে। কারণ রাসূল সা:-এর গুণাবলিও অবশ্যই আমাদের জন্য অনুকরণীয়, শুধু তাঁর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তাঁর প্রতিটি চরিত্র মাধুরীতে শুধু তিনিই উপকৃত হননি; বরং অন্যদের জন্যও এতে উপকার রয়েছে। মিরাজ তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এ মিরাজ দিয়ে শুধু তিনিই উপকৃত হয়েছেন এমন নয়; বরং আমাদেরও এ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। হাকিমুল উম্মাহ হজরত থানভী রহ: বলেন, রাসূল সা:-এর কোনো গুণই ব্যক্তিপর্যায়ের ছিল না। এ জন্য মিরাজের এ ঘটনা শুধু যে রাসূল সা:-এর পূর্ণতা এবং মাহাত্ম্যের সুস্পষ্ট প্রমাণ তা নয়; বরং আমাদের জন্যও এতে শিক্ষা ও উপকার রয়েছে। রাসূল সা:-এর প্রতিটি কামালাত থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। তার প্রতিটি গুণ নিয়ে ভাবা উচিত, আর যেহেতু মিরাজ রাসূল সা:-এর একটি অসাধারণ পূর্ণতা- সুতরাং তা থেকেও আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত।
কিছু সবক ও শিক্ষা তো সুস্পষ্ট যা মিরাজের ঘটনা নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করলেই বুঝে আসে। তবে কিছু বিষয় সূক্ষ্ম ও গভীর, যা খুব বেশি মনোযোগ ও ধ্যান দিয়ে ভাবলে এবং চিন্তা করলে বুঝে আসে। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. আল্লাহর রাস্তায় যতই দুঃখ-কষ্ট এবং বিপদ-আপদ আসুক না কেন, যতই অপমান কিংবা নির্যাতন হোক না কেন, তাতে ভীত কিংবা বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কেননা, এর প্রতিটির বিনিময়ে সুউচ্চ সম্মান, মর্যাদা ও আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জিত হয়, যা আমাদের মাকসাদে হায়াত, আমাদের জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। মক্কায় টানা ১২ বছরের অব্যাহত অবর্ণনীয় নির্যাতন, অপমান এবং জুলুম বঞ্চনা সহ্য করার পর অবশেষে রাসূল সা:-কে মিরাজের মতো সুমহান সম্মানে ভূষিত করা হলো।
২. দ্বীনের কাজে রুহানি শক্তি বৃদ্ধিই আসল রহস্য। বস্তুগত উন্নয়ন দ্বিতীয় পর্যায়ের চাহিদা। রুহানি শক্তির উন্নতি ছাড়া দ্বীনের রাস্তায় অটল, অবিচলতা বা ইস্তিকামাত সম্ভব নয়। লেখক : মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com