ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- ’যে দেশে গুণীদের কদর নেই; সে দেশে গুণীজন জন্মায় না।’ কিন্তু কর্মব্যস্ত মানুষ নিজ নিজ কর্মের চিন্তা-ভাবনায় এতো মত্ত যে, অন্য কোনো কিছুর দিকে তাকাবার সময়ই নেই! নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বিকশিত করার আয়োজনে ব্যস্ত সবাই। সমাজে অল্প কিছুসংখ্যক লোক আছেন যারা অন্যের কথা ভাবেন। সমাজের কথা ভাবেন। মানুষকে ভাবান। ভাবতে শেখান। তেমনি অন্তরের আলোকে উদ্ভাসিত এ এক বিমগ্ন পথিক সাহিত্যের এক নিষ্ট সাধক কবি আবদুল হালীম খাঁ।
বাংলা কবিতা হাজারো কবির অফুরন্ত সাধনার ফলে বিশ্ব কবিতার অঙ্গনে নিজেকে করেছে প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক বাংলা কাব্যে আবদুল হালীম খাঁ একটি অনন্য নাম। আমাদের কাব্য কলায় বিশ্বাসের পক্ষে, শিকড়ের সন্ধানে, ঐতিহ্যের শাশ্বত পথে যে কাব্য ধারা বিকাশমান আবদুল হালীম খাঁ কাব্যবিশারদ এর কবিতা তাতে নবসংযোগ। আবদুল হালীম খাঁ অনেকের ভিড়ে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। একটি ইনস্টিটিউশন। প্রতিভার বহু মাত্রিকতায় তাঁর রয়েছে এক স্বতন্ত্র অধিষ্টান। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, জীবনীকার, সম্পাদক ও সংগঠক।
আবদুল হালীম খাঁ ১৯৪৪ সনের ১৭ই জুলাই বুধবার প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য আর লোক-সাহিত্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার বামনহাটা গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম বাহাদুর আলী খাঁ ও মাতা মরহুমা মরিয়ম বেগম। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে কবি দ্বিতীয়। কবি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়া লেখা শুরু করে ১৯৬০ সালে হেমনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন করটিয়া সা’দত কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৬৭ সনে বিএ পাস করেন এরপর ১৯৬৯ সনে বিএড করেন।
আবদুল হালীম খাঁ ১৯৬০ সালে নিজ গ্রামের আবদুল মজিদ খাঁর কন্যা রওশনারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৪ পুত্র সন্তানের জনক।
১৯৭০ সনে সাপ্তাহিক জাহানে নও ও দৈনিক সংগ্রামে যোগ দানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। সাংবাদিকতায় রয়েছে তার অনেক অবদান। তিনি ভূঞাপুর প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৯৭ সনে বারই হাইস্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন এবং ২০০২ সালে বাগবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
কবি আবদুল হালীম খাঁ বিশ্বাস ও মূল্যবোধের চরম সংকটের সন্ধিক্ষণে বিশ্বাসের স্বপক্ষে সাহিত্যাঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন। ১৯৬১ সনে টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক হৃতকরী পত্রিকায় প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতা ’বর্ষার আনন্দ’। এরপর তিনি আর থামেননি। একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে তার লেখা । তিনি কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে বিচরণ করতে থাকেন সাহিত্যের সব ক’টি শাখায়। আজও তার কলম চলছে দুর্বার গতিতে।
পৃথিবীর সব কবিরাই কম বেশী যুদ্ধ করেন। তারা যুদ্ধ করেন অসুন্দর, অকল্যাণ, অমানিশা আর অন্ধকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিভ্রান্তির উপত্যকায় ঘুরে বেড়ানো অধিকাংশ কবির অভ্যাস হলেও সত্যবাদী কবির সন্ধানও আমরা পাই। কবি আবদুল হালীম খাঁ তেমনি চোখে বিপ্লবের স্বপ্ন লালিত এক সাহসী যোদ্ধা। তিনি লিখেছেন-
যুদ্ধই এক্ষণে একমাত্র মহৎ শিল্পকর্ম
যোদ্ধারাই মহান দেশপ্রেমিক
আজকাল দেশের সব কষ্ট পরিত্রাণের জন্য
যুদ্ধ ছাড়া আমার হাতে আর কোন কর্মসূচী নাই। (আমি একটা যুদ্ধ চাই)
কবি আবদুল হালীম খাঁ সত্য ও সুন্দরের জন্য নীরব সংগ্রামে জীবনের ৭২টি বসন্ত পেরিয়ে এসেছেন। এখনও তিনি শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, সমাজ রাষ্ট্র তথা আমরা তাকে কি দিয়েছি? ব্যথায় কাতর কবি লিখেছেনÑ
পাথর ভাঙতে ভাঙতে
কবে যে ভেঙেছে শিরদাঁড়া
তবু আজো কোথা থেকে কেউ
দিলো না একটু সাড়া। (প্রতিদিন আমার পৃথিবী)
কিন্তু তবুও কবি হতাশ নন। ছুটে চলছেন দুঃসাহসিকতার সাথে। সংগ্রাম করছেন সত্যে ও সুন্দরের পথে। পাহাড় কেটে কেটে মাঠ গড়ে সেখানে সতেজ বৃক্ষের চারা রোপণ করছে। স্বপ্ন দেখছেন নতুন এক পৃথিবীর। কবি লিখেছেনÑ
জানি ফুলের মালা কেউ দেবে না
এ গলে আমার,
তবু সারা জীবন চাষ করবো
ফুলের খামার। (প্রতিদিন আমার পৃথিবী)
কবি আবদুল হালীম খাঁ এর লেখা নিয়মিত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত তাঁর কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, জীবনী, নাটকসহ প্রায় ৪২টি গ্রন্থ প্রকাশ হলেও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে অনেকগুলো মূল্যবান পা-ুলিপি। যা প্রকাশ হচ্ছে না বা তিনি প্রকাশ করতে পারছেন না। তিনি সম্পাদনা করেছেন মাসিক রেনেসাঁ, মাসিক প্রতিভা, পাক্ষিক ভুইয়াপুর বার্তাসহ বেশকিছু পত্র-পত্রিকা।
কবির প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: কবিতা- ও জীবন ও সুখ, দাঁড়াও বাংলাদেশ, বুকের ভেতর প্রতিদিন, প্রতিদিন আমার পৃথিবী, আমি একটা যুদ্ধ চাই ইত্যাদি। উপন্যাস- শাহ্জালালের জায়নামায, স্বপ্ন দিয়ে গড়া, কাশ্মীরের পথ প্রান্তরে, খেদাও ইত্যাদি। কিশোর উপন্যাস- কালো ছেলের অবাক কা-, দোয়েল পাখির বিশ্ব ভ্রমণ, নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন ইত্যাদি। জীবনী- আল কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক মৌলভী নইমউদ্দিন, ছোটদের ওমর ইবনে আবদুল আজিজ, জনমানুষের বন্ধু প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ইত্যাদি। প্রবন্ধ- বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ আল্লামা শাহ্ আবদুল জব্বার, ভূইয়াপুর নামের ইতিহাস, মোশাররফ হোসেন খানের কবিতা, কবি মোজাম্মেল হক ও তার কবিতা ইত্যাদি। গল্প: রিয়াদেও মা। নাটক: মাজার শরীফ, আমি একজন চেয়ারম্যান দেখতে চাই।
কবি আবদুল হালীম খাঁ কাব্যবিশারদ তাঁর সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯১ টাঙ্গাইল মুকুট সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক লাল গোলাপ সংবর্ধনা, ১৯৯২ সালে পাবনা জেলা পরিষদ কর্তৃক সংবর্ধনা ও কাব্যবিশারদ খেতাব প্রদান, ১৯৯৩ সালে প্রতিবাদ বহুমুখী শিল্পী সংসদ কর্তৃক লাল গোলাপ সংবর্ধনা ও ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম বায়তুশ্ শরফ কর্তৃক সংবর্ধনা ও পুরুস্কার পেয়েছেন।
আবদুল হালীম খাঁ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবি মুফাখ্খারুল ইসলাম লিখেছেন- ’যত কম কথায় যত বেশী ভাব জড়ান যায় ততোই কবির কবিত্ব। যত কম শব্দে পাঠককে বেশী ভাবিয়ে তোলা যায় ততোই কবির মুন্সিয়ানা। তেমন লেখা পড়ার সৌভাগ্য আর আমাদের এখন হচ্ছে না। হঠাৎ যেন কবি আবদুল হালীম খাঁ’র লেখা পড়ে তেমন কথার চমৎকারিত্ব ও ভাবের সৌকর্ষ্য আবিষ্কার করলাম। এমন প্রতিভা তো ইদানিং কায়েমিরা সহজে উঠতে দেয় না। তবু যারা এমন হাসনাহেনার গুচ্ছের মতো কবিতা ক’টি নিয়ে রাত পালিয়ে এসে আমার দুয়ারে এ মন মাতানো খুশবু বিছিয়ে গেলেন, কবির সঙ্গে তাদের তাদের জন্যে অনেক শুকরিয়া। অনেক সহমর্মিতা।
কবি আবদুল হালীম খাঁ জীবন গড়ে উঠেছে তার চরিত্রের সরলতা, উদারতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সহনশীলতাকে কেন্দ্র করে। তাঁর চরিত্র ও মেজাজ ন¤্রতা-ভদ্রতার আবহে পরিশীলিত। সাহিত্যের পেছনে কাটিয়েছেন সারাটি জীবন কিন্তু সময় ও আধুনিকতার বৈরী ¯্রােতের আবর্তে হারিয়ে যাননি। তার কাব্য সাহিত্যে আছে জীবনের জয়গান। আছে প্রেমের উদ্দীপনা ও যৌবনের প্রাণ প্রাচুর্য্য।
কবি জীবনের বাহত্তোরটি বসন্ত সুকর্মে সগৌরবে অতিক্রম করে এসেছেন। আমাদের প্রত্যাশা তাঁর কাছ থেকে আরো পাওয়ার। তাঁর সৃজন সাধনায় আমাদের সাহিত্য ভুবন সমৃদ্ধ হবে।