কুরআন মাজিদ ও হাদিস শরিফে মু’মিন নারীর অনেক গুণের কথা আলোচিত হয়েছে। মু’মিন প্রতিটি নারীর জীবনে এ গুণগুলো থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ গুণগুলো অর্জনের মাধ্যমে একজন মু’মিন নারী পৃথিবীতে যেমন শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করতে পারবে তেমনি আখিরাতেও পাবে সুখময় জান্নাতের ঠিকানা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘পুরুষ নারীদের অভিভাবক। যেহেতু আল্লাহ তাদের একের ওপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু পুরুষরা নিজেদের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সতীসাধ্বী স্ত্রীরা অনুগত হয়ে থাকে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে আল্লাহ প্রদত্ত হিফাজতে (তার অধিকারগুলো) সংরক্ষণ করে।’ (সূরা নিসা-৩৪) এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মু’মিন নারীর তিনটি গুণ উল্লেখ করেছেন।
প্রথম গুণ : একজন মু’মিন নারী হবে ‘সালিহা’ তথা সতী-সাধ্বী ও দ্বীনদার। ‘সালিহাত’ শব্দের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে জারির তাবারি বলেন, ‘দ্বীনের সঠিক অনুসারী সৎকর্মশীল নারীরা।’ (তাফসিরে তাবারি-৬/৬৯১) এ গুণের অধিকারী নারীদেরকে রাসূলুল্লাহ সা: পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘পৃথিবী পুরোটাই সম্পদ। আর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো সালিহা তথা সতীসাধ্বী ও নেককার নারী।’ (মুসলিম-১৪৬৭)
দ্বিতীয় গুণ : একজন মু’মিন নারী হবে ‘কানেতা’ তথা আনুগত্যশীল। ‘কানেতাত’ শব্দের ব্যাখ্যায় আল্লামা কাতাদা রহ: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ও স্বামীর অনুগত নারীরা।’ (তাফসিরে তাবারি-৬/৬৯১)
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন নারী উত্তম? তিনি বললেন, ‘যাকে দেখলে স্বামী আনন্দবোধ করে, যাকে আদেশ করলে আনুগত্য করে এবং স্ত্রী ও সম্পদের ব্যাপারে স্বামী যা অপছন্দ করে তা থেকে বিরত থাকে।’ (আহমাদ-৯৫৮৭) স্বামীর আনুগত্যের মাধ্যমে একজন মু’মিন নারী জান্নাতেও গড়ে নিতে পারে নিজ ঠিকানা। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পড়বে, রমজানের রোজা রাখবে, নিজ লজ্জাস্থান হিফাজত করবে এবং স্বামীর আনুগত্য করবে সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করবে।’ (ইবনে হিব্বান-৪১৬৩)
তৃতীয় গুণ : একজন মু’মিন নারী স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার ধন-সম্পদ ও নিজ সতীত্ব হিফাজত করবে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘উত্তম স্ত্রী সে যার দিকে তাকালে তোমাকে আনন্দিত করে, আদেশ করলে আনুগত্য করে, আর তুমি দূরে থাকলে সে তার নিজের ব্যাপারে এবং তোমার সম্পদের ব্যাপারে তোমার অধিকার রক্ষা করে।’ (বাযযার-৮৫৩৭) আবু উমামা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তাকওয়া অবলম্বনের পর কোনো মু’মিন পুরুষের জন্য সতী স্ত্রীর থেকে অধিক কল্যাণকর আর কিছু নেই। কেননা, স্বামী তাকে আদেশ করলে সে তা মান্য করে। স্বামী তার দিকে তাকালে সে তাকে আনন্দ দেয়। স্বামী তার সম্পর্কে কোনো কসম খেলে সে স্বামীর কসম পূর্ণ করতে সহযোগিতা করে। আর স্বামী কোথাও গেলে স্ত্রী নিজ সতীত্ব ও স্বামীর সম্পদ সংরক্ষণের ব্যাপারে স্বামীর কল্যাণকামী হয়।’ (ইবনে মাজাহ-১৮৫৭) কুরআন মাজিদের অন্যান্য আয়াত ও হাদিস শরিফে মু’মিন নারীর আরো কিছু গুণের বর্ণনা এসেছে। সেগুলোর আলোকে এখানে আরো কয়েকটি গুণ উল্লেখ করা হলো।
চতুর্থ গুণ : একজন মু’মিন নারী স্বামীকে দ্বীনদারির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। সাহাবায়ে কেরাম রা: একবার রাসূলে কারিম সা:-এর কাছে আবেদন করলেন, আমরা যদি জানতাম কোন সম্পদ সর্বোত্তম যা আমরা অর্জন করব! (তাহলে কত না ভালো হতো!) তখন রাসূলল্লাহ সা: বললেন, ‘সর্বোত্তম সম্পদ হলো, জিকিরকারী জিহ্বা, শোকরগোজার অন্তর এবং মু’মিন স্ত্রী যে তার স্বামীকে তার ঈমানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।’ (তিরমিজি-৩০৯৪) ঈমানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা, তথা স্বামীকে পরিপূর্ণরূপে দ্বীন মেনে চলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। মোল্লা আলী কারি রহ: লিখেন, ‘স্ত্রী স্বামীকে তার দ্বীনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। যেমন- স্বামীকে সালাত, রোজা ও অন্যান্য ইবাদতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে এবং তাকে ব্যভিচার ও অন্যান্য গুনাহের কাজ থেকে বিরত রাখবে।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ-৪/১৫৫৬)
প ম গুণ : একজন মু’মিন নারী সচ্চরিত্রা হবে; গোপনে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনকারিণী হবে না। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘তারা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে চারিত্রিক পবিত্রতাসম্পন্ন হবে, ব্যভিচারিণী হবে না এবং গোপনে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনকারিণী হবে না।’ (সূরা নিসা-২৫) ‘তোমরা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোনো ধরনের অশ্লীল কাজের কাছে যেও না।’ (সূরা আনআম : ১৫১)
ষষ্ঠ গুণ : একজন মু’মিন নারী ইসলামের পর্দাবিধান যথাযথভাবে পালন করবে। পর্দাবিধানের সারকথা হলো- মু’মিন নারী ঘরেই অবস্থান করবে। যাদের সাথে সাক্ষাৎ করা জায়েজ নেই ; তাদের সাথে সাক্ষাৎ করবে না এবং প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হবে না। প্রয়োজনের তাকিদে বাইরে বের হতে হলে বোরকা পরিধান করে বের হবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করো। আগেকার জাহেলি যুগের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িও না। তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করো।’ (সূরা আহজাব-৩০) অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন, ‘হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুু’মিনদের নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষামাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আহজাব-৫৯) আরেকটি আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘তারা যেন নিজেদের সৌন্দর্য তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর অন্য স্ত্রীর পুত্র, ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীরা, তাদের মালিকানাধীন দাসী, যৌনকামনা নেই এমন পুরুষ খেদমতগার এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ব্যতীত অন্য কারো কাছে প্রকাশ না করে।’ (সূরা নূর-৩১)
সপ্তম গুণ : একজন মু’মিন নারী সতীসাধ্বী হওয়ার পাশাপাশি সরলমতী হবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘যারা সতীসাধ্বী, সরলমতী মু’মিন নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সূরা নূর-২৩) লেখক : পরিচালক, আল-হাদি দারুল কুরআন মাদরাসা, বড়ভিটা, ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম