ঈমান মহান আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। একজন মু’মিন বা ঈমানদার তখনই প্রকৃত মু’মিন হয়ে উঠবে, যখন তার মধ্যে ঈমানের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠবে এবং তার সিরাত ও সুরত উভয় ক্ষেত্রে মহানবী সা:-এর আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটবে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা একজন শ্রেষ্ঠ মু’মিনের গুণাবলি বর্ণনা করে বলেন- ‘সেসব মু’মিনই প্রকৃত সফল, যারা তাদের সালাতে বিনয় অবলম্বন করে। যারা নিরর্থক কাজ থেকে বিরত থাকে। যারা জাকাতের ব্যাপারে কর্মতৎপর। যারা নিজেদের যৌনাঙ্গ হিফাজত করে। (কিন্তু তাদের স্ত্রী ও অধিকারভুক্ত দাসীরা ছাড়া। এতে তারা তিরস্কৃত হবে না। অতএব যারা এই দু’টি পন্থা ছাড়া অন্যভাবে কাম চরিতার্থ করে তারা শরিয়তের সীমা লঙ্ঘন করে থাকে) আর যারা আমানত ও চুক্তি রক্ষায় সচেতনতা অবলম্বন করে। যারা নিজেদের সালাতকে পূর্ণরূপে হিফাজত করে। তারাই সেসব ব্যক্তি, যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী এবং সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে।’ (সূরা আল মু’মিনুন : ১-১০) একজন মু’মিন শুধু নিজের স্বার্থ নয়; বরং অন্য মু’মিনের হকের বিষয়েও সতর্কতা অবলম্বন করবে। ইসলাম ধর্ম মুসলিম পরস্পরকে ভাই হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই একজন ভাইয়ের দায়িত্ব হচ্ছে অন্য ভাইকে বিপদে সহযোগিতা করা। ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ দেয়া, নসিহত করা। ইরশাদ হচ্ছে- ‘মু’মিনদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে যে, তারা একে অপরের ভাই। অতএব তোমরা ভাইদের মাঝে সমঝোতা করে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে।’ (সূরা আল হুজুরাত-১০)
পরিপূর্ণ মু’মিনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- সাক্ষাতে সালাম ও কুশল বিনিময় করা। একে অন্যের খোঁজখবর নেয়া, পরস্পরের কল্যাণ কামনা করা। হাদিস শরিফে এসেছে- আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী করিম সা: বলেন, ‘তোমরা ততক্ষণ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে। আমি কি এমন একটি আমলের কথা বলে দেবো যা তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করবে? আর তা হলো- তোমরা পরস্পর ব্যাপকভাবে সালাম বিনিময় করবে।’ (মুসলিম-৫৪) মু’মিনের হৃদয় হবে আল্লাহ ও তার রাসূলের মুহাব্বতের কেন্দ্রভূমি। দুনিয়ার চাকচিক্য ও জৌলুশ তার অন্তরকে কলুষিত করতে পারবে না। এমনকি পিতা-মাতা ও সন্তানের ভালোবাসাও তার জন্য ইসলামের সুমহান আদর্শের পথে বাধা হতে পারবে না। হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- নবীজী সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততির চেয়ে অধিক প্রিয় হই।’ (বুখারি-১৫)
নিরাশা, হতাশা, অধৈর্য হয়ে পড়া প্রকৃত মু’মিনের ভূষণ নয়। সদিচ্ছার সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে লেগে থাকতে হবে। এতে করে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে সফলতা লাভ হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আর তোমরা নিরাশ হয়ো না, চিন্তিতও হয়ো না। তোমরাই জয়ী হবে যদি প্রকৃত মু’মিন হও।’ (সূরা আল ইমরান-১৩৯) একজন ঈমানদারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শয়তানের ধোঁকা থেকে নিজেকে বাঁচানো। অতএব প্রকৃত মু’মিন বান্দা শয়তানকে শত্রু জ্ঞান করবে এবং নিজেকে তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচিয়ে রাখবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্রু অতএব তাকে শত্রু হিসেবেই প্রতিপন্ন করো। নিশ্চয়ই সে তার অনুগতদের জাহান্নামের অধিবাসী হওয়ার জন্য আহ্বান করে।’ (সূরা ফাতির-০৬)
মু’মিনের পুরস্কার : একজন মু’মিনের মধ্যে ঈমানের পূর্ণতা আসার পর আল্লাহ তায়ালা তাকে নি¤েœাক্ত পুরস্কারগুলো দেবেন-
এক. অভিভাবক হিসেবে আল্লাহকে পাওয়া। মহা ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ যখন কারো দায়িত্ব নিয়ে নেন, তখন তার আর কী-ইবা সমস্যা হতে পারে? দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগৎ তার জন্য সহজ হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘আল্লাহ তায়ালা হলেন মু’মিনদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনেন।’ (সূরা আল বাকারা-২৫৭)
দুই. প্রকৃত মু’মিনরা জমিনের কর্তৃত্ব লাভ করবে। পবিত্র কুরআনে এসেছে- ‘তোমাদের মধ্যকার সত্যিকার মু’মিন ও সৎকর্মশীলদের জন্য আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করবেন। যেমনি দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তী মু’মিনদেরকে।’ (সূরা আন নূর-৫৫)
তিন. প্রকৃত ঈমানদার ছাড়া সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘শপথ মহাকালের! নিশ্চয়ই সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা ছাড়া, যারা ঈমান এনেছে, সৎ আমল করেছে ও পরস্পর পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পর পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’ (সূরা আল আসর : ১-৩)
চার. মু’মিনদের হৃদয় শীতল ও সতেজ থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- (যারা প্রকৃত মু’মিন আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। আর সত্যিকার অর্থে আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরে প্রশান্তি এসে থাকে।’ (সূরা আর র’দ-২৮)
পাঁচ. মু’মিনরা মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তারাই সৃষ্টির সেরা। তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে তাদের প্রতিদান চিরকাল বসবাসের জান্নাত, যার তলদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত। যারা সেখানে অনন্তকাল থাকবে।’ (সূরা আল বায়্যিনাহ : ৭-৮)
ছয়. প্রকৃত মু’মিনরা জান্নাতের মেহমান। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন- ‘অবশ্যই যেসব লোক ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তাদের মেহমানদারি করার জন্য ফিরদাউসের সুসজ্জিত বাগান রয়েছে। সেখানে তারা চিরকাল বসবাস করবে। কখনো সেখান থেকে বের হতে চাইবে না।’ (সূরা আল কাহাফ : ১০৭-১০৮)
হাদিস শরিফে এসেছে, নবী করিম সা: বলেছেন, ‘এমন তিনটি বস্তু রয়েছে, যার মধ্যে সেগুলো বিদ্যমান থাকবে কেবল সে-ই ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে- ১. যার মধ্যে আল্লাহ ও তার নবীর ভালোবাসা সবকিছুর চেয়ে বেশি; ২. যে ব্যক্তি কোনো বান্দাকে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসে ও ৩. যে ব্যক্তিকে আল্লাহ কুফর থেকে মুক্তি দেয়ার পর পুনরায় কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে এমনভাবে অপছন্দ করে, যেমন কোনো অন্ধ কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে।’ (মুসলিম-৪৩)
একজন ঈমানদার প্রকৃত মু’মিন হলে সে ঈমানের স্বাদ পাবে। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ইবাদতে অনেক বেশি প্রশান্তি পাবে। মন্দ ও অশালীন কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হবে। মুখে আল্লাহর জিকির ও হৃদয়ে আল্লাহর ভয় নিয়ে তার দিনাতিপাত ঘটবে। দুনিয়া হবে যেমন তার শান্তির বাসস্থান তেমনি পরকালে পাবে সে সম্মান, মর্যাদা সুখ অফুরান। লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী আইন বিভাগ, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর