মজবুত দালানকোঠা, লৌহকপাট ও নিশ্দ্রি অজেয় দুর্গ যা-ই গড়ে তুলুন না কেন, আপনাকে আমাকে ফিরে যেতে হবে। সুন্দর পৃথিবীর সব মায়া-মমতা ও ভালোবাসাকে ছিন্ন করে ছেড়ে যেতে হবে। এখানে অনন্তকাল অবস্থান করার কোনো সুযোগ নেই। স্নেহময়ী ও মমতাময়ী মা চলে গেছেন, মায়ের সাথে দরদি বাবাও চলে গেছেন। এই ধারাবাহিকতায় দুনিয়াজোড়া প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী কারুন, ফেরাউন ও নমরুদও আমোঘ এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে পারেনি। চলে যেতে হয়েছে সবাইকে। সুতরাং আমাদেরও যেতে হবে। চলে যাওয়ার পথে আপনাকে প্রথম একটি স্টেশন অতিক্রম করতে হবে। অত্যন্ত কঠিন সেই স্টেশনের নাম ‘কবর’। অনন্ত ও মহাকালের যাত্রার প্রথম স্টেশনটি যদি আপনি সফলতার সাথে অতিক্রম করতে পারেন, তাহলে পরবর্তী প্রতিটি স্টেশনই আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।
প্রথম সেই স্টেশনটি নিয়ে সব নবী-রাসূল, আসহাবে রাসূল সা: ও ইসলামের বড় বড় খেদমতকারী ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। তাদের সবাই তা থেকে মুক্তি লাভের জন্য কান্নাকাটি করেছেন। এর আরেক নাম আলমে বরজখ বা কবরের জগত। যার পরিধি মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়। মৃত্যুর পর মানুষের দেহ দাফন করা হোক বা পুড়ে ফেলা হোক, সলিল সমাধি হোক বা কোনো হিংস্র প্রাণীর পেটে চলে যাক সর্বাবস্থায় রূহ বা প্রাণ অক্ষয় থাকে। মৃত্যুর পর রূহ চলে যায় বরজখের জগতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘দোজখের আগুন, যে আগুন সামনে তাদের সকাল-সন্ধ্যায় পেশ করা হয়। কিয়ামত সংঘটিত হলে নির্দেশ দেয়া হবে, ফেরাউনের অনুসারীদের কঠিন আজাবে নিক্ষেপ করো।’ (সূরা মু’মিন-৪৬) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘অচিরেই আমি তাদের দু’বার শাস্তি দেবো। পরে তারা প্রত্যাবর্তিত হবে মহাশাস্তির দিকে।’ (সূরা তাওবাহ-১০১)
বহুসংখ্যক হাদিসে কবরের আজাব নামক বরজখের আজাবের যে উল্লেখ আছে এ আয়াত তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে সুস্পষ্ট ভাষায় আজাবের দু’টি পর্যায়ের উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত। উল্লিখিত আয়াতে ফিরাউনের অনুসারীদের সকাল-সন্ধ্যায় দোজখের আগুনের সামনে পেশ করা হয় আর ওই আগুন দেখে তারা সর্বক্ষণ আতঙ্কিত হয়ে কাটায় এই ভেবে যে, এ দোজখেই তাদের শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে থেকে যে ব্যক্তিই মারা যায় তাকেই সকাল ও সন্ধ্যায় তার শেষ বাসস্থান দেখানো হতে থাকে। জান্নাতি ও দোজখি উভয়ের ক্ষেত্রেই এটি হতে থাকে। তাকে বলা হয় কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তোমাকে পুনরায় জীবিত করে তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে নেবেন, তখন তোমাকে আল্লাহ যে জায়গা দান করবেন, এটি সেই জায়গা।’ (মুসনাদে আহমাদ)
এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন- ‘হ্যাঁ, এমন কাফেরদের জন্য, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করতে থাকা অবস্থায় যখন ফেরেশতাদের হাতে পাকড়াও হয় তখন সাথে সাথেই আত্মসমর্পণ করে এবং বলে, ‘আমরা তো কোনো দোষ করছিলাম না’। ফেরেশতারা জবাব দেয়, কেমন করে দোষ করছিলে না! তোমাদের কার্যকলাপ আল্লাহ খুব ভালো করেই জানেন। এখন যাও, জাহান্নামের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়, এখানেই থাকতে হবে চিরকাল। সত্য বলতে কী, অহঙ্কারীদের এই ঠিকানা বড়ই নিকৃষ্ট।’ (সূরা নাহল-২৯) ‘অন্য দিকে যখন মুত্তাকিকে জিজ্ঞেস করা হয়, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে কী নাজিল হয়েছে? তারা জবাব দেয়, সর্বোত্তম জিনিস নাজিল হয়েছে? এ ধরনের সৎকর্মশীলদের জন্য এ দুনিয়াতেও মঙ্গল রয়েছে এবং আখিরাতের আবাস তো তাদের জন্য অবশ্যই উত্তম।’ (সূরা নাহল-৩০) দু’টি আয়াতে মৃত্যুর পর ফেরেশতাদের সাথে মুত্তাকি ও বদকারদের আলাপ-আলোচনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলো কুরআন মাজিদের এমন ধরনের আয়াতের অন্যতম যেগুলো সুস্পষ্টভাবে কবরের আজাব ও সওয়াবের প্রমাণ পেশ করে।
আয়িশা রা: থেকে বর্ণিত- এক ইহুদি স্ত্রীলোক আয়িশা রা:-এর কাছে এসে কবরের আজাব সম্পর্কে আলোচনা করে তাকে (দোয়া করে) বলল, আল্লাহ আপনাকে কবর আজাব থেকে রক্ষা করুন! পরে আয়িশা রা: কবর আজাব সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, কবরের আজাব (সত্য)।’ আয়িশা রা: বলেন, এর পর থেকে নবী সা:-কে এমন কোনো সালাত আদায় করতে দেখিনি, যাতে তিনি কবরের আজাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেননি।’ (বুখারি-১৩৭২)
উরওয়া ইবনু জুবাইর রা: সূত্রে বর্ণিত- তিনি আসমা বিনতে আবু বকর রা:-কে বলতে শুনেছেন যে, আল্লাহর রাসূল সা: (একবার) দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন তাতে তিনি কবরে মানুষ যে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে, তার বর্ণনা দিলে মুসলমানরা ভয়ার্ত চিৎকার করতে লাগলেন।’ (বুখারি- ১৩৭৩)
বারা ইবনে আজেব রা: থেকে বর্ণিত একটি বিশাল হাদিসে এসেছে- নবী সা: বলেছেন, ‘বাকি আল গারকাদ অর্থাৎ বাকি কবরস্থানে আমরা একটি জানাজায় এসেছিলাম। নবী সা: আমাদের কাছে এসে বসলেন। আমরা তাঁকে ঘিরে বসলাম। সবাই এত চুপ যে, মনে হয় মাথার উপর পাখি বসে আছে। কবর খোঁড়ার কাজ চলছে। তিনি তিনবার করে বলে উঠলেন, আমি আল্লাহর কাছে কবরের আজাব থেকে আশ্রয় চাই। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন আজাবিল কবরে’ অর্থাৎ- হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমি তোমার কাছে কবরের আজাব থেকে আশ্রয় চাই।’ (আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ) বুখারির ১৩৭৬ নম্বর হাদিসে আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: কবরের আজাব, জাহান্নামের আজাব, জীবন-মৃত্যুর ফিতনা ও মাসিহিদ দাজ্জাল থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন।
ইবনে আব্বাস রা: বর্ণনা করেন- নবী সা: এমন দুটো কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যে কবর দুটোর বাসিন্দাদের আজাব দেয়া হচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, ‘এদের দু’জনকে আজাব দেয়া হচ্ছে অথচ তাদের এমন কোনো গুনাহের জন্য আজাব দেয়া হচ্ছে না যা দুরূহ ছিল। তাদের একজন পেশাবের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত না। আর অপরজন চোগলখুরি করে বেড়াত। অতঃপর একটি তাজা ডাল নিয়ে দু’ভাগ করে দু’কবরে গ্রথিত করলেন। অতঃপর সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কেন এরূপ করলেন? তিনি বললেন, ‘ডাল দুটো না শুকানো পর্যন্ত আশা করা যায় তাদের আজাব লঘু করা হবে।’ (বুখারি-১৩৬১ ও মুসলিম)
আনাস বিন মালিক রা: বর্ণনা করেন- নবী সা: বলেছেন, ‘যদি তোমরা দাফন-কাফন ছেড়ে না দিতে, তাহলে আল্লাহর কাছে চাইতাম, তিনি যেন তোমাদেরকে সরাসরি কবরের আজাব শোনার ব্যবস্থা করে দেন, যা আমাকে শোনানো হয়েছে।’ (মুসলিম, নাসায়ি, আহমাদ)
সুতরাং কবর নামের স্টেশন থেকে সহজে পার হওয়ার জন্য নিজের জীবনের কর্মনীতি আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসূলল্লাহ সা:-এর প্রদর্শিত পথে পরিচালিত করুন এবং বেশি করে কবরের আজাব থেকে আল্লাহ কাছে আশ্রয় চান। লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট