এ পৃথিবীতে কেউ ধনী কেউ দরিদ্র। ধনী-দরিদ্র মিলেই আমাদের এ বসুন্ধরা। ধনীর ধন আর দরিদ্রের দারিদ্র্য সব আল্লাহর পক্ষ থেকেই। দেখা যায়, অনেকে সামান্য পরিশ্রমে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যায়। আবার কেউ কেউ হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। যার পর্যাপ্ত অর্থকড়ি নেই, একমাত্র সে জানে এ দুনিয়ায় কতটা অসহায় সে! পরিবার-সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্রই অবহেলিত সে। তবে এই দুনিয়ায় তার মূল্য থাকুক আর না-ই থাকুক, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে রয়েছে তার অনন্য মর্যাদা।
হাদিস শরিফে প্রিয় নবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘দরিদ্র মু’মিনরা ধনীদের চেয়ে অর্ধদিন আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর আখিরাতের অর্ধদিনের পরিমাণ হলো পৃথিবীর ৫০০ বছর।’ (ইবনে মাজাহ-৪১২২)
শুধু ব্যবসাবাণিজ্য, আর চাকরিবাকরির মাধ্যমেই পরিবারে সচ্ছলতা আসে না; বরং অনেকসময় অকর্ম দুর্বলদের কারণেও পরিবারে সচ্ছলতা আসে। তাই ইনকামে অক্ষম ও দুর্বলদের অবহেলা করতে নেই। ইরশাদ হয়েছে- ‘দুর্বল লোকদের দোয়ায় তোমরা সাহায্য ও রিজিকপ্রাপ্ত হও’। (সহিহ বুখারি-২৮৯৬) তেমনি ধন নিয়ে গর্ব করতে নেই; কারণ ধন ও দারিদ্র্য দুটোই রবের পক্ষ থেকে পরীক্ষা।
ধনীর জন্য আল্লাহর নির্দেশ পালনের পরীক্ষা আর দরিদ্রের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য-স্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি কখনো আপনি দৃষ্টি প্রসারিত করবেন না। আপনার পালনকর্তার দেয়া জীবিকাই উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।’ (সূরা ত্বহা-১৩১)
আমরা গরিবদের সাথে ওঠাবসা করতে চাই না। তাদের সাথে ওঠাবসাকে একধরনের লাঞ্ছনা মনে করি। অথচ আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সা: দরিদ্রদের ভালোবাসতেন। তাদের সাথে চলাফেরা করতেন। এমনকি তাদের সাথে যেন নিজের হাশরটি হয় সে দোয়াও করতেন।
হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে দরিদ্র অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখো, দরিদ্র থাকা অবস্থায় মৃত্যু দিয়ো এবং কিয়ামত দিবসে দরিদ্রদের দলভুক্ত করে হাশর করো।’ (জামে তিরমিজি-২৩৫২)
জান্নাতিদের বেশির ভাগ লোক হবে সম্পদহীন। কারণ সম্পদশালীদের খুব কমসংখ্যক আল্লাহভীরু হয়ে থাকে। এদের বেশির ভাগ হয় উদ্ধত, অহঙ্কারী। পরকালে পুনরুত্থান, হিসাব-নিকাশ, পুলসিরাত ও জান্নাত-জাহান্নাম নিয়ে ভাবার সুযোগ হয় না তাদের। ফলে চূড়ান্ত বিচারে তারা হবে চরমভাবে ব্যর্থ। জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়বে তারা যুগ যুগ ধরে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আমি কি তোমাদের জান্নাতিদের সম্পর্কে অবহিত করব না? (তারা হলো) প্রত্যেক দুর্বল ব্যক্তি এবং এমন ব্যক্তি, যাকে দুর্বল মনে করা হয়। সে যদি আল্লাহর নামে কসম করে, তাহলে তা তিনি পূর্ণ করে দেন। (তিনি আরো বলেন) আমি কি তোমাদের জাহান্নামিদের সম্পর্কে অবহিত করব না? (তারা হলো) প্রত্যেক রূঢ় স্বভাব, কঠিন হৃদয় ও দাম্ভিক ব্যক্তি।’ (সহিহ বুখারি-৪৯১৮)
অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, ‘আমি জান্নাতের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম, যারা জান্নাতে প্রবেশ করেছে তাদের অধিকাংশই গরিব-মিসকিন; অথচ ধনবানরা আটকা পড়ে আছে। অন্য দিকে জাহান্নামিদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমি জাহান্নামের প্রবেশ দ্বারে দাঁড়ালাম এবং দেখতে পেলাম যে, অধিকাংশই নারী।’ (সহিহ বুখারি-৫১৯৬)
মানুষ দরিদ্রদের অবহেলা ও অবজ্ঞা করে অথচ মু’মিনের স্বপ্নের জান্নাত তাদের নিয়ে গর্ব করে। ‘বেহেশত ও দোজখ পরস্পর বিতর্ক ও বাদানুবাদে লিপ্ত হলো। দোজখ বলল, পরাক্রমশালী, স্বৈরাচারী ও অহঙ্কারীরা আমার মধ্যে প্রবেশ করবে। বেহেশত বলল, দুর্বল ও দরিদ্ররা আমার মধ্যে প্রবেশ করবে। মহান আল্লাহ বেহেশতকে বলেন, তুমি হলে আমার রহমত, আমি যাকে ইচ্ছা তোমার মাধ্যমে অনুগ্রহ করব। অতঃপর তিনি দোজখকে বলেন, তুমি হলে আমার শাস্তি। আমি যাকে ইচ্ছা তোমার মাধ্যমে শাস্তি দেবো। তোমাদের দু’জনকেই পূর্ণ করা হবে।’ (আদাবুল মুফরাদ-৫৫৬)
সুতরাং গরিব বলে কাউকে অবহেলা ও ঘৃণা করা যাবে না; বরং তাদের ভালোবাসতে হবে, তাদের সম্মান করতে হবে। লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হামিদিয়া বটগ্রাম, সুয়াগাজী, সদর দক্ষিণ, কুমিল্লা