ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। তারা বলেন, এর মাধ্যমে শুধু ড. মোর্শেদকে অব্যাহতি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কুঠারাঘাত করা হয়েছে। এ জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। ঢাবির মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে আয়োজিত মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষেকেরা এই মন্তব্য করেন।
এসময় সাদা দলের আহ্বায়ক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন মতপ্রকাশ ও মুক্তবুদ্ধির লালন ও চর্চার কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ঐতিহ্য। কিন্তু আমরা হতাশা ও উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সুমহান ঐতিহ্যটি নস্যাৎ হতে চলেছে। ড. মোর্শেদ হাসান খান মার্কেটিং বিভাগের একজন অধ্যাপক। একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তার একটি নিবন্ধের সূত্র ধরে উদ্ভূত প্রতিক্রিয়া ও পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল প্রথমে তার বিরুদ্ধে একটি শান্তির সুপারিশ করেছিল। কিন্তু একটি মহল এটি জানতে পেরে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য এ বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের ব্যবস্থা করে। একটি সংগঠন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিলও করে। একটি পরিস্থিতি তৈরি করে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের মাধ্যমে গত ৯ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেট সভায় ড. মোর্শেদ হাসান খানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশের ৫৬ ধারার ৩ উপধারা এবং ১ ম স্ট্যাটিউটের ৪৫ ধারার ৩ উপধারা অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ, অদক্ষতা এবং চাকুরিবিধি পরিপন্থী কাজের সাথে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে চাকুরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করা যায়। ড. মাের্শেদ উপর্যুক্ত কোনো অভিযােগে অভিযুক্ত নন । আসলে বাংলাদেশের সর্বত্র এখন ভিন্ন মতের মানুষের প্রতি নিপীড়ন, নির্যাতন চলছে। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেউ রেহাই পাচ্ছেন না। ভিন্ন মতের বক্তব্য কেবল পাল্টা বক্তব্য দিয়েই খন্ডন করা উচিত। কিন্তু এই সরকারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সরকার জবাব দেয় হামলা, মামলা, খুন, গুম ও ধর্ষনের মাধ্যমে।
ভিন্ন মত প্রকাশের কারণে এই সরকারের হাত থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মরহুম অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদও রেহাই পান নাই বলেও অভিযোগ করে ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, তার বাসায় হামলা হয়েছে, বৃদ্ধ বয়সে তাকে দাঁড়াতে হয়েছে আদালতে। ভিন্ন মত প্রকাশের কারণে এই সরকারের হাত থেকে রেহাই পান নাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান এ্যাপােলােও। এমন আরাে অনেক উদাহরণ আছে।
ড. ওবায়দুল ইসলাম আরো বলেন, ঢাবি পরিচালিত হয় ১৯৭৩ সালের আদেশে। ওই আদেশের ৫৬ ধারার ২ উপধারা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তা রাজনীতি করার তথা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার রাখেন। একটি দৈনিক পত্রিকায় লিখিত একটি নিবন্ধে কিছু বক্তব্যের কারণে (নিবন্ধটি প্রত্যাহার, দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা সত্ত্বেও) তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদানের সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন ও ন্যাক্কারজনক। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত চাকরিবিধিরও সুস্পষ্ট ব্যত্যয়। এটি স্বাধীন মতপ্রকাশ ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিশ্ববিদ্যালয়ের সুমহান ঐতিহ্যেরও পরিপন্থী। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ঐতিহ্য, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নির্ধারিত আইন ও প্রচলিত বিধি বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শুধু ভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের অনুসারী হওয়ায়, কেবল ভিন্ন মতের প্রতি আক্রোশের কারণেই সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভুতভাবে ড. মোর্শেদকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আমরা এ ধরণের নজিরবিহীন ও ন্যাক্কারজনক সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।
ড. মামুন আহমেদ বলেন, অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে আমরা মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছি। কেবল কিছু মানুষের অযৌক্তিক দাবির কাছে নত হয়ে ড. মোর্শেদকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এমন অমানবিক আচরণ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন করতে পারে তা বিশ্বের কোনো দেশে আছে বলে বিশ্বাস করিনা। শুধু দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এরমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের প্রতি চরম অন্যায় করা হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর কুঠারাঘাত করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সকল শিক্ষককে প্রতিবাদ করতে হবে। শুধু ব্যক্তি মোর্শেদ নয় এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদার প্রতি কুঠারাঘাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দল আয়োজিত মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম। মানববন্ধন পরিচালনা করেন সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ড. মো: হাসানুজ্জামান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, অধ্যাপক মো: আলামিন প্রমুখ। এসময় অন্যানের মধ্যে অধ্যাপক ড. মুজাহিদুল ইসলাম, ড. এহসান মাহবুব যুবায়ের, আবুল কালাম সরকার, মো: শহীদুল ইসলাম, ড. গোলাম রব্বানী, এম এম কাউসার, মো: মিজানুর রহমান, ড. মো: সাইফুল্লাহ, ইসরাফিল প্রামানিক রতন, মো: নুরুল আমিন, মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামসহ বিভিন্ন বিভাগের প্রায় শতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।