বিশ্বের তিনটি বড় রেটিং এজেন্সির মধ্যে একটি হলো মুডিস। বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সি বা ঋণমান নিরূপণকারী সংস্থা মুডিস বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেগেটিভ’ রেটিং দেয়ার জেরে এই সেক্টরের সামনে এখন কঠিন সময় উপস্থিত। অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক বিশ্লেষকরা বলছেন যে, বিশ্বব্যাপী ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের দুর্বল মুদ্রা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং হ্রাসপ্রাপ্ত বৈদেশিক রিজার্ভের দ্বারা ধাক্কা খাওয়া অর্থনীতির সামনে এই অবনমন আরো একটি বড় আঘাত ছিলো। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, মুডিসের রেটিংয়ের জেরে আগামী দিনে আমদানিনির্ভর দক্ষিণ এশীয় দেশটির জন্য আন্তঃসীমান্ত আর্থিক লেনদেন আরও কঠিন এবং ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। কিছু বিদেশী প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে বাংলাদেশী ব্যাংকের জন্য ঋণের সীমা কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স- এর সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মুডিসের সতর্কতা সম্পর্কে নিক্কেই এশিয়াকে বলেছেন- ‘এটি দেয়ালের লিখন, আগে থেকেই লেখা ছিলো। ডলার সংকট সত্ত্বেও আমাদের অনেক ব্যাংক দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এবং একে অপরের প্রতি আস্থার জেরে বিদেশী ব্যাংকগুলির সঙ্গে লেনদেন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে। এখন যেহেতু পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঝুঁকির মুখে পড়েছে তাই আমাদের আন্তঃসীমান্ত লেনদেন উল্লেখযোগ্যভাবে বাধার মুখে পড়তে পারে।’ শ্রীলঙ্কা সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়ার আগে রেটিং এজেন্সিগুলি শ্রীলঙ্কার রেটিং অনুরূপভাবে কমিয়ে দিয়েছিলো। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মুডিসের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি বিপদ সংকেত। কারণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর ইতিমধ্যেই কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির অভিযোগ এবং নন-পারফর্মিং ঋণ দ্বারা জর্জরিত।
ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা নন-পারফর্মিং ঋণের পরিমাণ ছিলো ৮.১৬%। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এই সপ্তাহে, দুবাই-ভিত্তিক মাশরেক ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের হংকং অফিস অন্তত দুটি বাংলাদেশী ব্যাংকের জন্য ক্রেডিট লেটার খোলার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। যদিও মুডিসের রেটিংয়ের আগেই ডলার সংকট নতুন ক্রেডিট ব্যবস্থা এবং আগের অর্থপ্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে- গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসে নতুন ঋণপত্রের সংখ্যা ১৪% কমেছে। সেই ঋণের পেমেন্ট ৯% কমেছে। ব্যাংকাররা বলছেন যে, তাদের কাছে আমদানি বিল নিষ্পত্তি করার জন্য পর্যাপ্ত ডলার নেই। স্থানীয় মিডিয়া রিপোর্ট করেছে যে, প্রায় ২০টি ব্যাংক তাদের বৈদেশিক মুদ্রা খাতে নেগেটিভ ব্যালেন্সের জন্য এই অর্থ প্রদান করতে পারেনি। বাংলাদেশের সরকারি বৈদেশিক রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল, যা নেমে এসেছে ৩২ বিলিয়ন ডলারে। ছয় মাসের ব্যবধানে ডলারের সাপেক্ষে টাকা ৮৪ থেকে ২৭% কমে ১০৭-এ নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সম্প্রতি বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজ দিয়েছে। খারাপ ঋণের ক্রমাগত বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফ এবং সরকারকে এর ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠন করতে বলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক যদিও নিক্কেই এশিয়াকে জানিয়েছেন- ‘পুরো ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের প্রচেষ্টা চলছে। ব্যাংকিং এবং ফিন্যান্স আইনেও কিছু সংশোধন করার কথা ভাবা হচ্ছে।’ বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক অফিসের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসেন দেশের আর্থিক ব্যবস্থা এবং বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের অবনতির এক দশকের হিসেব বর্ণনা করতে গিয়ে দেখেছেন এই সেক্টরটি প্রায়শই হাই-প্রোফাইল কেলেঙ্কারি দ্বারা জর্জরিত। হুসেনের মতে, ‘সমস্যাটি হঠাৎ তৈরি হয়নি, আসলে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে দায় ঝেড়ে ফেলা হয়েছে। সমস্যাগুলিকে লঘু করে দেখা হয়েছে। ‘তিনি দাবি করেছেন যে, অসদাচরণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক এবং বেশ কয়েকটি বড় বেসরকারি ব্যাংকের নিষ্ক্রিয়তা তাদের ওপর আস্থা ভঙ্গের প্রধান কারণ।’ ডিসেম্বরে, মুডিস সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের রেটিং কমিয়েছে, এটি ১৭০ মিলিয়ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অন্যতম বৃহৎ শরিয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১.৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে। সংস্থাটি আরও সাতটি বাংলাদেশী ব্যাংকের রেটিং ডাউনগ্রেডের জন্য পর্যালোচনার অধীনে রেখেছে। অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান জানাচ্ছেন যে, মুডিস এর মতো সংস্থাগুলি মূল্যায়ন করার সময়, তারা সম্ভবত ব্যাংকিং খাতকে ঘিরে দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি এবং বিতর্কগুলিও বিবেচনা করে। তাঁর মতে- ‘এই ডাউনগ্রেডিং স্পষ্টতই আর্থিক খাতকে ব্যয়বহুল করে তুলবে। যদি ব্যাংকগুলি ঋণ নেয়ার উচ্চ খরচ বহন করতে না পারে… তাহলে এই সেক্টরে সমস্যাও বাড়তে পারে।’ ক্রমবর্ধমানভাবে, বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অপ্রীতিকর মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কারণ পাকিস্তানসহ উভয় দেশই গত বছর সহায়তার জন্য আইএমএফের দ্বারে গিয়েছিল। ২০২০ সালের শেষের দিকে, তিনটি প্রধান রেটিং এজেন্সি- এসএন্ডপি গ্লোবাল রেটিং, মুডিস এবং ফিচ রেটিং- অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ ও রাজস্ব সূচকের অভাবের কারণে শ্রীলঙ্কার ক্রেডিট রেটিং কমিয়েছে। এর জেরে শ্রীলঙ্কা পরে গুরুতর অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়েছিল। দাম বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় জিনিসের মারাত্মক ঘাটতি এবং বিশাল বিক্ষোভের জেরে রাষ্ট্রপতি গোটাবাইয়া রাজাপাকসের গদি নড়ে গিয়েছিলো। ‘ডেভেলপমেন্ট মিরাজ’ বইয়ের লেখক জিয়া হাসান নিক্কেই এশিয়াকে বলেছেন যে, ‘শ্রীলঙ্কা ভীষণ খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশ গত বছরের শেষ দিকে কিছু আশার আলো দেখেছে। মুডিস ২০২২ সালের মার্চ মাসে উজ্জ্বল দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলো। কিন্তু এখন, ভাগ্য বিস্ময়করভাবে উল্টোদিকে হাঁটছে। কারণ মুডিস পুরো ব্যাংকিং সিস্টেমের জন্য রেটিং কমিয়ে দিয়েছে। ‘মুডিস বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী ইধ৩ রেটিংও পর্যালোচনা করা শুরু করেছে। হাসান আশঙ্কা করছেন, দেশের সার্বভৌম রেটিংও কমে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি কয়েক দশক পিছিয়ে যাবে। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষকে অনেক অপকর্ম সংশোধন করতে হবে। বৈদেশিক রিজার্ভ, মোট দেশজ উৎপাদন, মুদ্রাস্ফীতি এবং অপারফর্মিং ঋণ নিয়ে সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে। কারণ গ্লোবাল এজেন্সিগুলো সবটাই দেখছে, তাদের ভুল তথ্য দিয়ে বোকা বানানো যাবে না।’ সূত্র : নিক্কেই এশিয়া