তালাক আরবি শব্দ। অর্থ- ত্যাগ করা, বর্জন করা, বিচ্ছেদ ঘটানো, বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করা, বন্ধন মুক্ত করা, ছেড়ে দেয়া, বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদি। পরিভাষায় বিশেষ শব্দের মাধ্যমে বিয়ে বন্ধন ছিন্ন করাকে তালাক বলা হয়।
তালাক সবচেয়ে ঘৃণিত বৈধ কাজ : ইসলাম গড়ার পক্ষে-ভাঙার পক্ষে নয়। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্ককে স্থায়ী রাখার জন্য ইসলাম বিয়ের আগে স্ত্রীকে দেখার ব্যবস্থা রেখেছে। আল্লাহ তায়ালা স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনকে ‘মজবুত অঙ্গীকার’ বলে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহর বাণী- ‘(তোমাদের স্ত্রীরা) তোমাদের কাছ থেকে মজবুত অঙ্গীকার আদায় করেছে।’ (সূরা নিসা-২১) যেহেতু কুরআন মাজিদে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এভাবে মজবুত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, সেহেতু এতে কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটা ও এর মর্যাদাহানি হওয়া উচিত নয়। যে জিনিস এ সম্পর্ককে বিনষ্ট করে তা ইসলামের দৃষ্টিতে ঘৃণিত। মহানবী সা: বলেছেন, ‘বিয়ে করো, তালাক দিও না। কেননা, তালাকের ফলে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।’ (জামে সগির) অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো মু’মিন কোনো মু’মিনা স্ত্রীকে পৃথক করবে না, তার একটি গুণ অপছন্দ হলেও অন্যটি পছন্দ হয়।’ মহানবী সা: অন্যত্র বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত বৈধ কাজ হলো তালাক দেয়া।’ (আবু দাউদ-২১৭৮) রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নারীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (নাসায়ি, আবু দাউদ)। আরো বলেছেন, ‘কোনো মহিলার জন্য এটি বৈধ নয় যে, তার বোনের তালাক চাইবে, যাতে তার সতীত্বের রক্ষাকবচ বৈবাহিক বন্ধনের অবসান ঘটে এবং নিজে তার স্ত্রী হয়ে যায়।’ অপর হাদিসে রয়েছে, ‘যে স্ত্রী বিনা কারণে স্বামীর কাছে তালাক চায়, তার জন্য জান্নাতের ঘ্রাণও হারাম।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে মাজাহ)
তালাক দেয়ার অনুমতি : ইসলাম যেমনিভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার কথা বলেছে, তদ্রুপ তালাক দেয়ার অনুমতিও প্রদান করেছে। তবে তা হতে হবে যৌক্তিক কারণে এবং শরঈ বিধিমোতাবেক। তালাক দেয়ার অর্থ হলো- আল্লাহর একটি নিয়ামতের নাশুকরি করা। বিয়ে আল্লাহর অন্যতম নিয়ামত। আল্লাহর নিয়ামতের নাশুকরি করা হারাম। অতএব, যৌক্তিক কারণ ব্যতীত তালাক দেয়া বৈধ নয়। কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা আত-তালাক নামে একটি সূরা নাজিল করেছেন। এতে বলা হয়েছে- ‘হে নবী! যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চান, তখন তাদেরকে তালাক দেবেন ইদ্দতের প্রতি লক্ষ রেখে এবং ইদ্দত গণনা করুন।’ (সূরা আত-তালাক-১)
তালাক দেয়ার ক্ষমতা স্বামীর : আল্লাহ তায়ালা তালাক দেয়ার ক্ষমতা স্বামীকে দিয়েছেন, স্ত্রীকে নয়। কারণ, পুরুষ নারীর ওপর কর্তৃত্বশীল। নারীরা দ্বীন-দুনিয়া উভয় দিক দিয়ে ক্রটিপূর্ণ। দুনিয়ার দিক দিয়ে ত্রুটি হলো- তাদের দু’জনের সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান। দ্বীনের দিক দিয়ে ত্রুটি হলো- হায়েজ ও নিফাস অবস্থায় তাদের ওপর সালাত ও সিয়াম নেই, তাদের ওপর জিহাদ ফরজ নয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মুসাইয়েব রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, তালাক পুরুষদের জন্য, আর নারীদের জন্য ইদ্দত (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক-৭/২৩৬, হাদিস নং-১২৯৫১) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, তালাক পুরুষদের জন্য, আর নারীদের জন্য ইদ্দত।’ (আল মুজামুল কবির, তিবরানি-৯/৩৩৭, হাদিস নং-৯৬৯৭) আল ফিকহুল ইসলামীতে বলা হয়েছে- ‘যিনি তালাকের ক্ষমতা রাখেন তিনি হলেন স্বামী। স্ত্রী তালাকের মালিক নয়, হ্যাঁ যদি স্বামী মালিক বানায় বা ক্ষমতা দান করে, তবে স্ত্রী তালাক দিতে পারে।’ (ফিকহুল ইসলামী-৭/৩৪৭)। রাদ্দুল মুহতারে রয়েছে- ‘তালাক নারীদের পক্ষ থেকে কার্যকর হয় না।’ (রাদ্দুল মুহতার-৪/৩৬১) দুরুল মুখতারে রয়েছে- ‘তালাক দানের আহল হলো বিবেকবান স্বামী।’ কিতাবুল ফিকহ আলাল মাজাহিবিল আবরা চতুর্থ খ-ে রয়েছে- স্বাধীন পুরুষ তিন তালাকের মালিক।
স্ত্রী কখন স্বামীকে তালাক দিতে পারে : স্বামী যদি স্বীয় স্ত্রীকে তালাক দানের ক্ষমতা অর্পণ করে তবে স্ত্রী স্বামী প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিজেকে তালাক দিতে পারবে। ক্ষমতা দেয়ার বাক্য হলো- ১. ‘তোমার কর্তৃত্ব তোমার হাতে।’ ২. ইচ্ছা করলে তুমি নিজেকে তালাক দিতে পারো- ইত্যাদি। স্ত্রী বলবে আমার ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে আমি নিজেকে এক তালাক/দুই তালাক/তিন তালাক দিলাম। স্বামী ক্ষমতা না দিলে স্ত্রী তালাক দিতে পারবে না। স্বামীর যদি শারীরিক কোনো সমস্যা বা অন্য কোনো ত্রুটি থাকে, তবে শরঈ বিধান মতে স্ত্রী বিয়েবিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে।
তালাক দানের সুন্নাত পদ্ধতি : ইসলামী আইনশাস্ত্র যেমন তালাক দেয়ার অনুমতি দান করেছে, তদ্রুপ তালাক দেয়ার সুন্দর ব্যবস্থাও রেখেছে। তালাক দেয়ার মূল উদ্দেশ্য হতে হবে স্ত্রীকে সংশোধন করা ও ধমক দেয়া। শরিয়তের নির্দেশিকা হলো- স্ত্রীকে সংশোধনের জন্য প্রথমত বিছানা পৃথক করবে। এতে সংশোধিত না হলে হালকা প্রহার করবে, এতেও সংশোধিত না হলে তিনটি এমন পবিত্র অবস্থায় তিনটি তালাক দেবে যাতে সহবাস করেনি। প্রথম পবিত্র অবস্থায় এক তালাক দেয়ার পর যখন দেখা গেল সে সংশোধন হয়নি, তখন দ্বিতীয় পবিত্র অবস্থায় আরেক তালাক দেবে। এতেও যদি সংশোধিত না হয়, তবে তৃতীয় পবিত্র অবস্থায় আরেক তালাক দেবে। তৃতীয় তালাকের পর স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এভাবে তালাক দেয়া সুন্নাত ও সহিহ পদ্ধতি। এর বিপরীত করা বিদয়াত ও নিষিদ্ধ।
একসাথে তিন তালাক দেয়ার বিধান : বর্তমানে সর্বত্র দেখা যায়, স্বামী একসাথে স্বীয় স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে থাকে। একসাথে তিন তালাক দেয়া বিদয়াত। এ ধরনের তালাককে বিদয়াতি তালাক বলা হয়। ইসলামী আইনবিদদের ঐকমত্যে বিদয়াতি তালাক হারাম ও কবিরা গুনাহ। ইমাম নাসায়ি মাহমুদ ইবনে লাবিদ থেকে বর্ণনা করেন- (কিছু সাহাবি বলেন) আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-কে বললাম এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়েছে। এ কথা শোনা মাত্রই রাসূলুল্লাহ সা: রাগান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়ান এবং বলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে জীবিত থাকাবস্থাই সে আল্লাহর কিতাব নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে?’ এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! তবে কি তাকে হত্যা করে ফেলব? রাসূল সা: বললেন, ‘না’। এ হাদিসে বোঝা গেল, একসাথে তিন তালাক দেয়া হারাম ও মারাত্মক গুনাহ। কারণ, রাসূল সা: এরূপ তালাক দাতাকে আল্লাহর কিতাবের সাথে ছিনিমিনি খেলার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন।
ইমামদের অভিমত : চার মাজহাবের ইমাম একসাথে তিন তালাক দেয়াকে সর্বসম্মতভাবে হারাম মনে করেন। তবে তিন তালাক কার্যকর হওয়ার ব্যাপারে তারা একমত পোষণ করেছেন। তাদের যুক্তি হলো, আল্লাহ তায়ালার বাণী- ১. ‘অতঃপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়া হয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোনো স্বামীর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ না হবে, তার জন্য হালাল নয়।’ (সূরা আল বাকারা-২৩০) ২. ‘তোমরা যদি স্ত্রীদেরকে তালাক দাও, তবে কোনো দোষ নেই।’ (সূরা আল বাকারা-২৩৬) ৩. ‘আর যদি মাহর সাব্যস্ত করার পর স্পর্শ করার আগে তালাক দিয়ে দাও, তাহলে যে মাহর সাব্যস্ত করা হয়েছে তার অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে।’ (সূরা আল বাকারা-২৩৭) উপরিউক্ত আয়াতগুলোর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, এক, দুই বা তিন তালাক দেয়া যা-ই হোক না কেন, তা কার্যকর হবে। ৪. ‘তালাক (রাজঈ) হলো দু’বার পর্যন্ত- তারপর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে, না হয় সহৃদয়তার সাথে বর্জন করবে।’ (সূরা আল বাকারা-২২৯) এ আয়াতে প্রতীয়মান হয়, তিন বা দুই তালাক একসাথে বা আলাদা যেভাবেই দেয়া হোক না কেন, তা কার্যকর হবে।
হজরত নাফে রহ: বলেন, যখন হজরত ইবনে উমর রা:-এর কাছে একসাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাক পতিত হওয়া বা না হওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো- তিনি বলেন, ‘যদি তুমি এক বা দুই তালাক দিয়ে থাকো তাহলে ‘রুজু’ তথা স্ত্রীকে বিয়ে করা ছাড়াই ফিরিয়ে আনতে পারবে। যদি তিন তালাক দিয়ে দাও তাহলে স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে, সে তোমাকে ছাড়া অন্য স্বামী গ্রহণ না করা পর্যন্ত।’ (সহিহ বুখারি-২/৭৯২, ২/৮০৩) অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত মুজাহিদ রহ: বলেন, আমি ইবনে আব্বাস রা:-এর পাশে ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি এসে বলেন, ‘তিনি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়েছেন। হজরত ইবনে আব্বাস রা: চুপ করে রইলেন। আমি মনে মনে ভাবছিলাম হয়তো তিনি তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার কথা বলবেন। কিছুক্ষণ পর ইবনে আব্বাস রা: বলেন, তোমাদের অনেকে (একসাথে তিন তালাক দিয়ে) নির্বোধের মতো কাজ করো, তারপর ইবন আব্বাস! ইবনে আব্বাস! বলে চিৎকার করতে থাকো। শুনে রাখো, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য পথকে খুলে দেন। তুমি তো স্বীয় রবের (একসাথে তিন তালাক দিয়ে) নাফরমানি করেছ। এ কারণে তোমার স্ত্রী তোমার থেকে পৃথক হয়ে গেছে।’ (সুনানে আবু দাউদ-১/২৯৯, হাদিস নং-২১৯৯, সুনানে বায়হাকি কুবরা, হাদিস নং-১৪৭২০, সুনানে দারা কুতনি, হাদিস নং-১৪৩)
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক রা:-এর সময় সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্যে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে, একসাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে। অতএব ঈমানদারদের উচিত হবে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার যৌক্তিক কারণ দেখা দিলে সুন্নাত পদ্ধতি অনুসরণ করা, হারাম পন্থা অবলম্বন না করা। লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী