রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০২:০৪ অপরাহ্ন

ভূগর্ভস্থ পানিতে ভারী ধাতু ক্যান্সারের ঝুঁকি :প্রতিকারে দ্রুত ব্যবস্থা নিন

খবরপত্র ডেস্ক :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের দুই শিক্ষকের করা রিভিউ গবেষণায় দেশের অন্তত আট জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতে লেড, ক্রোমিয়াম, নিকেলসহ বেশকিছু ভারী ধাতুর অস্তিত্ব মিলেছে। একই সঙ্গে তারা আশঙ্কা করছেন দেশের ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমেই আরো দূষিত হয়ে পড়বে। তাদের গবেষণায় উঠে আসে ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুরসহ আট জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতে ক্ষতিকর ভারী ধাতব পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য সহনশীল মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। ভূগর্ভস্থ খাবার পানির সঙ্গে নলকূপে উঠে আসছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও দূষিত পদার্থ, যা পান করায় মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত অগভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা হয়। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে এখন বছরের একটা সময়ে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ। ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের দূষক পদার্থ চুইয়ে মাটির নিচে চলে গিয়ে পানিতে মিশছে। তা নলকূপের মাধ্যমে উঠে আসে। সে পানি মানব শরীরে প্রবেশ করে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস করে। ফলে নতুন রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে কৃষি উৎপাদনে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানিতে এসব মিশে দূষিত করছে নদী, নালা, খাল, বিল, সমুদ্রের পানি; এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিও। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার দূষণের অন্যতম কারণ। মাটির বিশেষ যে স্তরে আর্সনোপাইরাইট পদার্থ আছে; ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনে তা পানিতে মিশে যাচ্ছে। প্রতিদিন কৃষিকাজ থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহারে যে কোটি কোটি লিটার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, ফলে ভূগর্ভে সাময়িক শূন্যতার সৃষ্টি হয়ে ভারী ধাতু মিশে দূষণ ঘটাচ্ছে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। লোহার উচ্চমাত্রা ও ম্যাঙ্গানিজের অত্যধিক আধিক্য পানির গুণ নষ্ট করছে। মলমূত্রের কলিফর্মও একটা বড় সমস্যা, বিশেষ করে অগভীর ভূগর্ভস্থ পানির জন্য। সেচে ব্যাপকভাবে পানি উত্তোলনে শুকনা মৌসুমে ভূ-জলপৃষ্ঠ নিচে নেমে যাওয়া একটি বড় সমস্যা। কলকারখানা ও পৌর বর্জ্য যত্রতত্র ফেলাতেও ঢাকার মতো বড় বড় শহরে ভূগর্ভস্থ পানির মান ক্রমেই অধিক মাত্রায় নষ্ট হচ্ছে। পানি প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের কারণে আবাসিক এলাকা, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা, পয়োনিষ্কাশন কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। তেলের ট্যাংকারের মতো উৎস থেকেও প্রচুর ধাতু, তৈলাক্ত পদার্থ, সিসা, পারদ, দস্তা ও ক্রোমিয়ামের মতো বিষাক্ত দ্রব্য পানিতে প্রতিনিয়ত পতিত হচ্ছে।
সত্তরের দশকের আগে দেশের মানুষের কাছে সুপেয় পানির প্রধান উৎস ছিল ভূপৃষ্ঠ বা পুকুর, নদী-খাল, বৃষ্টি আর জমিয়ে রাখা পানি। সত্তরের দশকের শুরুতে কৃষিকাজের জন্য দেশে প্রথম ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয়। আশির দশকে তা ব্যাপকতা পায়। সেই যে শুরু এরপর আর থামানো যায়নি। গত চার দশকে দেশে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে মারাত্মকভাবে। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচ, শিল্পপণ্য উৎপাদন, এমনকি দৈনন্দিন কাজেও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ। যদিও নিরাপদ নয় ভূগর্ভস্থ পানিও। বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারী ধাতুর অস্তিত্ব মিলেছে দেশের অন্তত আট জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতে। পানিতে মিশে থাকা এসব ধাতু মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ব্যাপক পানিদূষণের কারণে ভূ-উপরিস্থ পানির অবস্থা শোচনীয়। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। তাই এখনই আমাদের উচিত ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষা করার জন্য ব্যাপক পানিদূষণ বন্ধ করা।
পানিতে মিশে থাকা কেমিক্যাল, ভারী ধাতু, মরিচা, সিসা, ক্যাডমিয়ামসহ বিভিন্ন দূষিত পদার্থ শুধু সিদ্ধ করার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়। পানিতে কোন কোন পদার্থ মিশে আছে, আগে তা শনাক্ত করতে হবে। এরপর পৃথকভাবে এগুলো পরিশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। জীবাণুভেদে পানি বিশুদ্ধকরণে পৃথক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হয়। ব্যাকটেরিয়াও অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংসের জন্য পানি সঠিক মাত্রায় ৩০-৪০ মিনিট ফোটাতে হয়। কিন্তু সঠিক তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে পানি ফোটানো সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ঝুঁকি থেকে যায়। দেখা যায়, ফোটানোর পর পানি থেকে ব্যাকটেরিয়া দূর হলেও ক্লোরিনের পরিমাণ কমে না। এমনকি পাত্রে রাখা, ফোটানো পানিতে আবার ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে। তাই ফোটানো ছাড়াও বিভিন্নভাবে পানি বিশুদ্ধ করা যায়, যা মানুষের জানা উচিত।
পানি দূষণের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে নদনদী, খালবিল, সমুদ্র ইত্যাদি। তাই ভূ-উপরিস্থ এসব পানিকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নদনদীতে সব ধরনের কঠিন, গৃহস্থালি ও স্যানিটারি বর্জ্যের মিশ্রণ রোধ করা অত্যাবশ্যক। নদী তীরে শিল্প-কারখানা নির্মাণ বন্ধ, সেই সঙ্গে দেশের বড় বড় শিল্প জোনের শিল্প-কারখানার রাসায়নিক ও ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা এবং এর নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে। তাই প্রতিটি শিল্প-কারখানার সঙ্গে শোধনাগার বা অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত পানি যাতে খাল-বিল-নদীতে মিশতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতসহ পানি দূষণকারীদের আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নদনদী দূষণ রোধে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করে তাদের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পানির অপচয় রোধ করতে হবে, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে ভূগর্ভস্থ পানি সীমিত। বিশেষ করে, কৃষি ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে যাতে ব্যবহার করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে আমরা পানির চাহিদা মেটাতে এবং ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ রোধ করতে পারব।
মানব জীবনের প্রয়োজনে গৃহস্থালি, সেচ এবং শিল্প-কলকারখানায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক উত্তোলন হচ্ছে। ফলে কল্পনাতীতভাবে পরিবেশ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে মাটির নিচের স্তর থেকে অতিরিক্ত পানি তুলে নেয়ার ফলে মাটির নিচে ফাঁকা জায়গায় আর্সেনিক বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ধাতব যৌগ তৈরি করে পানিকে দূষিত করে। আর্সেনিক ছাড়াও লোহার উচ্চমাত্রা ও ম্যাঙ্গানিজের অত্যধিক আধিক্য পানির গুণকে নষ্ট করছে। দূষণের ফলে পানিতে মিশে থাকা কেমিক্যাল, ভারী ধাতু, মরিচা, সিসা, ক্যাডমিয়ামসহ বিভিন্ন দূষিত পদার্থ শুধু সিদ্ধ করার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়। তা সরাসরি শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করছে, যা উদ্বেগজনক। এখনই পদক্ষেপ না নেয়া হলে স্বাস্থ্য খাতে জনগণ ও সরকারের ব্যয় আরো বাড়বে।
আমরা মনে করি,ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে হলে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার সর্বোচ্চ হারে বাড়াতে হবে। বিশেষ করে পানিদূষণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রোধ করার জন্য ব্যাপক নীতিমালা গ্রহণ করার পাশাপাশি নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদি ব্যাপকভাবে খনন করতে হবে। যাতে ভূ-উপরিস্থ পানির মজুদ বাড়ে। নদনদীতে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতি বছর সব নদনদীর ড্রেজিং করতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যয়সাপেক্ষ হলেও নদীর পানিকে পরিশোধন করে সুপেয় পানিতে রূপান্তরিত করার পরিমাণ বাড়াতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব প্রতিটি ওয়াসাকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। কোনো প্রকার প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক জলাশয় যেমন হ্রদ, পুকুর, দিঘি, ডোবা ইত্যাদি ভরাট করা যাবে না। প্রয়োজনে আইন করে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে এসব রক্ষা করতে হবে। গৃহস্থালি ও শিল্প-কারখানায় বেশি বেশি ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। দেশে ব্যাপক প্রচারণা করে বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সর্বোচ্চ ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তাই নয়, সরকারি উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সরাসরি ভূমির অভ্যন্তরে প্রবেশ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উন্নতি হয়। যত্রতত্র যেখানে-সেখানে গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ করে এর জন্য একটি নীতিমালা করতে হবে। আশা করি, সরকারের যথাযথ কতৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সাতে বিবেচনা করবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com