আল্লাহর দিকে ফিরে আসুন আখিরাতের মতো দুনিয়ার জীবনও সমৃদ্ধশালী হবে। আল-কুরআনের বহু জায়গায় আল্লাহ তায়ালার এ ওয়াদা রয়েছে। অনেকের ধারণা, যারা আল্লাহভীতি, সততা, সাধুতা ও দায়িত্বনুভূতির পথ অবলম্বন করে তারা আখিরাতের জীবনে সফল হলেও হতে পারে কিন্তু তাদের দুনিয়ার জীবন একেবারেই বরবাদ হয়ে যায়। সত্যিকার অর্থে এ মন্ত্র কেবল শয়তান দুনিয়ার মোহে মুগ্ধ অজ্ঞ-নির্বোধের কানে ফুঁকে দেয়। এ সঙ্গে তাকে এ প্ররোচনাও দেয় যে, এ ধরনের আল্লাহভীরু ও সৎলোকদের জীবনে দারিদ্র্য, অভাব ও অনাহার ছাড়া আর কিছুই নেই। আল্লাহ তায়ালা এ ধারণার প্রতিবাদ করে বলেন- ‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো, তাহলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবনসামগ্রী দেবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন। তবে যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি তোমাদের ব্যাপারে একটি অতীব ভয়াবহ দিনের আজাবের ভয় করছি’ (সূরা হুদ-৩)।
অর্থাৎ এ সঠিক পথ অবলম্বন করলে তোমাদের শুধু আখিরাতেই নয়, দুনিয়াও সমৃদ্ধ হবে। আল-কুরআনের দৃষ্টিতে দুনিয়ার জীবনসামগ্রী দুই প্রকারের। এক প্রকারের জীবনসামগ্রী আল্লাহবিমুখ লোকদেরকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করার জন্য দেয়া হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে তারা নিজেদেরকে দুনিয়া পূজা ও আল্লাহ বিস্মৃতির মধ্যে আরো বেশি করে হারিয়ে যায়। আপাত দৃষ্টিতে এটি নিয়ামত ঠিকই কিন্তু গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যাবে এটি আল্লাহর লানত ও আজাবের পটভূমিই রচনা করে। আল কুরআনে এটি প্রতারণার সামগ্রী নামেও একে উল্লেখ করে। আর দ্বিতীয় প্রকারের সামগ্রী মানুষকে আরো বেশি সচ্ছল, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে তাকে তার আল্লাহর আরো কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত করে। এভাবে সে আল্লাহর, তাঁর বান্দাদের এবং নিজের অধিকার আরো বেশি করে আদায় করতে সক্ষম হয়। আল্লাহর দেয়া উপকরণাদির সাহায্যে শক্তি স য় করে সে দুনিয়ায় ভালো, ন্যায় ও কল্যাণের উন্নয়ন এবং মন্দ, বিপর্যয় ও অকল্যাণের পথ রোধ করার জন্য এর বেশি প্রভাবশালী ও কার্যকর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এ হচ্ছে কুরআনের পরিভাষায় উত্তম জীবনসামগ্রী। অর্থাৎ এমন উন্নত পর্যায়ের জীবনসামগ্রী যা নিছক দুনিয়ার আয়েশ-আরামের মধ্যে খতম হয়ে যায় না; বরং পরিণামে আখিরাতেরও শান্তির উপকরণে পরিণত হয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘পুরুষ বা নারী যে-ই সৎকাজ করবে, সে যদি মুমিন হয়, তাহলে তাকে আমি দুনিয়ায় পবিত্র পরিচ্ছন্ন জীবন দান করব এবং (আখিরাতে) তাদের প্রতিদান দেবো তাদের সর্বোত্তম কাজ অনুসারে’ (সূরা আন নাহল-৯৭)। এ আয়াতেও মুমিন ও কাফের উভয় দলের এমন সব সঙ্কীর্ণচেতা ও বেখবর লোকদের ভুল ধারণা দূর করা হয়েছে, যারা মনে করে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতার পথ অবলম্বন করলে মানুষের পরকালে সাফল্য অর্জিত হলেও তার পার্থিব জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের জবাবে আল্লাহ বলছেন- ‘তোমাদের এ ধারণা ভুল। এ সঠিক পথ অবলম্বন করলে শুধু পরকালীন জীবনই সুগঠিত হয় না, দুনিয়াবি জীবনও সুখী সমৃদ্ধশালী হয়। যারা প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ও সৎ তাদের পার্থিব জীবন ও বেঈমান ও অসৎকর্মশীল লোকদের তুলনায় সুস্পষ্টভাবে ভালো ও উন্নত হয়। নিজেদের নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের কারণে তারা যে প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা লাভ করে তা অন্যরা লাভ করতে পারে না। যেসব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও উত্তম সাফল্য তারা লাভ করে থাকেন তাও অন্যেরা লাভ করতে পারে না। কারণ অন্যদের প্রতিটি সাফল্য হয় নোংরা ও ঘৃণিত পদ্ধতি অবলম্বনের ফসল। সৎ লোকেরা ছেঁড়া কাঁথায় শয়ন করেও যে মানসিক প্রশান্তি ও চিন্তার স্থৈর্য লাভ করেন তার সামান্যতম অংশও প্রাসাদবাসী বেঈমান দুষ্কৃতিকারী লাভ করতে পারে না।
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি এই যে- ‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো, তাহলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবনসামগ্রী দেবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন।’ অর্থাৎ- দুনিয়ায় তোমাদের অবস্থান করার জন্য যে সময় নির্ধারিত রয়েছে সে সময় পর্যন্ত তিনি তোমাদের খারাপভাবে নয় ভালোভাবেই রাখবেন। তাঁর নিয়ামতসমূহ তোমাদের ওপর বর্ষিত হবে। তাঁর বরকত ও প্রাচুর্য লাভে তোমরা ধন্য হবে। তোমরা সচ্ছল ও সুখী-সমৃদ্ধ থাকবে। তোমাদের জীবন শান্তিময় ও নিরাপদ হবে। তোমরা লাঞ্ছনা, হীনতা ও দীনতার সাথে নয়; বরং সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করবে।
যে ব্যক্তি চরিত্রগুণে ও নেক আমলে যত বেশি এগিয়ে যাবে আল্লাহ তাকে ততই বড় মর্যাদা দান করবেন। আল্লাহর দরবারে কারোর কৃতিত্ব ও সৎকাজকে নষ্ট করা হয় না। তাঁর কাছে যেমন অসৎ কাজ ও অসৎবৃত্তির কোনো মর্যাদা নেই তেমনি সৎকাজ ও সৎবৃত্তিরও কোনো অমর্যাদা হয় না। এটি মহান আল্লাহর রাজ্যের রীতি নয়। যে ব্যক্তি নিজের চরিত্র ও কর্মকা-ের মাধ্যমে নিজেকে যেরূপ মর্যাদার অধিকারী প্রমাণ করবে তাকে আল্লাহ সে মর্যাদা অবশ্যই দেবেন। তাদের মর্যাদা তাদের সর্বোত্তম কর্মের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত হবে। অন্য কথায় যে ব্যক্তি দুনিয়ায় ছোট বড় সব রকমের সৎ কাজ করে থাকবে তাকে তার সবচেয়ে বড় সৎ কাজের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চতর মর্যাদা দান করা হবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘জনপদের লোকেরা যদি ঈমান আনত এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতসমূহের দুয়ার খুলে দিতাম’ (সূরা আরাফ-৯৬)। আসমান ও জমিনের সব বরকত খুলে দেবেন বলতে সব রকম কল্যাণ সব দিক থেকে খুলে দেয়া। তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক সময়ে আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হতো, আর জমিন থেকে যেকোনো বস্তু তাদের মন মতো উৎপাদিত হতো এবং সেসব বস্তু দিয়ে তাদের লাভবান হওয়া এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে দেয়া হতো। তাতে তাদেরকে এমন কোনো চিন্তা-ভাবনা কিংবা টানাপড়েনের সম্মুখীন হতে হতো না।
প্রথমেই বলেছিলাম আল কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহ তায়ালা এ ওয়াদা করেছেন। মাত্র কয়েকটি আয়াত এখানে পেশ করা হলো। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষাবেন। সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন আর নদী-নালা প্রবাহিত করে দেবেন’ (সূরা নূহ : ১১-১২)। যারা আল্লাহদ্রোহিতার আচরণ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে এবং ঈমান, তাকওয়া ও আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার পথ অনুসরণ করে তাহলে তা শুধু আখিরাতের জন্যই কল্যাণকর হয় না, দুনিয়াতেও তার ওপর আল্লাহর অশেষ নিয়ামত বর্ষিত হতে থাকে। হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে- রাসূলুল্লাহ সা: কুরাইশদের বললেন, ‘একটি কথা যদি তোমরা মেনে নাও তাহলে আরব ও আজমের শাসনদ-ের অধিকারী হয়ে যাবে।’ লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট