মাদক মুক্ত দেশ গড়তে হবে। তা না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে মেধাহীন। তবে দুঃ”খজনক হলেও সত্য দেশে মাদকের ব্যবহার বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। আসক্তদের বেশির ভাগ তরুণ, যারা ভবিষ্যতে জাতির অগ্রগতির হাল ধরবে। তরুণ সমাজের মধ্যে মাদকের বিস্তার এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে, যা গোটা জাতির জন্য রীতিমতো উদ্বেগজনক। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ২০১৮ সালে ছিল প্রায় ৩৬ লাখ। আর এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে কর্মরত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ধারণা করে, দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৭০ লক্ষাধিক। এর অর্থ হলো- মাত্র দু’-তিন বছরের মধ্যে মাদকাসক্ত বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এ থেকে ধারণা করা যায়, মাদকদ্রব্য কতটা ভয়াল থাবা বিস্তার করেছে।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমের খবর থেকে যতটা জানা যায়, তাতে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য আসে প্রধানত প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে। এক সময় ভারত থেকে আসত ফেনসিডিলের মতো নেশার ওষুধ। আশির দশকে তা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বাংলাদেশে। এরপর নানা উৎস থেকে আসতে থাকে হেরোইন। এখন মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা। সম্প্রতি ইয়াবার পাশাপাশি যোগ হয়েছে আইস নামে পরিচিত নতুন মাদকদ্রব্য যা আরো বেশি ভয়ঙ্কর। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরের মাদকসেবীরা আইসে ঝুঁঁকছে। এটি সেবনে ওজন হারানো, কিডনি ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা এবং বিষণœতা, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু এসব সমস্যার পাশাপাশি এর মারাত্মক সামাজিক ক্ষতির দিক আছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি দিনে দিনে কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলে। ক্রমে সে অসামাজিক আচরণ করতে শুরু করে। তার স্বাভাবিক জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। এটি শুধু সংশ্লিষ্ট যুবকের একার ক্ষতি নয়; একটি পরিবারের তরুণ সদস্যটি মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে ঘরের শান্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়, এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর। মাদকাসক্তি একটি জাতির জন্যও অভিশাপ হয়ে ওঠে যখন যুবসমাজ মাদকের ঘোরে ডুবে যেতে থাকে। ফলে পাচার পুরোপুরি বন্ধ করা দেশ ও জাতির জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া দরকার। কিন্তু সেটি কখনো সম্ভব হয় না।
জাতিসঙ্ঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থার (ইউএনওডিসি) হিসাবে, বিশ^জুড়ে বাজারে যত মাদক ঢোকে, তার মাত্র ১০ শতাংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে ২০২২ সালে আইস উদ্ধার হয় ১১৩ কেজির বেশি। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে উদ্ধার হয়েছে ৬৬ কেজি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, কী বিপুল মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে ঢুকছে। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত দেড় বছরে বেশির ভাগ বড় চালান ধরা পড়েছে টেকনাফ সীমান্তে। বান্দরবান সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ি পথেও আইস আসছে। নৌপথ ও দুর্গম পাহাড়ের অন্তত ১৫টি রুটে মিয়ানমার থেকে আইস আসছে দেশে। মাদক আসা বন্ধ করতে গত এক দশক ধরে হিমশিম অবস্থা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর। কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে মোটেই সাহায্য করছে না মিয়ানমার।
দেশে বিভিন্ন সময়ে মাদকবিরোধী অভিযান চালায় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার অভাবে মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেও তা বন্ধের নজির রয়েছে। মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্ব নতি স্বীকার করে প্রভাবশালীদের চাপের কাছে। আর কে না জানে, মাদক ব্যবসার গডফাদারের তালিকায় আমাদের কিছু জনপ্রতিনিধির নামও জড়িত! আছে সমাজের নানা স্তরের প্রভাবশালীদের নামও। কিন্তু এ অবস্থা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। দেশের স্বার্থে মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং তা অনতিবিলম্বে। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তৎপরতা বাড়াতে। পরিবার থেকে সরকার সবাই যথাযথ ভূমিকা পালন করলেই মাদক মুক্ত দেশ গড়ার সংগ্রাম সফল হবে।