হজ মূলত একটি প্রেমময় সফর। এটি আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক উন্নয়নের অভিযাত্রা। পার্থিব জীবনে স্রষ্টাকে দেখা, তার সান্নিধ্য লাভ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য তাদের হৃদয়ের আকুলতা, প্রেম-উচ্ছ্বাসের অভিব্যক্তি প্রকাশের প্রতীকী ব্যবস্থা এই হজ। এর প্রতিটি বিধানে প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের মধ্যকার অকৃত্রিম সম্পর্কের পরিচয় ফুটে ওঠে। স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ পায়। হজের সময় এলে দূর আজম থেকে হজে যেতে না পারা মু’মিনের হৃদয়ে অতিশয় আকুলতা ছেয়ে যায়। বিরহের ঢেউ ওঠে প্রার্থনায়। প্রায়ই চোখের কোণে জমে অশ্রুজল। মন চলে যায় সুদূরে। মরু মক্কায়। মসজিদে হারামে। স্বপ্নের শহরে। মদিনায়। কালো গিলাফে আবৃত বাইতুল্লাহ আর সবুজ গম্বুজের মসজিদে নববীতে। মু’মিনের হৃদয়ে লালিত দু’টি স্বপ্ন। লাখো কোটি চোখের সীমাহীন তৃষ্ণা দু’টি স্বপ্নকে ঘিরেই। অনবরত সেই স্বপ্ন মু’মিন-হৃদয়কে আলোড়িত করে। কল্পনার অথৈ সাগরে জোয়ার আনে। ভাবে অনুভবে আনে পবিত্র পরশ। হজ ইসলামের প স্তম্ভের একটি। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর অর্পিত গুরুত্বপূর্ণ বিধান। মু’মিন মাত্রই সর্বদা মনের ভেতর দৃঢ় সঙ্কল্প থাকে জীবনে একটিবার আল্লাহর ঘর জিয়ারতের। নবীজী সা:-এর রওজা পাকে উপস্থিত হয়ে সালাম পৌঁছানোর। আকুল মন সর্বদা ব্যাকুল থাকে হাজরে আসওয়াদ চুমু খেয়ে গুনাহ মাফ করার। হৃদয় উজাড় করে গভীর প্রণয়ে ডুব দেয়ার পবিত্র সময় হজ। হজ মহান আল্লাহ তায়ালার এমন একটি অনুপম বিধান, যা পালন করতে গিয়ে মানুষ ভুলে যায় পরস্পর সব ভেদাভেদ। মানুষে মানুষে সৃষ্টি হয় ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী ও ভালোবাসার অপূর্ব মেলবন্ধন। দূর হয়ে যায় মনের সব কলুষ, হিংসা, বিদ্বেষ, গর্ব, অহঙ্কার, লোভ ও পাপ-পঙ্কিলতা। পরিণত হয় শুভ্র-সফেদ মানবে।
কাবার চার পাশের নূর ফোয়ারায় অবগাহন করতে প্রতিটি মু’মিন-হৃদয়ের তামান্না ব্যাকুল। কেন সেই অতুলস্পর্শী গহিন হৃদয়ের আকুলতা? কিভাবে তৈরি হলো সবার হৃদয়-মিনারে প্রত্যাশার ব্যাকুল ব্যঞ্জনা?
পবিত্র কুরআনের বর্ণনায় উপলব্ধি করা যায়, ঐশী নির্দেশনায় ইবরাহিম আ: কাবাঘর নির্মাণের পর আল্লাহর কাছে আরজি পেশ করলেন ‘হে আল্লাহ! এই নির্জন মরুপ্রান্তরে কে এই ঘর তাওয়াফ করতে আসবে?’ তখন আল্লাহ তায়ালা আদেশ করলেন, ‘তুমি মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছতে পারে এবং তার দেয়া চতুষ্পদ জন্তুগুলো জবাই করার সময় নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’ (সূরা হজ : ২৭-২৮)
হজ মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্বের অনুপম নিদর্শন। সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ঐক্যের সেতুবন্ধ। রাসূলে করিম সা:-এর হাদিসে মু’মিনদের এক দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। হজের ইবাদতের মধ্যেই এক দেহ এক প্রাণের চোখ শীতল করা সেই অভাবনীয় দৃশ্য ফুটে ওঠে আপন মহিমায়। হজের ইহরাম, তালবিয়া-লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক থেকে শুরু করে সর্বশেষ বিদায়ী তাওয়াফ পর্যন্ত একই ব্যঞ্জনা ধ্বনিত হয়। পবিত্র কাবার তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ায় সায়ি, আরাফায় অবস্থান, মিনায় কঙ্কর নিক্ষেপ ও তাওয়াফে জিয়ারতসহ হজের বিধানাবলির মধ্যে ঐক্যের সুবাস ছড়িয়ে আছে।
হজ পরকালীন সফরের একটি মহড়া। হজের সময় হাজিরা যেমন সাদা কাপড়ে আবৃত হয়, মৃত্যুর পরও বান্দা সাদা কাপড়ে আবৃত হয়। আরাফায় সমবেত হওয়ার মতো কবরের জীবনের পর হাশরের ময়দানে সবাই সমবেত হবে ভেদাভেদহীনভাবে। হজ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ইহরামের কাপড়ের মতো স্বচ্ছ-সাদা হৃদয় নিয়েই আল্লাহর দরবারে যেতে হবে। ইহরাম অবস্থায় সব বিধিনিষেধ মেনে চলা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে, মু’মিনের জীবন বল্গাহীন নয়; বরং আল্লাহর রশিতে বাঁধা। আল্লাহ যে দিকে টান দেন, সে সে দিকেই যেতে প্রস্তুত। হজ মানবমনে সৃষ্টি করে হৃদয়ছোঁয়া ভালোবাসা। ওহি অবতরণের সোনালি জায়গাগুলোর দর্শন উদ্দীপনা তৈরি করে। এর চেয়েও বড় কথা হলো, শরিয়ত হজের এত বিশাল বিনিময় ও সওয়াব রেখেছে যে, হজ একটি প্রেমময় সফরে রূপ নেয়। একজন হাজীর প্রত্যেকটি আমল আল্লাহর প্রেমসাগরে ডুবে যাওয়ার মতো। কারণ হজ একই সাথে আত্মিক, অর্থনৈতিক ও শারীরিক ইবাদত। আর কোনো ইবাদতে নেই এ অনুপম বৈশিষ্ট্য। লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া, আরজাবাদ