ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ রোগে আক্রান্ত সাধারণ মানুষের যথাযথ চিকিৎসায় ২০০২ সালে নীলফামারীর সৈয়দপুরে যাত্রা শুরু করে বিশ্বের প্রথম ফাইলেরিয়া হাসপাতাল। কিন্তু বর্তমানে ৯ মাস ধরে বন্ধ গোদ রোগের চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতালটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। বিল বাকি থাকায় বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগও। এছাড়া পরিচালনা কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বসহ নানা সমস্যায় ধুঁকে ধুঁকে চলছিল হাসপাতালটি। এবার হাসপাতালটির পুরো কার্যক্রমই বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত ৮ মে দুপুরে হাসপাতালটি বন্ধ ঘোষণা করেন হাসপাতালের অস্থায়ী আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মান্না চক্রবর্তী। এদিকে, হাসপাতালটি এক মাস ধরে বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৭০০ গোদ রোগী। প্রতিদিন চিকিৎসাসেবা নিতে আসা ৮ থেকে ১০ জন রোগী চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সকল সমস্যা সমাধান করে দ্রুত হাসপাতালটি চালুর চেষ্টা চলছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালটি চালু করে রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হবে। সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালটির বহুতল দুটি ভবনে তালা ঝুলছে। ভবন দুটিতে রয়েছে জরুরি বিভাগ, ক্যান্টিন, ৩০ শয্যা বিশিষ্ট ওয়ার্ড ও প্রশাসনিক ভবন। পাশে থাকা ওয়াক্তিয়া নামাজ ঘরের চিত্র একই। টিনের চালায় চিকিৎসকদের রোগী দেখার জন্য তৈরি করা চেম্বারের চেয়ার-টেবিলে জমেছে ধুলাবালি। এছাড়া রোগী, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদচারণা না থাকায় হাসপাতাল চত্বরজুড়ে গজিয়েছে সবুজ ঘাস। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, উত্তরের জেলা নীলফামারীসহ ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় ফাইলেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এ রোগের চিকিৎসার জন্য ২০০২ সালে জাপান সরকারের অর্থায়নে সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের ধলাগাছ এলাকায় ৭৫ শতক জায়গায় যাত্রা শুরু করে ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইম্যুনোলজি অব বাংলাদেশ (আইএসিআইবি) হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ছিল। হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও প্রকল্প পরিচালক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন ওই সময় স্থানীয়ভাবে ১৮ জন দেশি-বিদেশি চিকিৎসককে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। জাপান, কানাডা ও বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় দুটি বহুতল ভবন নিয়ে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়। জাপান ও অন্যান্য দেশ থেকেও গবেষণা কর্মীরা আসেন এখানে। তবে ২০১২ সালে হাসপাতালটিকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে সংকট সৃষ্টি হয়। পরিচালনা কমিটির দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়ে সেবা কার্যক্রম। মুখ ফিরিয়ে নেয় দাতা সংস্থাগুলো। এরপর থেকে ধুঁকে ধুঁকে চলছিল হাসপাতালটি। সূত্রটি আরও জানায়, ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে টোকেন মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার প্রত্যয়ে সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ল্যাব নামে নতুন করে যাত্রা শুরু করে হাসপাতালটি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা লেপরার সঙ্গে বাংলাদেশ প্যারামেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক সব ধরনের সহযোগিতা করবে লেপরা বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্যারামেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রাকিবুল ইসলাম তুহিন পরিচালকের দায়িত্ব নেন। এরপর বিভিন্ন জেলা থেকে নতুন করে প্রায় ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রত্যেকের কাছে ফেরতযোগ্য জামানত হিসেবে নেওয়া হয় ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাকরিতে যোগদানের সময় তাদের কাছ থেকে ফেরতযোগ্য জামানতের কথা বলে ৫০ লাখ টাকা নিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক। কিন্তু ৯ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না তারা। বেতনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অনেকেই বাড়ি চলে গেছেন। এছাড়া বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে নেসকো কর্তৃপক্ষ। ফলে হাসপাতালটি তিন মাস ধরে বিদ্যুৎবিহীন। কিছু দিন জেনারেটর দিয়ে চিকিৎসাসেবা দিলেও সেটিও বন্ধ হয়ে গেলে চিকিৎসকরা হাসপাতালে যাওয়া-আসা বন্ধ করে দেন। এছাড়া পরিচালনা কমিটির সদস্যরাও এখন আর হাসপাতালে যান না। গত ৭ মে বকেয়া বেতনের দাবিতে প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে অবরোধ করেন হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীরা। এরপর ১৫ মে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে জরুরি সভা আহ্বান করেন হাসপাতালটির পরিচালক রাকিবুল ইসলাম তুহিন। সভায় সকল সমস্যা সমাধান করে হাসপাতালটি এক সপ্তাহের মধ্যে চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত চালু না হওয়ায় চিন্তিত তারা। নেসকো সৈয়দপুর বিদ্যুৎ বিতরণ ও বিক্রয় কেন্দ্র সূত্র জানায়, ১ লাখ ৯০ হাজার ২৪৮ টাকা বিল বকেয়া থাকায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালটির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নেসকো। এরপর থেকে সংযোগ বা বিল পরিশোধের জন্য যোগাযোগ করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের নিরাপত্তাপ্রহরী মারুফ ইসলাম বলেন, প্রায় ২০ দিন ধরে আমি একাই দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করছি। তিন মাস ধরে হাসপাতালে বিদ্যুৎ নেই। এছাড়া আমাদের বেতন হয় না অনেক দিন ধরে। আর অনেকের নিয়োগপত্র নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। এজন্য মিটিং করে হাসপাতাল বন্ধ করা হয়েছে। পরিচালক আমাদের বলছিলেন এক সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালটি খুলবে। কিন্তু ২০ দিন পার হয়ে গেলেও হাসপাতালটি চালু হয়নি। এখন বলতেছে আর এক সপ্তাহের মধ্যে খুলে যাবে। অনেক দূরদূরান্ত থেকে রোগী এসে ফিরে যাচ্ছে। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জন রোগী এসে ঘুরে যাচ্ছেন। রোগীদের সু-চিকিৎসা পেতে দ্রুত হাসপাতালটি চালু হওয়া দরকার। উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার ময়নুল হোসেন বলেন, এই হাসপাতালে আমি দুই বছর ধরে কর্মরত আছি। সম্প্রতি নিয়োগপত্রজনিত সমস্যার কারণে হাসপাতালটি বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি ৯ মাসেরও বেশি সময় থেকে বেতন পাচ্ছি না। আমরা যখন যোগদান করেছিলাম তখন আমাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রলোভন দেখানো হয়েছিল যে জাতীয়করণ হবে। পরবর্তীতে দেখছি কিছুই না। পরিচালক মহোদয় আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তিনি আরও বলেন, হাসপাতাল চালুর বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট পাওয়া যায়নি। ঈদের পর হয়ত চালু হতে পারে। আমরা চাই হাসপাতালটি আগের মতো চলুক। স্টাফরা নিয়মিত বেতন পাক। বলতে গেলে প্রত্যেক স্টাফই তো বাসা ভাড়া নিয়ে এখানে থাকেন। আমি গত ৯ মাস থেকে বেতন পাইনি কিন্তু আমাকে তো বাসা ভাড়া দিতেই হচ্ছে। এছাড়া আনুষঙ্গিক অনেক খরচ আছে। হাসপাতালটি দ্রুত সাবলীলভাবে চলুক এতটুকুই চাওয়া। হাসপাতাল বন্ধ থাকায় অনেক রোগী এসে ঘুরে যাচ্ছেন। পরিচালক মহোদয়কে বলব যেন দ্রুত এই সমস্যাগুলো সমাধান করে হাসপাতালটি চালু করেন। উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রেজাউল করিম বলেন, গত রমজান থেকে হাসপাতালে এই সমস্যা। বেতনের দাবিতে স্টাফদের আন্দোলনের চাপে কর্তৃপক্ষ হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়। কবে চালু হবে বলতে পারছি না। এরা এত জঘন্য যে মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা জামানত নিয়েছে অথচ হাসপাতালের বিদ্যুৎ বিলটা পর্যন্ত দেয়নি। বিদ্যুৎ ছাড়া তো প্রতিষ্ঠান চলা অসম্ভব। প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে অনেক রোগী এসে ঘুরে যাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে অনেক রোগী অপারেশনের জন্য বাড়ির গরু বিক্রি করে বিছানাপত্র নিয়ে চলে এসে দেখছেন হাসপাতালটি বন্ধ। আমাদের দাবি হচ্ছে এতদিন কাজ করলাম অন্তত কিছু টাকা দিলেও উপকৃত হতাম। ৯ মাস চাকরি করেছি। আমাদেরও খরচ আছে, ফ্যামিলি আছে। বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চলছি। হাসপাতালের অস্থায়ী আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মান্না চক্রবর্তী বলেন, দীর্ঘদিন থেকে হাসপাতালের চিকিৎসকসহ কর্মচারীদের বেতন বন্ধ। হাসপাতালের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনধিকার চর্চা, পেশিশক্তি প্রদর্শন, আরএমও এবং তার অধীনস্থ কর্মচারীদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। এভাবে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব না হচ্ছিল না বিধায় পরিচালককে চিঠি দিয়ে হাসপাতাল বন্ধ করার সুপারিশ করি। হাসপাতালের প্রধান হিসাবরক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান মিলন বলেন, মাঝখানে বেতন-ভাতা নিয়ে অফিসে একটি ধর্মঘটও করেছিলাম। ওই ধর্মঘট করার পর স্থানীয় পরিচালনা কমিটি মিলে রংপুরে যাই। তারপর সবাই মিলে মোটামুটি একটা সমাধান করা হয়েছে। এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালটি আগের অবস্থায় ফিরবে। হাসপাতালের পরিচালক রাকিবুল ইসলাম তুহিন বলেন, হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন স্যার হাসপাতালটি বন্ধ করে সাভারের হাসপাতালটি জমজমাট করার জন্য হাসপাতালের ৬৯.৫০ শতক জমির মধ্যে ইতোমধ্যে ২৯.৫০ শতক জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। বাকি জমিসহ হাসপাতালটি বিক্রয় করার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। হাসপাতালটি রক্ষার স্বার্থে ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন স্যারের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করি। এতে ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন স্যার ক্ষিপ্ত হয়ে তার কিছু এজেন্টের মাধ্যমে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ভুল বুঝিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তিনি আরও বলেন, আমরা গত ১৫ মে সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ল্যাবের প্রশাসনিক কার্যালয় রংপুরে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিপিডিএ-এর প্রতিনিধি, স্থানীয় হাসপাতাল পরিচালনা কমিটি ও হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে মিটিং করে হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান নিরসন করে হাসপাতাল চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমরা সম্মিলিতভাবে আগামী সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালটি চালু করবো। হাসপাতালটি রক্ষায় সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।