‘সংলাপ’ নিয়ে সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্য ক্ষীণস্বর কর্পুরের মতো বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, তাদের সংলাপের কথা মাটিতে পড়ার আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সংলাপ নিয়ে আওয়ামী নেতাদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে তারা জাতীয় তামাশার মূখপাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন জনগণের কাছে। এতে জনগণ বিমূঢ় বোধ করলেও জাতির সাথে তামাশা করাটাই আওয়ামীলীগের ‘পপুলার সংস্কৃতি’। তারা গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ভয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা পুণ:প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সবমসময় এড়িয়ে যায়। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কথা শুনলেই শাসকগোষ্ঠির ক্রোধবহ্নি জ্বলতে থাকে। অবশ্যই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তনই হবে সংলাপ বা যে কোন আলোচনার মূল ভিত্তি বা এজেন্ডা। কারণ এরা দেশের সকল গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে নির্বিকার ও নিবিষ্টচিত্রে। সুতরাং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে ওঠার শামিল।
গতকাল বৃহস্পতিবার (০৬ জুন) নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে নিজেদের অবৈধ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার নানামূখী গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে নিশিরাতের সরকার। একের পর এক দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে শেখ হাসিনা দেশে নিষ্ঠুর নাৎসি শাসন অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী আজীবন ক্ষমতায় থাকতে ও দুর্নীতিকে অবাধ রাখার জন্য সংবিধান কাটাছেড়া করে-সংশোধনী,কালাকানুন,ইনডেমনিটি -সবকিছু পাশ করে নিয়েছেন বিনা ভোটের অবৈধ সংসদে। গতকাল পুরো ভোট বাতিলের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আজ্ঞাবাহী নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনী বিল পাস করেছে শেখ হাসিনার ভূয়া ভোটের এমপিরা।
নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, নিজের স্বাধীনতাকে বিক্রি করে দিয়ে নির্বাচন কমিশন যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
রিজভী বলেন, বর্তমানে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়, এটি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন ‘ম্যানিপুলেট’ করার একটি মেশিন। নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের কারণে চলমান নির্বাচন বাতিলের যে ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ছিল তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ‘যেকোনো ভোট কেন্দ্র বা, ক্ষেত্রমত,সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করিতে পারিবে’- সংশোধনীতে এই বিধানটিকে সুকৌশলে বাতিল করে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ (পোলিং) বাতিল করার মধ্যে কমিশনের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কমিশন কর্তৃক নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা থাকবে না। এছাড়াও সংশোধনীতে ‘ইলেকশন’ শব্দকে ‘পোলিং’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। নির্বাচনের একটি পর্যায় হল ‘পোলিং’। পোলিং অর্থ ভোটের দিন ভোট নেওয়ার সময়টুকু বোঝায়। আর ‘ইলেকশন’ অর্থ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা থেকে ফলাফলের গেজেট প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ সময়। নতুন সংশোধনীতে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর, কোনো আসনের পুরো ফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না ইসি। কিন্তু পূর্বে গ্যাজেট প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী ফলাফল বাতিল স্থগিত করা যেত। সংশোধনীতে যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আসবে, শুধু সেসব (এক বা একাধিক) ভোটকেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর তদন্ত সাপেক্ষে ফল বাতিল করে কেবলমাত্র ওইসব কেন্দ্রে নতুন করে নির্বাচন দিতে পারবে ইসি।
এছাড়া আগে মনোনয়নপত্র দাখিলের ন্যূনতম সাত দিন আগে ক্ষুদ্রঋণ এবং টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল পরিশোধের বিধান থাকলেও এখন সরকারের দুর্নীতিবাজ লুটেরা ঋণ খেলাপিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের দিন পর্যন্ত তা পরিশোধের বিধান করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা এবং এর সারবত্তা নি:শেষ করে দেওয়া হলো। জাতীয় নির্বাচনের মাত্র মাস ছয়েক আগে ইসিকে ক্ষমতাহীন-নখদন্তহীন করার উদ্দেশ্য-সুদুরপ্রসারী। এই সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথকে রুদ্ধ করা জন্য এটি শেখ হাসিনার মাস্টারপ্ল্যান। যেখানে দেশী-বিদেশী সকল মহলের পক্ষ থেকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু করার জোর দাবী উঠেছে। সেখানে নির্বাচন কমিশনের বিদ্যমান ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সরকার আরো জোরালোভাবে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে গেলো। এতে আবারও প্রমানিত হলো শেখ হাসিনার অভিধানে সুষ্ঠু নির্বাচন নেই। এই সংশোধনী দুরভিসন্ধীমূলক, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার বেপরোয়া মনোভাব আরো বেশি প্রকট হলো। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন হলেও যাতে কিছু করতে না পারে সেজন্য এই রক্ষা কবচ। শুধু মাত্র কেন্দ্রভিত্তিক ভোট বাতিলের ক্ষমতা রাখলে কেন্দ্রের বাইরে উক্ত নির্বাচনী এলাকায় কোনো ভোটারকে বাধা প্রদান বা ভয় ভীতি প্রদর্শন বা বল প্রয়োগ করলে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার ক্ষমতা থাকলো না। তাদের দলীয় ক্যাডার, ছাত্রলীগ থেকে রিক্রুট করা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী-প্রশাসন দিয়ে সমস্ত ভোট কেন্দ্রে ভোট ডাকাতি করবে, বলপ্রয়োগ,হাঙ্গামা,ভীতি-প্রদর্শন,চাপ সৃষ্টি করবে। আর নির্বাচন কমিশন দুই- তিনটি কেন্দ্র অনিয়ম হয়েছে নাটক করে ভোট বাতিল করলেও আওয়ামীলীগের জয় নিশ্চিত। এটাই আওয়ামী লীগের নতুন ফর্মুলা।
গোটা প্রশাসনকে মুজিবকোটময় করা হয়েছে অভিযোগ করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, দলদাস আমলারা এখন আইনবিধি কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। ক্ষমতার মায়া হরিণের পিছে দৌড়াতে গিয়ে তারা নীতি, নৈতিকতা এবং রাষ্ট্রের আইনকে পদদলিত করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সরাসরি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন। রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাব-বাসাবাড়ীতে গোপন শলাপরামর্শ করছে। সেখানে একতরফা নির্বাচনের নতুন নীলনকশা করা হচ্ছে বলে জনমনে ধারনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সরকারি র্কমচারীদের জন্য প্রণীত আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে ভোটের মাঠে নেমেছেন কোন কোন অতি দলবাজ আমলা।
তিনি বলেন, সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব খাজা মিয়া আগামী নির্বাচনে নড়াইল-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে জনসভা করছেন। সেই সমাবেশে এই সচিব প্রতিপক্ষের হাত ভেঙ্গে দেয়ার হুমকী দিচ্ছেন। অথচ তার চাকরির মেয়াদ আছে আরও এক বছর। গণপ্রতনিধিত্বি অধ্যাদশে অনুযায়ী কোনো সরকারি র্কমর্কতার অবসর গ্রহণরে পর ৩ বছর পার হওয়ার আগে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। অথচ এর আগেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে চট্টগ্রামের ডিসি প্রকাশ্যে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছেন আর এই সাফল্যের কারণে তাকে পুরস্কৃত করে ঢাকার ডিসি বানানো হয়েছে।
রিজভী বলেন, বর্তমান আমলে প্রশাসন, পুলিশ, ওসি, ডিসি কারোরই চাকুরীবিধির কোন প্রয়োজন পরে না, চাকুরীরত অবস্থায় রাজনীতির ময়দানে তাদের অবারিত দ্বার। সরকারি র্কমচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫(১) ধারায় (রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ) বলা হয়েছে ‘সরকারি র্কমচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনরে সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবনে না অথবা বাংলাদশে বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক র্কমকান্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবনে না।’ আবারো সেই কথাটি মনে পরছে হাই সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ। সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলার তথ্য তুলে ধরে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ঢাকার সাভারে ঈদ পরবর্তী পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে ঢাকা জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এড. নিপুণ রায় নেতাকর্মীদের সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় চলাকালীন সময়ে ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদি’র নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। গত ২৩ জুন কুমিল্লার লাকসামে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর বক্তব্য রাখছেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ৭ নং ওয়ার্ড এর গাজিমুড়ার কাউন্সিলর শাহজাহান মজুমদার। গত ২ জুলাই মধ্যরাতে কক্সবাজার জেলার উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের মরিচ্যা শ্রাবস্তি বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ ধর্ম জ্যোতি ভিক্ষুর উপর সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। গত ৪ জুলাই রাত ৮টায় কুমিল্লা-নোয়াখালী আ লিক মহাসড়কের খিলা এবং উত্তরদারের মাঝামাঝি স্থানে, হাইওয়ের উপরে আগে থেকে ওঁতপেতে থাকা ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সন্ত্রাসীরা লাকসাম পৌরসভা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাঈন উদ্দিন রুবেলের উপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা রুবেলকে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে। গত ৪ জুলাই ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহবায়ক মোঃ জামাল, চর খলিফা ইউনিয়নের যুগ্ম আহবায়ক মোঃ আলম, সৈয়দপুর ইউনিয়নের সদস্য মোঃ হান্নান দলীয় কর্মসূচি থেকে ফেরার পথে আওয়ামী মদদপুষ্ঠ ০০৯ এর সন্ত্রাসীরা তাদের উপর হামলা চালিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। হামলায় অংশ নেন পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি ০০৯ গ্যাস্টারের প্রধান আকাশ ও কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সাগর। গত ৫ জুলাই ৩৯নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক জাফর ইকবাল লিটনকে ওয়ারী থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
কুমিল্লার লাকসামে ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে লাকসাম পৌর ছাত্রদলের সাবেক সহ সভাপতি, যুবনেতা রকিকে না পেয়ে তার বাবা সাংবাদিক মশিউর রহমান সেলিম মিয়া, মা, বোন এবং তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা ডিবির কার্যালয় মিন্টু রোডে। পরবর্তীতে রকির মা, বোন ও স্ত্রীকে ছেড়ে দিলেও তার বাবা সেলিম মিয়াকে লাকসাম থানায় প্রেরণ করে দেয় ডিবি পুলিশ। লাকসাম থানায় দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে এবং রিমান্ড শেষে কারাগারে প্রেরণ করে।