সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সাধারণ মানুষ কতটা নিরাপত্তাহীন, ভুক্তভোগী ছাড়া তা অন্য কেউ বুঝতে অপারগ। যাদের শরীরে বিপদের আঁচ লেগেছে শুধু তারাই অনুধাবন করতে পারেন এর মর্মবেদনা। তাদের কাছে স্পষ্ট যে, এ সমাজে নিজের এবং প্রিয়জনের জীবন কতটা নিরাপত্তাহীন এবং তাদের জীবনে অসহায়ত্ব কী নিদারুণ মাত্রায় পৌঁছেছে। কেবল তারাই মর্মে মর্মে এই বিষময় পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারেন। লক্ষণীয়, ক্ষমতাহীনরা অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছেন। হোক তা আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কিংবা অর্থনৈতিক। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে বিগত ১৪ বছরে গুম, খুন ও অপহরণ কী হারে সঙ্ঘটিত হয়েছে, এর ভয়াবহতা অনুধাবনে দেশী-আন্তর্জাতিক যে কোনো পরিসংখ্যান দেখাই যথেষ্ট। তাতে বোঝা যাবে দেশে মানবাধিকারের কী হাল! আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই বা কেমন? এ প্রসঙ্গে কেউ বলেন, বর্তমান সরকার গদি সুরক্ষায় এবং নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার তাগিদে ভোটে জিততে বিরোধীদের দমনে পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, তারই পরিণতিতে দেশে আইনশৃঙ্খলার বারোটা বেজেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ভিন্নমত দমনে পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তাতে এ বাহিনীর সুনামে ভাটা পড়েছে। তবে বিনিময়ে সরকারের তরফ থেকে জুটেছে অভাবনীয় সুযোগ-সুবিধা। ক্ষেত্রবিশেষে পেয়েছে দায়মুক্তি। যেমন ক্রসফায়ার এবং হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় কোনো কৈফিয়ত দিতে হয় না। তাই সারা দেশে সাধারণ মানুষ নিজে এবং পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে যারপরনাই উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত। কে কখন কোন গ্যাঁড়াকলে পড়েন, এ ভাবনায় সবাই সব সময় তটস্থ। গুম, খুনের কথা বাদ দিয়ে শুধু অপহরণের কথা দিয়ে আজকের এ লেখা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। মাস দুয়েক আগে দৈনিক ইত্তেফাকে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি ছিল এমন, ‘পুলিশ বলছে, গরিব কিংবা ধনী যে পরিবারের সন্তান হোক না কেন, তাদের কাজ হলো অপহরণ করে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা। উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুরকেন্দ্রিক চক্রটি শিশুদের ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারকে ফোন করে বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করত। টাকা আদায়ের পর ছেড়ে দিত। চক্রটি ভুক্তভোগীদের কাছে ‘মানবিক অপহরণকারী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কারণ কখনো কখনো মুক্তিপণ না পেলেও অপহৃত শিশুর কোনো ক্ষতি করেনি।’ (৭ মে, ২০২৩; ইত্তেফাক) ইংরেজি ‘কিডন্যাপ’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘মনুষ্য-হরণ’ এবং ‘অ্যাবডাকশনের’ প্রতিশব্দ ‘অপহরণ’। সংবাদপত্রে মাঝে মধ্যে মনুষ্য-হরণ এবং অপহরণের খবর পাওয়া যায়। সাধারণত নারী-শিশুরা এর শিকার হয়। অপহরণের পর অপরাধীরা অপহৃতের পরিবারকে পণবন্দী করে নানারকম স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টা চালায়। আইনের চোখে ‘মনুষ্য-হরণ’ ও ‘অপহরণ’ ফৌজদারি অপরাধ এবং এর সাজাও কঠিন। আইনের ভাষায় অপহরণ হলো কোনো ব্যক্তিকে জোর করে ধরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তুলে নিয়ে যাওয়া। দ-বিধির ৩৬১ নম্বর ধারায় অপহরণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ১৪ বছরের কম বয়স্ক পুরুষ বা ১৬ বছরের কম বয়স্ক নারী বা কোনো অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তিকে আইনানুগ অভিভাবকের তত্ত্বাবধান থেকে অনুমতি ছাড়া বা প্রলুব্ধ করে নিয়ে যায়; সে অপহরণকারী হিসেবে গণ্য হবে। তবে দ-বিধির ৩৬১ ধারাটির কিছু ব্যাখ্যা ও ব্যতিক্রমও জানা প্রয়োজন। এ ধারায় ‘আইনানুগ অভিভাবক’ শব্দাবলিতে অনুরূপ নাবালক বা অন্য কোনো ব্যক্তির আইনানুগ তত্ত্বাবধান রক্ষণাবেক্ষণের ভারপ্রাপ্ত যেকোনো ব্যক্তিকে বোঝাবে। এ ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো শিশুর বা কোনো নাবালককে আইনানুগ অভিভাবক হিসেবে বিশ্বাস করে; তবে তার ক্ষেত্রে ধারাটি প্রযোজ্য হবে না। এদিকে ৩৬২ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে কোনো স্থান থেকে আসতে জোরপূর্বক বাধ্য করে বা কোনো প্রতারণামূলক উপায়ে প্রলুব্ধ করে, সেই ব্যক্তি ওই ব্যক্তির অপহরণকারী বলে গণ্য হবে। দ-বিধির ৩৫৯ ধারা অনুসারে ‘মনুষ্য-হরণ’ দুই প্রকারের। প্রথমত, দেশ থেকে মনুষ্য-হরণ, দ্বিতীয়ত, আইনানুগ অভিভাবকত্ব থেকে মনুষ্য-হরণ। দ-বিধির ৩৬০ নম্বর ধারা অনুসারে যে ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে ওই ব্যক্তি বা ওই ব্যক্তির পক্ষে সম্মতি দানে আইনত ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া বাংলাদেশ সীমানার বাইরে বহন করে নিয়ে যায়, সেই লোক ওই ব্যক্তিকে বাংলাদেশ থেকে অপহরণ করেছে বলে গণ্য করা হবে।ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপির) উত্তরা বিভাগ দুই ছাত্রকে অপহরণের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে। গত ৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানানো হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয়, ভুক্তভোগীর অসহায়ত্ব। তারা এতটাই অসহায় যে- অপহরণের মতো জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িতদেরকে তারা চিত্রিত করেছেন ‘মানবিক অপরাধী’ হিসেবে। অথচ অপহরণ যে একটি মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধ সেই বোধ অনুপস্থিত। আইনানুগভাবে অপরাধের যে কোনো মানবিকতা নেই; বর্তমান সমাজ-বাস্তবতায় সেই বোধবুদ্ধি আমরা হারাতে বসেছি। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন আমাদের মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। যার কারণে অপহরণকারীকেও বলতে হচ্ছে মানবিক? ওই প্রতিবেদন পড়লে বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয় না। অপহরণের পর মেরে না ফেলে জীবিত ফেরত দেয়ায় পরিবারের অন্য সদস্য বিশেষ করে বাবা-মায়ের কাছে থেকে অপরাধী চক্রটি যে মানবিক খেতাব পাচ্ছে; তা সহজে অনুমেয়। বাস্তবে অপহরণের পর কেউ অক্ষত ফিরে এসেছেন, এটাকেই সবাই সৌভাগ্য হিসেবে দেখছেন। যে যতটুকু টাকা দেয়ার সামর্থ্য রাখেন অপহরণকারীরা সেটুকুই গ্রহণ করায় বিষয়টি আরো পোক্ত হয়েছে। যে দেশে সুশাসনের তীব্র অভাব সেই রাষ্ট্রে টাকার অঙ্ক নিয়ে অপহরণকারীরা যে দরকষাকষি করে না; তাদের মানবিক অপরাধী বলা ছাড়া আমাদের আর কিই-বা বলার আছে! সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, শিশুদের অপহরণের পর পরিবারের কাছে মুক্তিপণ আদায় করত চক্রটি। গত ছয় থেকে সাত বছরে রাজধানীর উত্তরা ও আশপাশের এলাকা থেকে ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সী পাঁচ শতাধিক শিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০০ টাকাও নিয়েছে। মুক্তিপণের টাকায় চলত মাদক সেবন আর মউজ-মাস্তি। ৫ মে ২০২৩, শুক্রবার ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলমের তত্ত্বাবধানে অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূল হোতা মিল্টন মাসুদকে গ্রেফতার করা হয়। মিল্টনের দুই সহযোগী শাহীনুর রহমান ও সুফিয়া বেগমও ধরা পড়ে। পরদিন ৬ মে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে চক্রটির আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন ডিসি মোর্শেদ আলম। সেখানে সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান, সম্প্র্রতি উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টর থেকে শাহিন নামে এক শিশু নিখোঁজ হলে থানায় জিডি করা হয়। সেই জিডির সূত্র ধরে পুলিশ তদন্তে নেমে এ চক্রের সন্ধান পায়।
চক্রের মূল হোতা মিল্টন মাসুদের নেতৃত্বে চক্রের সদস্যরা শিশু শাহিনকে অপহরণ করেছে বলে জানার পর গাজীপুরের সালনা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যে শিশু শাহিনকে উদ্ধারের পাশাপাশি শিশু অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের বিষয়ে চমকপ্রদ! সব তথ্য বেরিয়ে আসে। পুলিশ জানিয়েছে, অপহরণকারী চক্রের মূল হোতা মিল্টন মাসুদ আগে থেকে মাদকাসক্ত। এ কারণে সে শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ে জড়িয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা ও তিনটি শিশু অপহরণ মামলা রয়েছে। এসব মামলায় সে একাধিকবার জেলেও ছিল। অপহরণ করে যে টাকা পেত সেই টাকা সহযোগী মো: শাহীনুরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিত। শাহীনুর মাতৃভা-ার নামে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক বলে নিজেকে পরিচয় দিত। পুলিশের ভাষ্যমতে, এই অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে ঘোরাফেরা করত। নিশানায় থাকত ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুরা। যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। শুধু বাবা-মায়ের মোবাইল ফোন নাম্বার মুখস্থ রয়েছে। কিছু সময় এমন শিশুদের সাথে গল্প করতে করতে প্রিয় বাবা-মাকে জানানো হতো তাদের সন্তানকে অপহরণ করা হয়েছে। আর ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে টাকা দাবি করা হতো। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কবলে পড়ে বর্তমান সময়ে এসে ভয়ঙ্কর অপরাধ অপহরণকেও আমরা দেখছি লঘুভাবে। দেশের চলমান বাস্তবতায় অপহরণকারীরা কাউকে শুধু জানে না মারার জন্যও পাচ্ছে সহানুভূতি। তাই রসিকতা করে বলা যায়, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ব্রিটেন যেমন তার ছেলে রাজা চার্লসের জমানায় প্রবেশ করেছে, ঠিক তেমনি তার অভিষেকের দিন পুলিশের সংবাদ সম্মেলনের বদৌলতে আমরাও জানতে পারলাম, বাংলাদেশে আমরা প্রবেশ করেছি ‘মানবিক অপহরণের যুগে’। দু’টি খবর গণমাধ্যমে একই দিন প্রকাশ পেয়েছে। একটির শিরোনাম ছিল- ‘শপথ নিয়ে রাজমুকুট পরলেন চার্লস’। অন্যটির শিরোনাম- ‘পাঁচ শতাধিক শিশুকে অপহরণ করেছে ওরা’। ওই শিরোনামের নিচে হ্যাঙ্গার করা হয়েছে- ‘সেই টাকায় আমোদফুর্তি, গ্রেফতার ৩’।