মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ পশু কোরবানির মাধ্যমে ঈদুল আজহা উদ্যাপন করেছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে এবার মোট ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি গবাদি পশু কোরবানি করা হয়েছে এবং এর মধ্যে গরু ও মহিষের সংখ্যা ৪৮ লাখের বেশি। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতগুলোর মধ্যে চামড়া এবং চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার জন মানুষ চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। এর ফলে সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে দরিদ্র শ্রেণির অর্থোপার্জনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। দেশে পিতৃহীন এতিম ও অসহায় শিশুদের ভরণপোষণ এবং শিক্ষায় ব্যয় হওয়া অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস হচ্ছে কোরবানির পশুর চামড়ার মাধ্যমে বিক্রীত অর্থ। কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য বৃদ্ধি অথবা হ্রাসের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অসহায় শিশুদের জীবন। এছাড়াও মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য প্রধান উৎসও হলো কোরবানির পশুর চামড়ার মাধ্যমে বিক্রয়লব্ধ অর্থ, যা জনগণের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটি বিরাট অংশ এসে থাকে চামড়া এবং চামড়াজাত দ্রব্য বিক্রয়ের মাধ্যমে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ আয় করে প্রায় ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম চামড়াজাত জুতা উৎপাদনকারী দেশ এবং বিশ্বে মোট ফুটওয়্যার অর্থাৎ জুতা উৎপাদনের ২ দশমিক ১ শতাংশ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। চীন, ইতালি, স্পেন, হংকং জাপান, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাতকৃত চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি করে থাকে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ চামড়া এবং চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে। সুতরাং কোরবানি ঈদের চামড়া, প্রক্রিয়াজাতকৃত চামড়া, চামড়াজাত দ্রব্য ইত্যাদি আমাদের দেশের আর্থসামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি খাত হিসেবে ছিল চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য। ১৯৪০ সালে দেশে প্রথম ট্যানারি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বর্তমানে ট্যানারির সংখ্যা প্রায় ২০০টি। বেশ কিছুসংখ্যক ট্যানারি ঢাকার হাজারীবাগ এলাকা থেকে সাভারে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং এর মধ্যে ১৫ থেকে ২০টি চলমান রয়েছে। ঢাকার হাজারীবাগে চামড়াসংক্রান্ত শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া খুলনা ইউনির্ভাসিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে (কুয়েট) লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি (ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি দেওয়া হয়। তবে কৃত্রিম চামড়ার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পশুজাত চামড়ার চাহিদা অনেকাংশ হ্রাস পেয়েছে। পশুজাত চামড়ার তুলনায় কৃত্রিম চামড়ার দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চামড়া রপ্তানির জন্য চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি)-সনদ প্রয়োজন হয়। এ সনদ আছে আমাদের দেশের মাত্রটি তিনটি প্রতিষ্ঠানের। এ সনদ না থাকায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি আয় হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
এবারের ঈদে প্রতিটি গরুর চামড়া সাধারণত ৮০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। সরকার কোরবানির পশুর চামড়া প্রতি বর্গফুট হিসাবে দাম নির্ধারণ করে দিলেও সর্বত্র কার্যকর হয়নি। দাম নির্ধারণ করা হয় ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৪৫ টাকা থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে। রংপুর নগরীর আশপাশে প্রতি বর্গফুট ১৫ টাকা থেকে ২৪ টাকার মধ্যে বিক্রয় হয়েছে। এভাবে চামড়া কিনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ীরা পুঁজিসংকটে চামড়া কিনতে পারেননি। এছাড়া লবণের মূল্যবৃদ্ধি ও ট্যানারি মালিকদের অপরিশোধিত অর্থের ফলে সমস্যায় পড়েছেন প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্র্য বিমোচন, অসহায়-এতিমদের ভরণপোষণ এবং শিক্ষা কার্যক্রম, ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন প্রভৃতি প্রেক্ষাপটে কোরবানির পশুর চামড়া, চামড়াজাত দ্রব্য ইত্যাদির সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিনিয়োগ, ব্যবসা, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়গুলোর প্রতি নজর বৃদ্ধি আমাদের সবারই কাম্য। লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট