শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ পূর্বাহ্ন

কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার রোধ জরুরি

সানোয়ার হোসেন
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০২৩

বর্তমান সমাজে কিশোর গ্যাং এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। সম্প্রতি সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা হু হু করে বেড়ে চলেছে। কিশোরদের এমন বেপরোয়া আচরণ সমাজব্যবস্থাকে করছে কলুষিত। অতীতে কিশোর গ্যাং বলতে ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘তিন গোয়েন্দা’সহ বিভিন্ন গ্রন্থের জনপ্রিয় চরিত্র কিশোরদের কাছে পরিচিত ছিল। এসব কিশোর গ্যাং সমাজের নানা অন্যায় ও অসংগতি রুখে দিতে কিশোরদের অনুপ্রাণিত করত। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্র্যাক প্লাটুন নামক দুঃসাহসী এক তরুণ দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। পক্ষান্তরে, কিশোর গ্যাং এখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। বর্তমানে কিশোর গ্যাং শহর থেকে গ্রাম, পাড়া-মহল্লায়, অলিতে-গলিতে সর্বত্র গড়ে উঠছে আশঙ্কাজনক হারে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর মতে, শুধু রাজধানীতে ঢাকাতেই ৫২টি সক্রিয় ‘কিশোর গ্যাং’ গ্রুপ এবং ৭০০ জন ‘কিশোর গ্যাং’ সদস্য রয়েছে। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় সমগ্র দেশের চিত্র কতটা ভয়াবহ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মাদক চোরাচালান, অপহরণ, যৌন হয়রানি, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি থেকে শুরু করে গুম-খুনের মতো ঘৃণ্য অপরাধে কিশোরেরা জড়িয়ে যাচ্ছে প্রায়শই। বর্তমানে কিশোর গ্যাং শুধু অভিভাবকদের জন্যই আতঙ্ক নয়; বরং পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাদকাসক্তি, দারিদ্র্য, নি¤œমানের জীবনযাত্রা, পরিবারিক সমস্যা, হতাশা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবÍএই কারণগুলোই মূলত কিশোর গ্যাংসমূহ গড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী। মূল কারণগুলো ছাড়াও আরো কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। যেমনÍশিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। ফলে কিশোরেরা পারিবারিক অনুশাসনে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া কেউ কেউ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে এবং এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে কিশোরদের ব্যবহার করছে নানা সন্ত্রাসীমূলক কর্মকা-ে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০টি খুন হয়েছে। এছাড়া প্রতি মাসে রাজধানী ঢাকায় ২০টি হত্যার মতো ঘটনা ঘটে থাকে। এদের মধ্যে অধিকাংশ হত্যার পেছনে কিশোর অপরাধীরা জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ঢাকার শিশু আদালতের নথি অনুযায়ী, কিশোরদের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে গত ১৫ বছরের মধ্যে রাজধানী ঢাকার মধ্যেই ৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে প্রতিনিয়ত কিশোর গ্যাং সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে চলেছে। চলতি বছরে সারা দেশে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও র?্যাবের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অপরাধ কর্মকা-ে জড়িত শতাধিক কিশোরকে গ্রেফতার করেছে। তার মধ্যে চলতি মাসের ৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ হামলায় নয়ন শিকদার (১৭) নামে এক কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনায় ছয় জন ‘কিশোর গ্যাং’ সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ। গত ১৫ জুন চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের প্রস্তুতিকালে ‘কালা বাচ্চু’ স্কোয়াডের পাঁচ সদস্য ও ১০ জুন চট্টগ্রামের কদমতলী বিআরটিসি বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে ‘টিন স্কোয়াড’ নামের কিশোর গ্যাং গ্রুপের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে র?্যাব-৭। এছাড়া গত ১৪ ফেব্রুয়ারি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত ১৪ কিশোরকে যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর এলাকা থেকে আটক করেছে র?্যাব-১০। এর আগে র্যাব-২-এর একটি দল ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, হাজারীবাগ, বসিলা ও কারওয়ান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ধারালো অস্ত্রসহ ২০ কিশোর সদস্যকে আটক করে। এসব পরিসংখ্যানই কিশোর অপরাধের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরতে যথেষ্ট।
আজকের শিশু-কিশোর আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের দ্বারা এমন অপরাধ সংঘটিত হওয়া মোটেই কাম্য নয়। আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগ, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের ভূমিকাই পারে শিশু-কিশোরদের এমন হীন অপরাধ থেকে বিরত রাখতে। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে আইনের সুষ্ঠ সংস্কার অতীব জরুরি। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম কেউ অপরাধ করলে তাকে কিশোর অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয়। হত্যাকা-ের মতো সর্বোচ্চ অপরাধের জন্য শাস্তি মাত্র ১০ বছরের কারাদ-। শাস্তির মাত্রা লঘু হওয়ায় কিশোরেরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। শাস্তির সীমা বাড়াতে আইন বিভাগকে পদক্ষেপ নিতে বা অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় রেখে আইনের সংস্কার প্রয়োজন। পরিবার হচ্ছে একটি শিশুর শিক্ষার সূতিকাগার। পারিবারিক অনুশাসন ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সমাজ ও পরিবারের অভিভাবকদের জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। উপরন্তু, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কিশোর সংশোধনাগারগুলো কিশোরদের নানাভাবে কাউন্সিলিংয়ের ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। সাইবার সিকিউরিটি ও তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধকল্পে রাষ্ট্রকে আরো বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কিশোরদের যাতে কোনোভাবে প্রভাবিত না করতে পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পাশাপাশি কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে শহর-গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় সচেতনতামূলক কর্মকা- শুরু করতে হবে। শিশু-কিশোরদের নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়াতে হবে। তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ দৃশ্যমান করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি, ‘কিশোর গ্যাং কালচার’ প্রতিরোধে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রতিরোধ। লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com