উপমহাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা এখন খুবই উত্তপ্ত। পৌনে ২০০ বছর রাজত্ব করে আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ চলে যাওয়ার সময় ভারত স্বাধীনতা আইন ১৯৩৫-এর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাহোর প্রস্তাব মোতাবেক টু ন্যাশন থিউরি অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত ব্রিটিশ সরকার থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সেই সময়ে কায়েদ-এ-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অখ- ভারতের নেতৃত্বে থাকতে চেয়েছিলেন, যা তার জীবনীতে পাওয়া যায়। ভারতের তৎকালীন মুসলিম সমাজও অখ- ভারত চেয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু কমিউনিটির চেয়ে মুসলমানদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত জোরালো। যুদ্ধ করে নয়; ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলমান শাসকদের হত্যা করেই ব্রিটিশ ভারত দখল করেছিল। ফলে ব্রিটিশদের সাথে মুসলমানদের বিরোধ, দ্বিমত ও তারতম্যের সুযোগ নিয়েছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা, বিশেষ করে উচ্চ বর্ণের ধনী শ্রেণীর বণিকরা।
চাকরি, ক্ষমতার অংশীদারত্ব, ব্যবসা বাণিজ্য ও জমিদারিতে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা আধিপত্য লাভ করে। উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতাদের সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন আচরণের কারণেই মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র বা আলাদা স্বাধীন আবাস ভূমি গঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা) সমন্বয়ে ১২০০ মাইল দূরত্বের ব্যবধানে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভাত ও ভোটের অধিকারের দাবিতে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের কারণে ২৪ বছরের মাথায় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়, যাতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রণীত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার অপব্যাখ্যা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দমিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বিত করা হচ্ছে বরাবর।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু সাম্প্রদায়িক নয়। ইসলাম ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা সমর্থন করে না। তবে নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রতি আনুগত্যে অটল থাকার জন্য ইসলামে নির্দেশনা রয়েছে। হযরত মুহাম্মদ সা. বিদায় হজের ভাষণে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি এ মর্মে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, ইতঃপূর্বে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম উদারপন্থী অসাম্প্রদায়িক নীতিতে বিশ্বাসী একটি ধর্ম যার দ্বারা পৃথিবীতে মানুষের অধিকার ও শান্তির বাণী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কোথাও কোথাও গোঁড়ামি ও উগ্রতা বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। অন্যান্য ধর্মেও একই ধরনের উগ্রতা কম নয়। উচ্চবর্ণ ও নি¤œবর্ণ সৃষ্টি করে উচ্চবর্ণবাদীরা নিজেদের মধ্যে দ্বিজাতিতত্ত্ব সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ অর্থাৎ পূর্ব বাংলা ও আসাম সমন্বয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে ব্রিটিশ সরকার আলাদা প্রদেশ ঘোষণা দিলে এ অঞ্চল শিক্ষা-দীক্ষায়, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে সম্পৃদ্ধিশালী হতে থাকে। কিন্তু কলকাতাভিত্তিক উচ্চবর্ণের হিন্দু বণিক শ্রেণীর প্রবল বাধাবিপত্তির কারণে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গকে রদ করে পূর্ব বাংলাকে পুনরায় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কলকাতার নিয়ন্ত্রণাধীন করে দেয়। বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য তখন রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি ভালোবাসি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টিতে ১৯২০ সালে অনুরূপ ঘটনাই ঘটেছিল। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রবল বাধা বিপত্তির পরও শেরেবাংলা ফজলুল হকের রাজনৈতিক প্রভাব, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর জমিদার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর আর্থিক অনুদান এবং স্যার নবাব সলিমুল্লাহর দান করা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ও নির্মিত হয়ে শতবর্ষ অতিক্রম করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গত মাসে নিরবে-নিভৃতে স্যার সলিমউল্লাহর জন্মদিন চলে গেল। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো বটেই এমনকি ঢাকাবাসীও তাকে স্মরণ করেনি। বাংলাদেশ সরকার কোনো দিন তাকে স্মরণ বা স্বীকৃতি দিয়েছে কিনা দেখা বা শোনা যায়নি। বরং স্বাধীনতার পর ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’ নামকরণ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়েছে, এতে নাকি ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শিত হয়েছে।
পৃথিবীতে যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্মভিত্তিক দাঙ্গা হয়েছে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের চক্রান্তে ভারতে। সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তথা মুসলিম নিধন ভারতেই হয়েছে সবচেয়ে বেশি, যার পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। অতি সম্প্রতি ভারতের নবনির্মিত পার্লামেন্ট ভবনের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যার বিরুদ্ধে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উসকানির অভিযোগ রয়েছে। আরো আলোচনা রয়েছে যে, ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী বা নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোসের জন্মদিনে নয় বরং হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিনে উক্ত নবনির্মিত পার্লামেন্ট ভবনের উদ্বোধন করা হয়েছে, যা রেওয়াজ অনুযায়ী ভারতের রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এ কারণে যে, রাষ্ট্রপতি দলিত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। ইতঃপূর্বেও দলিত সম্প্রদায়ের একজন রাষ্ট্রপতি হওয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরে রাষ্ট্রপতি দম্পতিকে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
নবনির্মিত পার্লামেন্ট ভবনে রক্ষিত ভারতের মানচিত্রে বাংলাদেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, আলাদা করে দেখানো হয়নি। ভারত বাংলাদেশের শুধু প্রতিবেশী নয় বরং ভারত দ্বারাই বাংলাদেশ পরিবেষ্টিত, দক্ষিণ দিক উন্মুক্ত, যাতে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান। ভারতের সাম্প্রদায়িক উসকানি ও মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাদ করার জন্য মোদি সরকার গৃহীত আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ মুসলমানদের মনে অনেক পীড়াদায়ক, স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে পীড়ার অংশীদার হয়ে যায় বাংলাদেশের মুসলমানেরাও। পৃথিবীর সব মুসলমান ভাই ভাই সম্পর্কিত। এ ভাবধারা থেকেই ভারতে সাম্প্রদায়িকতার ঢেউ বাংলাদেশেও পীড়া, বেদনা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ নাগরিক ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু ঈমান-আকিদার বাস্তবায়নের প্রশ্নে মুসলমানরা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। বিনা কারণেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সুপ্রমি কোর্টের মূল ভবনের সামনে একটি মূর্তি স্থাপন করে মুসলিম সেন্টিমেন্টে চরম আঘাত হেনেছিলেন, যার নিরসন ঘটানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মূর্তিটি মূল ভবনের সামনে থেকে স্থানান্তরিত হলেও এনেক্স বিল্ডিংয়ে পুনঃস্থাপন করা হয়। ইসলামিক দলগুলো এ মূর্তির বিরোধিতা করলেও নিজেদের শক্ত অবস্থান প্রদর্শন করতে পারেনি বিধায় সরকার সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনেই মূর্তিটি পুনঃস্থাপন করেছে, যা নিয়মিত পুলিশ প্রহরায় এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
সংখ্যাগুরু মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও শিশু-কিশোরদের পাঠ্যক্রমে অসাম্প্রদায়িক করার অজুহাতে মুসলিম মনীষীদের জীবনী এবং শিক্ষা, সাহিত্যে, চিকিৎসায় বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ বাদ দিয়ে অমুসলিমদের বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ, জীবনী স্থান পাওয়ার পাশাপাশি কোমলমতি শিশু-কিশোরদের যৌনবিদ্যা শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে শিশু-কিশোর বয়সেই আমাদের সমাজে যৌন অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে, আলেম সমাজ প্রতিবাদ করে এবং যেহেতু আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ নয় সেহেতু মুসলিম ধর্মভীরুদের প্রতিবাদকে সরকার, পশ্চিমা শক্তি বা ধর্মীয় প্রতিপক্ষরা আমলে নিচ্ছে না।
বাংলাদেশে ইসলামী শক্তি ঐক্যবদ্ধ নয়। তারা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে একে অপরের বিরুদ্ধে কঠিন সমালোচনা করে। তাদের সমালোচনা ধর্মের মূলনীতির বিপক্ষে নয়, বরং ছোটখাটো আমল আকিদা নিয়ে। সম্প্রতি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে একটি সমাবেশ করে শত নির্যাতনের পরেও জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিক মজবুতি প্রমাণ করেছে। চরমোনাই পীর সাহেবরা নির্বাচন করে যাচ্ছে, তারা যে ভোট পাচ্ছে সে ভোট সম্মিলিত বামজোট পাওয়ার কথা নয়। হেফাজতে ইসলামের একটি ভালো সমর্থক গোষ্ঠীসহ সাংগঠনিক অবস্থা রয়েছে। তাছাড়াও প্রত্যেক পীর সাহেবের রয়েছে নিজস্ব মুরিদ নামে জনবল। সরকারের আনুকূল্যে মাইজভা-ারী পীর এখন সংসদে, যিনি বিএনপিভুক্ত হয়ে ইতঃপূর্বেও সংসদে ছিলেন।
অসংখ্য পীর মাশায়েখ, অলি-আউলিয়ার স্মৃতিধন্য, মসজিদ-মাদরাসায় পূর্ণ সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা দেশের নাম বাংলাদেশ। এখানকার মুসলমানদের কণ্ঠ আজ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার কারণে তারা লাঞ্ছিত অপমানিত। তাদের কালিমা এক। অথচ, ওই নীতিমালার ভিত্তিতে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী